মেহমানের মেহমানদারি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহমানদারি ইসলামহাউজ.কম
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহমানদারি

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক দয়ালু, দানশীল ও আতিথেয়তায় প্রসিদ্ধ। তিনি কোনো কিছুই তার নিজের জন্য ধরে রাখতেন না, যা কিছু তার নিকট আসত, তার সবই তিনি সাথে সাথে দান করে দিতেন এবং সাথীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু যিনি দশ বছর যাবত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি তাঁর দানশীলতা ও দয়াদ্রতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,

«ما سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم على الإسلام شيئًا إلا أعطاه، قال: فجاءه رجل فأعطاه غنمًا بين جبلين فرجع إلى قومه فقال: يا قومي أسلموا فإن محمدًا يعطي عطاءً لا يخشى الفاقة»

“ইসলামের যুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনো কিছু চাওয়া হলে তিনি কখনোই না বলেন নি। যখন কোনো কিছু চাইতেন তা তিনি সাথে সাথে দিয়ে দিতেন। একবার এক ব্যক্তি এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চাইলে তিনি তাকে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ছাগলগুলো তাকে দিয়ে দেন। লোকটি তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট গিয়ে বলল, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকরা! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কারণ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এত বেশি দান করেন, তিনি অভাবকে ভয় করেন না”।[1]

অপর একটি বর্ণনায় বর্ণিত, আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَدَّخِرُ شَيْئًا لِغَدٍ»

“আল্লাহর রাসূল কোনো কিছুই আগামী দিনের জন্য জমা করে রাখতেন না”।[2]

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

«كان أجود الناس بالخير، وأجود ما يكون فى شهر رمضان، وكان إذا لقيه جبريل أجود بالخير من الريح المرسلة».

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বাধিক দানশীল। আর রমযান মাসে তিনি সবচেয়ে বেশি দান করতেন। যখন জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে সাক্ষাত করত, তখন তিনি প্রবল বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হতেন”।[3]

যাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«ماسئل رسول الله صلي الله عليه وسلم شيئا قط فقال: لا»

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনো কিছু চাওয়া হলে, তিনি কখনো না করেন নি”।[4]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার উক্তি আল্লাহর রাসূলের আতিথেয়তা সম্পর্কে যথেষ্ট। তিনি সকল উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী, জগতের শ্রেষ্ঠতম চারজন রমণীর অন্যতম। যিনি তার সকল ধনসম্পদের পাহাড় রাসূলের কদমে হাযির করে দেন। রাসূলের সব ছেলেমেয়ে তার গর্ভে জন্মলাভ করেন। তিনি ২৫ বছর উম্মুল মুমিনীন হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। অহী লাভের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অস্থিরতায় তিনি সান্তনা দেন এবং বলেন, كلاّ واللهِ ما يُخزِيك الله اَبَدََ “আল্লাহর শপথ তিনি আপনাকে কখনই অপমান ও অপদস্থ করবেন না”।[5] তার কারণ হিসেবে তিনি আল্লাহর রাসূলের কয়েকটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করেন। তার মধ্যে অন্যতম গুণ হলো, وتقرى الضيفُ “আপনি অতিথির সেবা করেন”।[6]

কা‘বা শরীফ মক্কায় অবস্থিত বিধায় হাজার হাজার বছর থেকে কা‘বা কেন্দ্রিক বিভিন্ন এলাকা ও জনপদ থেকে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাতো। কুরাইশ পৌত্তলিকেরা বিদেশীদের জীবন সম্পদ লুণ্ঠনের উৎসব করত বিশেষ করে হজ মৌসুমে। যদিও জাতিগত ভাবে আরবরা অতিথিপরায়ণ কিন্তু অসৎদের আর মূল্যবোধের বালাই থাকে না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাল্যকাল থেকে অসহায় বিদেশী ও অতিথিদের সহায় সম্পদ লুণ্ঠনের দৃশ্য দেখে আসছিলেন। তাদের যুলুম নির্যাতন ও লন্ঠনের দৃশ্য দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তিনি তাদের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অসহায় মযলুম নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ান, তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। দেশ থেকে অশান্তি দূর করা, বিদেশী মেহমানদের জান-মাল রক্ষা করা, গরীব-দুঃখীকে সাহায্য করা, দুর্বলদেরকে যালিমদের হাত থেকে রক্ষা করা এবং আমরা বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টায় তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর। একজন স্ত্রীর মন্তব্য তার স্বীয় স্বামীর ব্যাপারে খুবই প্রণিধানযোগ্য। কারণ, সুখে-দুঃখে, দিনে-রাতে সকালে-বিকেলে, রাগ-বিরাগ সর্বাবস্থায় নিবিড়ভাবে স্বামীকে দেখার সুযোগ তিনিই লাভ করেন। তারপরও সবার প্রশংসার চেয়ে খাদিজার উক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি স্ত্রীও হন অতীব বিচক্ষণ, সচেতন ও জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন তবে তো কথাই নেই। এ ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য সাহাবীদের বাণীও প্রণিধানযোগ্য।

মেহমানদারির সম্পর্কে ঈমানের সাথে। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া ও অনুগ্রহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মেহমানদের মেহমানদারি করা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، فَلَا يُؤْذِ جَارَهُ، مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস করে, সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস করে, সে যেন মেহমানের মেহমানদারি করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে”।[7]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

«لا تزال الملائكة تصلى على أحدكم ما دامت مائدته موضوعة بين يديه حتى يرفع».

“মেহমানের সামনে যতক্ষণ দস্তরখান বিছানো থাকে, তা না উঠানো পর্যন্ত ফিরিশতারা তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করতে থাকে”।[8] বর্তমানে আমরা মেহমানদের মেহমানদারী করতে চাইনা। মেহমানকে আমরা ভয় পাই, ঝামেলা মনে করি। অথচ একজন সত্যিকার মুসলিমের নিকট মেহমানদারি করা খুব প্রিয় এবং সম্মানজনক কাজ। মেহমানদারি করার বিষয়টি একজন মুসলিমের ঈমানের সাথে সম্পর্কিত। এটা একজন মুমিনের ঈমানের পরিপূর্ণতাকে বহন করে। মেহমানের মেহমানদারি করা এবং তাদের সম্মান করা পূর্বের নবী রাসূলদের মধ্যেও ছিল। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের যুগ থেকে এর ধারাবাহিকতা শুরু হয়।

>
[1] সহীহ সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ফাযায়েল, হাদীস নং ২৩১৫।

[2] তিরমিযী, হাদীস নং ২৩৬২। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩০৮।

[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩১১।

[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩, ৪৯৫৭, ৪৯৫৩, ৩৩৯২।

[6] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩, ৪৯৫৭, ৪৯৫৩, ৩৩৯২।

[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৭।

[8] তাবরানী, মুজামুল আওসাত, হাদীস নং ৪৭২৯।