কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা চতুর্দশ অধ্যায় - স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে আদবসমূহ ইসলামহাউজ.কম
স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে আদবসমূহ

মুসলিম ব্যক্তিকে প্রকৃত মুসলিমের গুণে ভূষিত হতে হলে তাকে আল্লাহর কিতাব ও নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র শিক্ষা ও দর্শনের ভিত্তিতে জীবন পরিচালিত করতে হবে; সুতরাং সে কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে জীবনযাপন করবে এবং সে অনুযায়ী তার সকল বিষয়কে রূপায়িত করবে। আর এটা করবে আল্লাহ তা‘আলা’র নির্দেশের কারণেই, তিনি বলেন:

وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ

“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফয়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোনো (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়।”[1] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ

“আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক।”[2] তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ » . (رواه النووي).

“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ইচ্ছা ও খেয়াল-খুশিকে আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুগামী করবে।”[3] তিনি আরও বলেন:

« مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيهِ أمرُنا فَهُوَ رَدٌّ » . (رواه مسلم).

“যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করল, যার ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই, সে কাজটি বাতিল বলে গণ্য হবে।”[4] সুতরাং স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে মুসলিম ব্যক্তি অবশ্যই নিম্নোক্ত আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে, যা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তিনি বলেন:

« الْفِطْرَةُ خَمْسٌ : الاخْتِتَانُ ، وَالاسْتِحْدَادُ ، وَقَصُّ الشَّارِبِ ، وَتَقْلِيمُ الأَظْفَارِ ، وَنَتْفُ الإِبْطِ » . (رواه البخاري) .

“ফিতরাত (মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব) পাঁচটি: খাতনা করা, (নাভীর নীচে) খুর ব্যবহার করা, গোঁফ ছোট করা, নখ কাটা ও বগলের পশম উপড়ে ফেলা।”[5]

আর এসব আদবের বিবরণ নিম্নরূপ:

১. খাৎনা করা: আর খাৎনা হল চামড়ার ঐ অংশ কেটে ফেলা, যা পুরুষাঙ্গের মাথাকে ঢেকে রাখে; আর এ কাজটি শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে সম্পন্ন করা মুস্তাহাব; কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমাতুয যাহরা ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র দুই ছেলে হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র খাৎনার কাজ তাদের জন্মের সপ্তম দিনে সম্পন্ন করেছেন। আর এ খাৎনার কাজটি বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিলম্বিত করে সম্পন্ন করলেও দোষণীয় হবে না; কেননা, আল্লাহর নবী ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম আশি বছর বয়সে খাৎনা করেছেন। আর হাদিসে বর্ণিত আছে, যখন কোনো ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ইসলাম গ্রহণ করত, তখন তিনি তাকে বলতেন:

أَلْقِ عَنْكَ شَعْرَ الْكُفْرِ وَاخْتَتِنْ

“তুমি তোমার কাফির অবস্থার চুলগুলো কেটে ফেলো এবং খাৎনা কর।”[6]

২. গোঁফ কাটা: মুসলিম ব্যক্তি তার গোঁফ কেটে ফেলবে, যা তার ঠোটের উপর ঝুলে পড়বে। আর দাড়িকে লম্বা করবে, যতক্ষণ না তার মুখমণ্ডল পূর্ণ হবে; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

جُزُّوا الشَّوَارِبَ , وَأَرْخُوا اللِّحَى , خَالِفُوا الْمَجُوسَ

“তোমরা গোঁফ কেটে ফেল এবং দাড়ি লম্বা কর; আর (এভাবেই) তোমরা অগ্নি পূজকদের বিরুদ্ধাচরণ কর।”[7] তিনি আরও বলেন:

« خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ , أَحْفُوا الشَّوَارِبَ , وَاعْفُوا اللِّحَى » . (متفق عليه).

“তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করবে, তোমরা গোঁফ ছোট করবে এবং দাড়ি লম্বা রাখবে।”[8] অর্থাৎ দাড়ি বৃদ্ধি কর; সুতরাং এ কারণে দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম; আর সে মাথার কিছু অংশের চুল মুণ্ডন করে বাকি অংশে চুল রেখে দেয়া থেকে বিরত থাকবে; কেননা, আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

« نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْقَزَعِ » . (متفق عليه).

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথার চুলের কিছু অংশ মুণ্ডন করে কিছু অংশে চুল রাখতে নিষেধ করেছেন।”[9]

৩. অনুরূপভাবে সে তার দাড়িতে কালো রঙ করা থেকে বিরত থাকবে; কেননা, যখন আবূ বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র পিতাকে মক্কা বিজয়ের দিন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে আসা হল এবং সে অবস্থায় তার মাথা ছিল ধবধবে সাদা, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« اذْهَبُوا بِهِ إِلَى بَعْضِ نِسَائِهِ فَلْتُغَيِّرْهُ بِشَيْءٍ وَجَنِّبُوهُ السَّوَادَ » . (أخرجه البخاري و مسلم و أحمد).

“তোমরা তাকে কোনো নারীর নিকটে নিয়ে যাও এবং সে যেন কোনো কিছু দিয়ে তার মাথার চুলকে বদলিয়ে দেয়; আর তোমরা কালো রঙ পরিহার কর।”[10] আর মেহেদী ও ‘কাতাম’ নামক উদ্ভিদ দ্বারা খেযাব দেয়া উত্তম।

আর মুসলিম ব্যক্তি যদি তার মাথার চুল লম্বা করে রাখে এবং তা মুণ্ডন না করে, তাহলে তেল দিয়ে ও বিন্যাস করার মাধ্যমে তার যত্ন নিবে; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

مَنْ كَانَ لَهُ شَعْرٌ فَلْيُكْرِمْهُ

“যে ব্যক্তির চুল আছে, সে যেন তার যত্ন করে।”[11]

৪. বগলের পশম উপড়ে ফেলা, সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি তার দুই বগলের পশম উপড়ে ফেলবে; আর যদি বগলের পশম উপড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে তা মুণ্ডন করে ফেলবে অথবা তাতে লোমনাশক ঔষধ বা অনুরূপ কিছু দিয়ে প্রলেপ দিবে, যাতে তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

৫. নখ কাটা, সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি তার নখসমূহ কেটে ফেলবে; আর নখ কাটার ক্ষেত্রে তার জন্য মুস্তাহাব হল ডান হাত দিয়ে শুরু করা, তারপর বাম হাত, তারপর ডান পা, তারপর বাম পা। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ক্ষেত্রে ডান দিক থেকে শুরু করতে পছন্দ করতেন।[12]


মুসলিম ব্যক্তি এসব কিছু করবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ করার নিয়তে, যাতে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করার সাওয়াব অর্জন করতে পারে; কারণ, কর্মের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই বরাদ্দ থাকবে, যা সে নিয়ত করে।

>
[1] সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৬

[2] সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭

[3] ইমাম নববী রহ. হাদিসটি তাঁর আল-আরবা‘উন ( الأربعون ) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বলেন: হাদিসটি ‘হাসান সহীহ’।

[4] মুসলিম, হাদিস নং- ৪৫৯০

[5] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

[6] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৩৫৬

[7] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৬০

[8] বুখারী ও মুসলিম।

[9] বুখারী ও মুসলিম।

[10] বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ।

[11] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪১৬৫

[12] বুখারী ও মুসলিম।