ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
নবী-রাসূলগণের দা‘ওয়াতী মূলনীতি ৫। আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতের বিধি-বিধান (أحكام الدعوة إلى الله) মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত-তুওয়াইজিরী
ঘ. আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দানের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য (تقرير وجوب الدعوة إلى الله)

১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا ِمنَ الْمُشْرِكِينَ (108)) [يوسف: 108]

‘বলুন, ইহাই আমার পথ, আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে। আল্লাহ পবিত্র এবং আমি শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সূরা ইউসুফ: ১০৮)।

আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী ব্যাপক অর্থবোধক যা স্থান-কাল পাত্রভেদে সবসময় প্রযোজ্য এবং আরব-অনারব, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, জাতি-বর্ণ, মালিক-ভৃত্য এবং ধনী-গরিব সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(هَذَا بَلَاغٌ لِلنَّاسِ وَلِيُنْذَرُوا بِهِ وَلِيَعْلَمُوا أَنَّمَا هُوَ إِلَهٌ وَاحِدٌ وَلِيَذَّكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ (52)) [إبراهيم: 52]

‘ইহা মানুষের জন্য পয়গাম। আর যা দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয় এবং তারা জানতে পারে যে, তিনি কেবল এক ইলাহ, আর যাতে বুদ্ধিমানরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (সূরা ইব্রাহীম: ৫২)।

অতএব, সকল মানুষের জন্য দা‘ওয়াত দান ওয়াজিব। কেননা, দ্বীন ইসলাম সকল মানুষের জন্য। তাই মুসলিম হওয়ার পর মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মত ও অনুসারী গণ্য হওয়ায় তাদেরদা‘ওয়াতী কাজ করা আবশ্যক।

৩। প্রত্যেকের উপর দায়িত্ব হলো তার যোগ্যতা অনুযায়ী দ্বীন প্রচার করা। আর দা‘ওয়াত দানের সর্বনিম্ন যোগ্যতা হলো একটি আয়াত অথবা একটি সুন্নাহ বা হাদীছ জানা। এরূপ যে জানবে, তার উপর আবশ্যক হলো তা পৌঁছে দেয়া।

৪। মুসলিম দু’প্রকার:

(ক) আলেম, যিনি নিজ উদ্যোগে হক্ব-দ্বীন প্রচার করেন এবং মানুষকে তার অনুসরণ করার জন্য আহবান করেন। যেমনটি মুমিন ফির‘আউনের দলবলের মুমিন ব্যক্তি বলেছিলেন:

(وَقَالَ الَّذِي آمَنَ يَاقَوْمِ اتَّبِعُونِ أَهْدِكُمْ سَبِيلَ الرَّشَادِ (38) يَاقَوْمِ إِنَّمَاهَذِهِ الْحَيَاةُالدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ (39)) [غافر: 38 - 39]

‘আর যে ব্যক্তি ঈমান এনেছিল, সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমার আনুগত্য কর; আমি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাব। (৩৮) ‘হে আমার সম্প্রদায়! এ দুনিয়ার জীবন কেবল ক্ষণকালের ভোগ; আর নিশ্চয় আখেরাতই হল স্থায়ী আবাস’ (সূরা গফির:৩৮-৩৯)।

(খ) মুসলিম কিন্তু আলেম নন: তিনি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও আলেমগণের অনুসরণ করার জন্য আহবান করবেন। যেমন- মহান আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীনে জনৈক দাঈ সম্পর্কে বলেন:

(وَجَاءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَاقَوْمِ اتَّبِعُوا الْمُرْسَلِينَ (20) اتَّبِعُوا مَنْ لَا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُمْ مُهْتَدُونَ (21)) [يس:20 - 21].

‘আর শহরের দূরপ্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি দৌঁড়ে এসে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসূলগণের অনুসরণ কর। (২০) তোমরা তাদের অনুসরণ কর, যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায় না আর তারা সৎপথপ্রাপ্ত’ (সূরা ইয়াসীন: ২০-২১)।

সুতরাং প্রত্যেকের উচিত, দা‘ওয়াতী কাজ করা। আলেমগণ হক্বের দিকে দা‘ওয়াত দিবেন। আর যারা আলেম নন, তারা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সেসব আলেমের অনুসরণের দিকে আহবান করবেন, যারা আল্লাহ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত।

৫। যোগ্যতা অনুযায়ী আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া প্রত্যেকের উপর ফরয। কেননা, তা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ। ঠিক যেমন ছালাত আদায় করা প্রত্যেকের উপর ফরয। কেননা, সেটিও আল্লাহর নির্দেশ।

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে ইবাদত ও দা‘ওয়াত উভয়ই মুসলিম জাতির সকলের উপর ফরয ছিল। অতঃপর আল্লাহর ইবাদত সকল মুসলিমের উপর ফরযগণ্য করা হলেও শুধুমাত্র কতিপয় মুসলিমের উপর দা‘ওয়াতী কাজ করা ফরয বলে গণ্য করা হয়। ফলে, খোদ ইবাদতই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মানুষ দ্বীন থেকে বের হতে শুরু করে। আর এই উম্মতের শেষের দিকের মানুষকে ঠিক করতে পারে শুধুমাত্র সেই বিষয়, যা দ্বারা উম্মতের প্রথম দিকের মানুষ ঠিক হয়েছিল।

সুতরাং ইবাদত ও দা‘ওয়াতী কাজ উভয়ই এ উম্মতের প্রত্যেকের উপর ফরযে আইন।

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (77)) [الحج: 77]

‘হে মুমিনগণ! তোমরা রুকূ‘ কর, সিজদা কর, তোমাদের রবের ইবাদত কর এবং ভাল কাজ কর, আশা করা যায় তোমরা সফল হতে পারবে’ (সূরা আল-হাজ্জ: ৭৭)।

(২) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ

‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রব-ই জানেন কে তাঁর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হেদায়াত প্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন’ (সূরা আন-নাহল: ১২৫)।

৬। উম্মতের প্রত্যেকের উপর কর্তব্য আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া এবং তা প্রত্যেকের পালন করা প্রয়োজন। দা‘ওয়াত দানের মাধ্যমে হেদায়াত লাভ হয়, ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং মুমিনদের সংখ্যা বেড়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ ) [العنكبوت: 69]

‘আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন’ (সূরা আল-আনকাবূত: ৬৯)।

৭। দা‘ওয়াতী কাজ করা, ইবাদত করা, চরিত্রবান হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলিমকে সর্বাবস্থায় রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا (21)) ... [الأحزاب: 21]

‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহর অনেক যিকর করে’ (সূরা আল-আহযাব: ২১)।

(২) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

(قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِوَالْأَرْضِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ (158)) [الأعراف: 158].

‘বল, ‘হে মানুষ!আমি তোমাদের সবার নিকট আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ও তাঁর প্রেরিত নিরক্ষর নবীর প্রতি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর বাণী সমূহের প্রতি ঈমান রাখেন। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হেদায়াত লাভ করবে’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৫৮)।

৮। বিভিন্ন জাতির মধ্যে থেকে আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতকে বাছাই করেছেন এবং তাদেরকে নবীগণের মুকুট পরিয়েছেন। আর তা হলো, আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেয়া, সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ

‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত। তাদের কতক ঈমানদার। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক’ (সূরা আলে ইমরান: ১১০)।

৯। ঈমান ও বিধি-বিধান নাযিল হওয়ার মধ্যে সময়ের দূরত্ব আছে। কিন্তু ঈমান ও দা‘ওয়াতী কাজের মাঝে কোন সময়ের দূরত্ব নেই। কেননা, নবীগণের মতই দা‘ওয়াতী কাজের জন্য এ জাতি প্রেরিত হয়েছে।

প্রথম সারির ছাহাবীগণ শুরু থেকেই দা‘ওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেক নবীই তার উম্মতকে প্রথমে ঈমান শিক্ষা দিতেন, অতঃপর বিধি-বিধান শিখাতেন।

আর মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে আল্লাহ তা‘আলা তার উম্মতকে প্রথমে ঈমান শিক্ষা দেয়ার, তারপর দা‘ওয়াতী কাজ করার, তারপর বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যা মদীনায় অবতীর্ণ হয়। কেননা, নবীগণের আদর্শের উপর এ মুসলিম জাতি প্রেরিত হয়েছে।

১০। আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর সর্বত্র হক্ব প্রচারের জন্য আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। যেমন আলোকিত করার জন্য সূর্য, বৃষ্টি বর্ষণের জন্য মেঘমালা এবং উদ্ভিদ উৎপন্ন করার জন্য যমীনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আর এ তিনটিই তাদের আমানত যথারীতি রক্ষা করে চলেছে। সেজন্যই, সৃষ্টির দুনিয়াবী যিন্দেগী ঠিকমত চলছে। আমরাও যদি মানবতার নিকট আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতের আমানত পৌঁছে দেই, তাহলে তাদের ইহকাল ও পরকাল সুন্দর হবে।

আলো, পানি ও উদ্ভিদ যেমন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য, তেমনি হক্ব, কুরআন ও ইসলামও সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য। মহান আল্লাহ বলেন:

(هَذَا بَلَاغٌ لِلنَّاسِ وَلِيُنْذَرُوا بِهِ وَلِيَعْلَمُوا أَنَّمَا هُوَ إِلَهٌ وَاحِدٌ وَلِيَذَّكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ (52)) [إبراهيم: 52]

‘ইহা মানুষের জন্য পয়গাম। আর যা দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয় এবং তারা জানতে পারে যে, তিনি কেবল এক ইলাহ, আর যাতে বুদ্ধিমানরা উপদেশ গ্রহণ করে’(সূরা ইব্রাহীম:৫২)।