যাকাত বিধানের সারসংক্ষেপ যাকাত সংক্রান্ত কয়েকটি মাসআলা ইসলামহাউজ.কম
যাকাত সংক্রান্ত কয়েকটি মাসআলা - ২

৮. মূল সম্পদ থেকে পৃথক করার পর যাকাত ধ্বংস হলে করণীয় কি?

যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর মূল সম্পদ থেকে পৃথক করা রাখা হয়, অতঃপর তা ধ্বংস বা চুরি হয়, যদিও তা হয় যাকাত বণ্টনের জন্য নিয়ে সাওয়ার পথে, পুনরায় তাকে যাকাত দিবে হবে, কারণ তার জিম্মায় যাকাত বাকি আছে। এটি আলিমদের বিশুদ্ধ মত। ইবন হাযম জাহিরির মাযহাবও এটি। তিনি বলেছেন: “কারণ, যাকাত তার জিম্মায় রয়ে গেছে, আল্লাহ যাকে যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তার নিকট সে পৌঁছে দিবে”।

৯. যাকাত দ্বারা যদি ফকীরদের প্রয়োজন পূরণ না হয়, তাদেরকে নফল সদকা দেওয়া ধনীদের ওপর ওয়াজিব, যেমন খাদ্য-শস্য, পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থান ইত্যাদি। এ কথার সপক্ষে ইবন হাযম রহ. একাধিক দলীল পেশ করেছেন[1], যথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أطعِمُوا الجائع، وَعُدُوا المريض، وفكوا العاني (أي: الأسير)».

“তোমরা ক্ষুধার্তকে খাবার দাও, রোগীকে দেখতে যাও এবং বন্দীকে মুক্ত কর”।[2]

১০. কারও ওপর যাকাত ফরয, সে যদি যাকাত না দিয়ে মারা যায়, মিরাস বণ্টন করার পূর্বে তার যাকাত দেওয়া জরুরি, ঋণের মতো ওসিয়তের আগে যাকাত আদায় করবে।

১১. নির্দিষ্ট সময় থেকে যাকাত বিলম্ব করার বিধান: যাকাত ওয়াজিব হওয়ার সাথে-সাথেই যাকাত আদায় করার নিয়ম, তবে কোনো ওজর-অপারগতা অথবা ক্ষতির আশঙ্কা হলে বিলম্ব করা বৈধ। ওজরের উদাহরণ, যেমন সম্পদ কাছে নেই তাই যাকাত দিতে পারেনি। ক্ষতির উদাহরণ, যেমন ফকীরদের ভেতর অনেক চোর আছে, যদি তারা টের পায় তিনি যাকাত দিবেন, তারা জেনে যাবে তিনি বিত্তশালী, তাই যে কোনো মুহূর্তে তার ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

আরেকটি বিষয়: কোনও উপকারের স্বার্থে যাকাত দেরিতে দেওয়া বৈধ, যদি ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে। শাইখ ইবন উসাইমীন রহ. বলেছেন: “উপকারের স্বার্থে বিলম্বে যাকাত দেওয়া বৈধ, তবে মূল সম্পদ থেকে পৃথক স্থানে বা কোথাও লিখে রাখা জরুরি। যেমন, ‘এই যাকাত ওয়াজিব হয়েছে রমযানে গরীবদের স্বার্থে শীতকালের অপেক্ষা করছি’ এরূপ লিখে রাখা। অর্থাৎ তার যাকাত হচ্ছে শীত নিবারণের পোশাক, যা শীতকালে বণ্টন করাই শ্রেয়। এরপর যদি যাকাত না দিয়ে মারা যায় ওয়ারিশদের বিষয়টি জানা থাকবে”।[3]

১২. সম্পদ নিসাব পরিমাণ হলে বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যাকাত দেওয়া বৈধ, বিশেষভাবে যদি তাতে গরীবদের উপকার হয়। যেমন, জানা গেল যাকাতের জনৈক হকদার অর্থাৎ আট প্রকার থেকে কেউ হঠাৎ সমস্যার সম্মুখীন বা অর্থের মুখাপেক্ষী, তাকে সময় হওয়ার আগে যাকাত দেওয়া বৈধ। আর যদি যাকাত দানকারী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়, তবে এই আশায় যাকাত দিল যে, ভবিষ্যতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার এই দান সাধারণ সদকা হবে, যাকাত হবে না।

উল্লেখ্য, আমরা মনে করি, কেউ আছেন যিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক, যার মূল্য ৬০ হাজার টাকা, অতঃপর সে পাঁচ বছর যাকাত থেকে বিরত থাকল। তবে এই পাঁচ বছর তার সম্পদ যাকাতের নিসাব থেকে কমেনি। এমতাবস্থায় বিশুদ্ধ মতে সে এক বছরের যাকাতের পরিমাণকে পাঁচ দিয়ে গুণ দিয়ে পাঁচ বছরের যাকাত একসাথে পরিশোধ করবে, যেমন এক বছরের যাকাত ৬০,০০০*২.৫%= ১৫০০ টাকা, পাঁচ বছরের যাকাত হবে ১৫০০*৫= ৭৫০০ টাকা। একসঙ্গে এই যাকাত দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে ধীরে ধীরে দিবে।

১৩. আয়াতে উল্লিখিত আটটি খাতেই যাকাত দেওয়া উত্তম, তবে কেউ যদি এক খাতে যাকাত দেয় তাতেও সমস্যা নেই। অধিকাংশ আলিম বলেছেন এ কথা, এটিই সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ।

১৪. যাকাত নিজে বণ্টন করা বা বণ্টন করার দায়িত্ব অপরকে দেওয়া উভয়ই বৈধ, তবে ইবাদতের সাওয়াব হাসিল করার জন্য নিজের যাকাত নিজে বণ্টন করাই উত্তম, যেন সঠিক স্থানে আদায় করার নিশ্চিয়তা হাসিল হয়। বিশেষভাবে তার পক্ষে যাকাত আদায়কারী প্রতিনিধি সম্পর্কে যদি সম্যক ধারণা না থাকে। অনুরূপ একই হুকুম রাখে যদি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নিকট কুরবানি করার শর্তে টাকা জমা দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে নিজের কুরবানি নিজে দেওয়াই উত্তম, তবেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা হাসিল হয়।

১৫. যাকাত বের করার সময় অন্তরে নিয়ত করা ওয়াজিব:

নিজের সম্পদ থেকে যাকাত বের করার নিয়ত করবে, সে নিজে বের করুক বা তার উকিল বের করুক। যদি তার যাকাত এমন কেউ বের করে, যাকে সে প্রতিনিধি করে নি, তবে যাকাত বের করার পর তার কর্মকে বৈধতা দেয়, এই অবস্থায় যাকাত আদায় হবে, না পুনরায় আদায় করবে?

এতে আলিমদের দু’টি মত রয়েছে: বিশুদ্ধ মতে যাকাত আদায় হবে, তবে আদায় না হওয়ার মতের মধ্যে সতর্কতা বেশি।[4]

১৬. আলিমদের বিশুদ্ধ মতে দেশের বাইরের গরীবদের জন্য যাকাত প্রেরণ করা বৈধ, বিশেষভাবে যদি তার ধারণা হয় তার নিজের দেশের গরীব অপেক্ষা বাইরের গরীবরা যাকাত দ্বারা বেশি উপকৃত হবে। যেমন, তারা বেশি গরীব অথবা তার আত্মীয়দের থেকে বেশি গরীব অথবা তাদের যাকাত দিলে নেকি বেশি হবে, যেমন তারা ইলম হাসিল করবে। যদি অপর দেশে যাকাত প্রেরণ করায় বিশেষ ফায়দা না থাকে কাছের লোকদের দেওয়াই উত্তম। কারণ, তাদের হককে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি পূরণ হয়। দ্বিতীয়ত যাকাত অন্য জায়গায় প্রেরণ করা অপেক্ষা নিজের দেশে দেওয়া অতি সহজ ও নিরাপদ, অধিকন্তু তার যাকাতের সাথে প্রতিবেশী গরীবদের অন্তর সম্পৃক্ত, বিশেষভাবে যদি যাকাত প্রকাশ্য হয়, অতএব, তারা যাকাত পেলে তাদের মহব্বত বৃদ্ধি পাবে ও তাদের অন্তর আকৃষ্ট হবে।

উল্লেখ্য যে, যাকাত স্থানান্তর করার খরচ যাকাত থেকে দেওয়া যাবে না, বরং যাকাত দানকারী নিজের পক্ষ থেকে বহন করবে।[5]

১৭. সরকারকে প্রদেয় ফি বা কর, যেমন ট্যাক্স, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল বা অন্যান্য বিল, যেভাবেই পেশ করা হোক, ফরয যাকাত থেকে গণ্য করা যাবে না, বরং এ জাতীয় বিল দেওয়ার পর যে সম্পদ বাকি থাকবে তার যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। এসব বিল বৈধ বা অবৈধ যেভাবে গ্রহণ করা হোক তার প্রভাব যাকাতে পড়বে না।

১৮. প্রয়োজন হলে মুসলিম শাসকগণ গরীবদের জন্য ঋণ নিবেন, অতঃপর যখন যাকাত উসুল করে সেই ঋণ পরিশোধ করবেন। তাদের জন্য এরূপ করা বৈধ।১৯. যাদের ওপর কাফফারা ওয়াজিব, তাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েয, যদি তারা যাকাতের হকদার হয়। অনুরূপ যার ওপর হত্যার দিয়াত ওয়াজিব, যদি হত্যাকারী চিহ্নিত না হয়, তাকেও যাকাত দেওয়া বৈধ।

>
[1] দেখুন: মুহাল্লা: (৬/২২৪)।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৩৭৩।

[3] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/১৮৯)।

[4] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/২০৫)।

[5] আশ-শারহুল মুমতি‘: (৬/২১৩)।