তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি ২১তম অধ্যায় - নবী মুস্তাফা (ﷺ) কর্তৃক তাওহীদের মর্যাদা সংরক্ষণ করা এবং শির্কের সকল পথ বন্ধ করণে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা (باب ما جاء في حماية المصطفى صلى الله عليه وسلم جناب التوحيد وسده كل طريق يوصل إلى الشرك) শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ)
নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাওহীদের মর্যাদা সংরক্ষণ করা এবং শির্কের সকল পথ বন্ধ করণে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

‘‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের হেদায়াতের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়’’। (সূরা তাওবাঃ ১২৮)

ব্যাখ্যাঃ এ ধরণের অধ্যায় ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। উক্ত আয়াত দ্বারা এভাবে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রত্যেক ঐ বস্ত্ত খুব কষ্টকর বলে মনে হত, যা তাঁর উম্মতকে গুনাহগার করে দেয় এবং কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে। তাদেরকে যে বিষয়টি সর্ববৃহৎ গুনাহর মধ্যে ফেলে এবং সর্বাধিক কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে, তা হচ্ছে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করা। চাই তা কম হোক বা বেশী হোক কিংবা এমন বিষয় হোক, যা শির্ক না হলেও শির্কের দিকে নিয়ে যায় কিংবা এমন কবীরাহ গুনাহ, যা শির্কের নিকটবর্তী করে দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনসব বিষয় থেকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন, যা মানুষকে শির্কের দিকে নিয়ে যায়। সাহাবীদেরও ছিল একই অবস্থা। তারা রোগীর গলায় সূতা ঝুলানো দেখলে কিংবা তাবীজ-কবজ দেখলে কেটে ফেলতেন।

সাহাবী আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«لاَ تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَلاَ تَجْعَلُوا قَبْرِى عِيدًا وَصَلُّوا عَلَىَّ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ تَبْلُغُنِى أينما كُنْتُمْ»

‘‘তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করোনা, আর আমার কবরকে ঈদ-উৎসবের স্থানে পরিণত করোনা। আমার উপর তোমরা দুরূদ পড়ো। তোমরা যেখান থেকেই আমার উপর দুরূদ পাঠ করো না কেন, তোমাদের দুরূদ আমার কাছে পৌঁছে যায়। ইমাম আবু দাউদ হাসান সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য’’।[1]

ব্যাখ্যাঃ হাফেয মুহাম্মাদ বিন আব্দুল হাদী (রঃ) বলেনঃ এ হাদীছটি হাসান। ভাল সনদে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীছের আরো অনেক শাওয়াহেদ রয়েছে।[2] এ কারণে তা সহীহর স্তরে উন্নীত হয়েছে।

এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদেরকে নিষেধ করেছেন, তারা যেন ঘরসমূহকে নামায থেকে খালি না রাখে। অনুরূপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরকে সামনে রেখে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। এ আশঙ্কায় তিনি কবর সামনে নিয়ে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন, যাতে লোকেরা কবরকে কেন্দ্র করে ফিতনায় না পড়ে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে কবর পূজায় লিপ্ত না হয়। কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়া নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সাহাবীদের জানা ছিল। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ঘরগুলোকেও কবরের অনুরূপ করতে নিষেধ করেছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমরা আমার কবরকে ঈদ, উরস ও উৎসবের স্থানে পরিণত করোনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা থেকে গ্রন্থকার শিরোনাম রচনা করেছেন। অর্থাৎ এ কথা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি শির্কের পথ বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ ঈদ এমন সম্মেলন ও উৎসবকে বলা হয়, যা স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতি বছর কিংবা প্রতি সপ্তাহে কিংবা প্রতি মাসে অথবা অনুরূপ নির্দিষ্ট সময়ের পর ফিরে আসে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ প্রত্যেক এমন সময় ও স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানকে ঈদ বলা হয়, যা স্বাভাবিক নিয়মেই বার বার ফিরে আসে এবং যাকে উদ্দেশ্য করে অনুষ্ঠান করা সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। عيد শব্দটি معاودة (বার বার ফিরে আসা) এবং اعتياد (অভ্যাসে পরিণত হওয়া) থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ঈদ যেহেতু অভ্যাস মুতাবেক প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, তাই একে ঈদ বলা হয়।

কোনো স্থানকে ঈদ বলা হলে এর দ্বারা সেই স্থান উদ্দেশ্য, যাতে এবাদত অথবা অন্য কোনো নিয়তে লোকেরা একত্রিত হয়। যেমন মাসজিদুল হারাম, মিনা, মুযদালাফা, আরাফা এবং অন্যান্য পবিত্র স্থানকে আল্লাহ তাআলা তাওহীদপন্থীদের বার বার মিলনের কেন্দ্রস্থল এবং ছাওয়াব অর্জনের স্থানে পরিণত করেছেন। এই স্থানসমূহকে ঈদও বানিয়েছেন।

জাহেলী যামানার মুশরিকদেরও বেশ কিছু ঈদ ছিল। এগুলোর কিছু ছিল সময়ের সাথে সম্পৃক্ত আবার কিছু ছিল স্থানের সাথে সম্পৃক্ত। তারা যেমন নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হত তেমনি নির্দিষ্ট সময়েও একত্রিত হত। অতঃপর যখন ইসলাম আসল, তখন এ সকল ঈদকে বাতিল ঘোষণা করা হল। এর বদলে মুসলিমদের জন্য ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা এবং হজ্জের মৌসুমে মিনার দিনসমূহকে ঈদে পরিণত করা হল। এমনি যে সকল স্থানকে মুশরিকরা ঈদ মনে করত, তার বদলে কাবা, মিনা, মুযদালাফা, আরাফা এবং অন্যান্য পবিত্র স্থানকে ঈদ বানিয়েছেন।

আলী ইবনুল হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি একদা একজন লোককে দেখতে পেলেন যে, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে একটি ছিদ্রপথে প্রবেশ করে দুআ করছে। তখন তিনি ঐ লোকটিকে এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করলেন। তাকে আরো বললেন, আমি কি তোমার কাছে সেই হাদীছটি বর্ণনা করবনা, যা আমি আমার পিতার কাছ থেকে শুনেছি এবং তিনি শুনেছেন আমার দাদার কাছ থেকে, আর আমার দাদা শুনেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«لا تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا وَلا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا فَإِنَّ تَسْلِيمَكُمْ يَبْلُغُنِي أَيْنَمَا كُنْتُمْ»

‘‘তোমরা আমার কবরকে ঈদে পরিণত করোনা আর তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করোনা। তোমরা যেখানেই থাকোনা কেন তোমাদের সালাম আমার কাছে পৌছে যায়। ইমাম যিয়াউদ্দীন আল-মাকদেসী হাদীছটি মুখতারায় বর্ণনা করেছেন।

ব্যাখ্যাঃ এ হাদীছের বর্ণনাকারী হচ্ছেন আলী বিন হুসাইন বিন আলী বিন আবু তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি যাইনুল আবেদীন নামেই অধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। আহলে বাইতের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বোত্তম ও সর্বাধিক জ্ঞানী। ইমাম যুহরী (রঃ) বলেনঃ কুরাইশদের মধ্যে আমি তাঁর চেয়ে অধিক উত্তম আর কাউকে দেখিনি। বিশুদ্ধ মতে তিনি ৯৩ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন।

যাইনুল আবেদীন দেখলেনঃ একজন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে একটি ছিদ্র পথে প্রবেশ করে দুআ করছে। তখন তিনি ঐ লোকটিকে এ ধরনের কাজ করতে নিষেধ করলেন। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, দুআ করার জন্য এবং নামাযের নিয়তে কবর ও মাযারের নিকট যাওয়া নিষেধ।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ কোন আলেম নামায আদায় ও দুআ করার জন্য কবরের নিকট যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। কেননা এ জন্য কবরের নিকট যাওয়া কবরকে এক প্রকার ঈদ বানানোর মতই। এতে আরও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যখন কোনো ব্যক্তি নামাযের জন্য মসজিদে নববীতে প্রবেশ করবে, তখন সালাম দেয়ার নিয়তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের নিকট যাওয়া নিষিদ্ধ। কেননা এটি বৈধ হওয়ার কোন দলীল পাওয়া যায়না।

ইমাম মালেক (রঃ) মদীনাবাসীদের জন্য অপছন্দ করতেন যে, তাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে যাবে। কেননা সালাফে সালেহীনগণ এরূপ করতেন না। তিনি আরো বলেনঃ এই উম্মতের আখেরী যামানার লোকদেরকে ঐ বিষয়ই সংশোধন করতে পারে, যা তাদের প্রথম যামানার লোকদেরকে সংশোধন করেছিল। অর্থাৎ সহীহ সুন্নাতের অনুসরণ ব্যতীত তাদের সংশোধনের কোন সুযোগ নেই।

সাহাবী এবং তাবেয়ীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মসজিদে আগমণ করতেন এবং নামায আদায় করতেন। নামায আদায় করে তারা মসজিদে বসতেন অথবা বের হয়ে যেতেন। কিন্তু সালাম দেয়ার উদ্দেশ্যে কবরের নিকট যেতেন না।[3] কেননা তারা জানতেন যে, মসজিদে প্রবেশের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরূদ পাঠ করা এবং সালাম দেয়া সুন্নাত।

দুরূদ পাঠ করা, সালাম দেয়া কিংবা নামায আদায় এবং দুআ করার নিয়তে কবরের নিকট যেতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে অনুমতি দেন নি; বরং তা থেকে সাহাবীদেরকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

«لا تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا وَلا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا فَإِنَّ تَسْلِيمَكُمْ يَبْلُغُنِي أَيْنَمَا كُنْتُمْ»

‘‘তোমরা আমার কবরকে ঈদে বা মেলায় পরিণত করোনা আর তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করোনা। তোমরা যেখানেই থাকোনা কেন তোমাদের সালাম আমার কাছে পেŠছে যায়’’। তিনি এতে বর্ণনা করেছেন যে, দূর থেকে সালাম দিলেও তাঁর কাছে সালাত ও সালাম পৌঁছে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সমস্ত লোকদের উপর লা’নত করেছেন, যারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়েছে।

সাহাবীদের যামানায় দরজা দিয়ে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহার হুজরা শরীফে প্রবেশ করা হত। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা জীবিত থাকা অবস্থায় এবং তাঁর মৃতুর পরও এরূপ করা হত। পরবর্তীতে যখন অন্য একটি প্রাচীর দিয়ে হুজরা শরীফকে ঘিরে দেয়া হল, তখনো তাতে দরজা দিয়েই প্রবেশের সুযোগ ছিল। এতসব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দুরূদ পেশ করার জন্য কিংবা তাকে সালাম দেয়ার জন্য, কিংবা নিজেদের জন্য বা অন্যদের জন্য দুআ করার নিয়তে কিংবা কোন হাদীছ বা কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করার জন্য কবরের নিকট যেতেন না। এমন কি শয়তানের জন্যও এ সুযোগ রাখা হয়নি যে, সে সাহাবীদেরকে কোনো কথা শুনাবে অথবা সালাম শুনাবে, যাতে তারা মনে করতে পারেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তাদের সাথে কথা বলছেন, তাদেরকে ফতোয়া দিচ্ছেন কিংবা তাদের জন্য হাদীছ বর্ণনা করছেন। শয়তানের জন্য এ সুযোগও রাখা হয়নি যে, সে এমন আওয়াজে সালামের জবাব দিবে, যাতে বাহির থেকে তা শুনা যায়। কিন্তু শয়তান সাহাবীগণ ব্যতীত অন্যদের ক্ষেত্রে সুযোগ পেয়ে গেছে। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে এবং অন্যদের কবরের পাশেও মুসলিমদেরকে গোমরাহ করেছে। কবরের পাশে শয়তান আওয়াজ করেছে। সেই আওয়াজ শুনে শ্রবণকারীগণ ধারণা করেছে যে, কবরবাসীই তাদেরকে হুকুম করছে, নিষেধ করছে এবং বাহ্যিকভাবেই তাদের সাথে কথা বলছে। শয়তান তাদেরকে আরো ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তি কবর থেকে বের হয় এবং লোকেরা তাকে বের হতে দেখে। লোকেরা আরো ধারণা করে যে, মৃতরা স্বশরীরে কবর থেকে বের হয় এবং লোকদের সাথে কথা বলে। এমনকি মৃতদের দেহের সাথে তাদের রূহগুলোও দেখা যায়।

মোট কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে উপস্থিত হয়ে সালাত ও সালাম পেশ করা সাহাবীদের অভ্যাস ছিলনা। যেমনটি করে থাকে সাহাবীদের পরের যুগের মুসলিমরা।

সাঈদ বিন মানসুর কিতাবুস সুনানে সুহাইল বিন আবী সুহাইল থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সুহাইল বলেনঃ একদা হাসান বিন হাসান বিন আলী বিন আবু তালিব আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে দেখতে পেয়ে ডাক দিলেন। সে সময় তিনি ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহার ঘরে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি বললেনঃ এদিকে এসো এবং খাবার গ্রহণ কর। সুহাইল বলেনঃ আমি বললামঃ আমার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। হাসান তখন বললেনঃ ব্যাপার কি? আমি তোমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের পাশে দেখলাম কেন? সুহাইল বলেনঃ আমি তাঁকে সালাম দিয়েছি। হাসান বললেনঃ যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন সালাম দিবে। অতঃপর তিনি বললেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«لَا تَتخذوا قَبْرِى عِيدًا ولاَ تَتخذوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَصَلُّوا عَلَىَّ فَإِنَّ صَلاَتَكُمْ تَبْلُغُنِى حَيْثُ كُنْتُم لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وانصارى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ»

‘‘তোমরা আমার কবরকে ঈদ বা উরসের স্থান বানিওনা। আর তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করোনা। আমার উপর দুরূদ পাঠ করো। কেননা তোমরা যেখান থেকেই আমার উপর দুরূদ পাঠাও না কেন, তোমাদের দুরূদ আমার নিকট পৌঁছে থাকে। ইহুদী-খৃষ্টানদের উপর আল্লাহর লা’নত। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছে। বর্ণনাকারী আরো বলেনঃ তোমরা এবং আন্দালুসিয়ায় বসবাসকারী মুসলিমগণ একই রকম।[4] অর্থাৎ মদীনা থেকে সালাত ও সালাম পেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যেভাবে পৌঁছে, পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকে সালাম ও সালাত পেশ করলে একইভাবে পৌঁছে।

ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, হাসান বিন হাসান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। তিনি আরো কয়েক দিক থেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তথাপিও তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের কাছে দুআ করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং কবরের কাছে এসে তাঁকে সালাম দেয়া এবং কবরের নিকটবর্তী হয়ে দুআ করার মাধ্যমে দুআ কবুলের আশা করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এই উম্মতের জন্য বৈধ করেন নি। কবরের কাছে গিয়ে দুআ করা যদি শরীয়ত সম্মত হত, তাহলে খোলাফায়ে রাশেদীন, প্রথম সারির আনসার ও মুহাজিরগণ, উত্তমভাবে তাদের অনুসারী আহলে বাইতের সরদার এবং তাবেয়ীদের ইমামগণ এ কাজকে কখনই বর্জন করতেন না এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের নিকটবর্তী হয়ে দুআকারীদের প্রতিবাদও করতেন না।

উপরোক্ত ব্যক্তিদের কথা দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীছ, এ অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছ এবং আরও অনেক হাদীছ এ কথারই প্রমাণ বহন করে। দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য কী ছিল? সালাফগণ তা ভাল করেই জানতেন। যারা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছে এবং মুমিনদের পথ বাদ দিয়ে অন্য পথ অবলম্বন করেছে, তাদের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আশঙ্কা সম্পর্কেও সালাফগণ অবগত ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا

‘‘যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলিমদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব, যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান’’। (সূরা নিসাঃ ১১৫)

এই উম্মতের মধ্যে যখন কবরবাসীদেরকে কেন্দ্র করে শির্কের সূচনা হল, কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি করা হল এবং কবরের এবাদত শুরু হল তখন দুআ করার নিয়তে এবং কবরবাসীদের কাছে ফরিয়াদ করার জন্য কবরের দিকে ভ্রমণ শুরু হল। শুধু তাই নয়; বর্তমানে কবরবাসীদের নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে কবর ও মাযারের খাদেমদের জন্য সর্বোত্তম মাল খরচ করা হচ্ছে।

হায় আফসোস! এ ভয়াবহ মসীবতের জন্য। আমরা আল্লাহর কাছে এ ভয়াবহ শির্ক থেকে মুক্তি চাই এবং ঐ সমস্ত পথ ও মাধ্যম থেকেও আশ্রয় চাই, যা শির্কের নিকটবর্তী করে দেয় অথবা শির্ক পর্যন্ত নিয়ে যায়। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) সূরা তাওবার لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ আয়াতের তাফসীর জানা গেল।

২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় উম্মতকে কবর পূজা ও শির্ক থেকে বহুদূরে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করেছেন।

৩) আমাদের হেদায়াতের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগ্রহ, আমাদের প্রতি তাঁর দয়া ও করুণার কথা জানা গেল।

৪) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কবর যিয়ারত উত্তম নেক কাজ হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ পদ্ধতিতে তাঁর কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ যিয়ারতের জন্য বারবার তাঁর কবরের নিকটবর্তী হতে এবং দূর দেশ হতে ভ্রমণ করে কবরের নিকটে এসে দুআ করতে নিষেধ করেছেন।

৫) তিনি বারবার যিয়ারত নিষিদ্ধ করেছেন।

৬) ঘরে নফল নামায আদায় করার জন্য তিনি উৎসাহ দিয়েছেন।

৭) সালাফে সালেহীনের নিকট এ কথাটি জানা ছিল যে, কবরস্থানে নামাজ পড়া যাবেনা।

৮) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কবরস্থানে নামায কিংবা দুরূদ না পড়ার কারণ হচ্ছে, দূর থেকে তাঁর উপর পঠিত দুরূদ ও সালাম পড়লেও তাঁর কাছে পৌঁছানো হয়। তাই নৈকট্য লাভের আশায় কবরস্থানে দুরূদ পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

৯) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর জগতে রয়েছেন। তাঁর উম্মত যেসমস্ত আমল করে তা থেকে দুরূদ ও সালাম তাঁর কাছে পেশ করা হয়।

[1] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কবর যিয়ারত।

[2] - অর্থাৎ অন্যান্য হাদীছ দ্বারা হাদীছটি সমর্থিত হয়েছে।

[3] - এই নিষেধাজ্ঞা মদীনার বাইরে থেকে আগত মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য নয়। হজ্জ বা উমরার জন্য যে সমস্ত মুসলিম পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মক্কায় আগমণ করেন, তাদের জন্য যদি মসজিদে নববীতে নাযায আদায়ের নিয়তে আগমণ করা সম্ভব হয়, তাহলে তা করা মুস্তাহাব। সেই সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কবর শরীফ যিয়ারত করা এবং তাঁর উপর দুরূদ ও সালাম পেশ করাও মুস্তাহাব।

মোট কথা সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কবরের কাছে গিয়ে তাঁর উপর সালাত ও সালাম পেশ করায় অভ্যস্থ ছিলেন না। যেমন করে থাকে সাহাবীদের পরের যুগের লোকেরা। তবে সাহাবীদের কেউ কেউ যখন সফর থেকে ফেরত আসতেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কবরের কাছে গিয়ে সালাম দিতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) এরূপই করতেন। উবাইদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নাফে থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) যখন সফর থেকে আগমণ করতেন তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কবরের কাছে যেতেন এবং তাঁর উপর সালাম পেশ করতেন। তিনি বলতেনঃ » السَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ السَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا أَبَا بَكْرٍ السَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا أَبَتَاهُ « অতঃপর চলে আসতেন। ইমাম বায়হাকী (রঃ) এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ) সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ ফযলুস সালাতি আলান নবী, হাদীছ নং-১০০। উবাইদুল্লাহ আরো বলেনঃ ইবনে উমার ব্যতীত আর কেউ এমন করতেন বলে আমরা জানিনা। তিনি যখন সালাম দিতেন তখন কবরের পাশে দুআ করার জন্য দাঁড়াতেন না। যেমন করে থাকে অনেক লোক। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ কোন সাহাবী থেকে কবরের পাশে দুআ করার কথা বর্ণিত হয়নি। সুতরাং এরূপ করা বিদআত ছাড়া আর কিছুই নয়। ইমাম মালেক (রঃ) বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কবরের পাশে দাঁড়ানো বৈধ মনে করিনা। তবে সালাম দিবে এবং চলে আসবে। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[4] - এই হাদীছটি যঈফ ও মুরসাল। তবে হাদীছের অধিকাংশ বাক্য অন্যান্য সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।