ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় - বেলায়াত ও যিকর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
জ. মাসনূন যিকরের শ্রেণীবিভাগ - ৭. দু‘আ বা প্রার্থনা বিষয়ক বাক্যাদি - (খ) দু‘আর সুন্নাত-সম্মত নিয়ম ও আদব - তৃতীয় ভাগ

১১. সকল বিষয় শুধু আল্লাহর নিকটেই চাওয়া

প্রার্থনা দুই প্রকার : লৌকিক ও অলৌকিক

প্রার্থনা বা চাওয়ার বিষয়বস্তু দুই প্রকারের হতে পারে। এক প্রকার লৌকিক বা জাগতিক সাহায্য-সহযোগিতা যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে করতে পারে। এ সকল বিষয় প্রকৃতিগতভাবে একজন মানুষ আরেকজনের নিকট চেয়ে থাকে এবং মানুষ জাগতিকভাবে তা প্রদান করতে পারে। যেমন, কারো কাছে টাকাপয়সা চাওয়া, সাহায্য চাওয়া, পানিতে পড়ে গেলে উঠানোর জন্য সাহায্য চাওয়া, মাথার বোঝা পড়ে গেলে উঠাতে সাহায্য চাওয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি অগণিত। জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস নির্বিশেষে সকলেই এ ধরনের সাহায্য প্রার্থনা করে।


দ্বিতীয় প্রকার প্রার্থনা অলৌকিক বা অপার্থিব। জাগতিক মাধ্যম ও উপকরণ ছাড়া অলৌকিক সাহায্য, ত্রাণ ইত্যাদি প্রার্থনা করা। এ জাতীয় প্রার্থনা শুধুমাত্র কোনো “ধর্মের অনুসারী” বা “বিশ্বাসী” করেন। “বিশ্বাসী” শুধুমাত্র আল্লাহ, ঈশ্বর বা সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করেন, অথবা যার সাথে ‘ইশ্বরের’ বিশেষ সম্পর্ক ও যার মধ্যে ‘ঐশ্বরিক’ ক্ষমতা আছে, তার কাছেই প্রার্থনা করেন।


এই দ্বিতীয় প্রকারের প্রার্থনা আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে করার অর্থ - আল্লাহ ছাড়া কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করা। কারণ, এতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে আল্লাহর গুণাবলী (অলৌকি সাহায্য, ক্ষমতা, ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক শক্তি) কল্পনা করা হয়। আর আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুকে কোনো গুণ, ক্ষমতা বা কর্মে আল্লাহর মতো মনে করা বা কারো মধ্যে আল্লাহর গুণাবলী আরোপ করাই শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা, নবী, ওলী, মানুষ, প্রাকৃতিক বিষয়ের মধ্যে কোনো অলৌকিক বা অপার্থিব কল্যাণ বা অকল্যাণের বিশ্বাসই সকল প্রকার শিরকের মূল। এজন্য কুরআন কারীমে মুশরিকদের শিরকের প্রতিবাদ করতে যেয়ে বিভিন্ন স্থানে বারংবার, প্রায় ১৫/১৬ স্থানে, ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনো প্রকার মঙ্গল, অমঙ্গল, কল্যাণ, অকল্যাণ, ক্ষতি বা উপকার করার কোনোরূপ ক্ষমতা নেই বা আল্লাহ কাউকে কোনোরূপ ক্ষমতা প্রদান করেননি।

বস্তুত, মুশরিকগণের দাবি ছিল যে, আল্লাহ এ সকল সৃষ্টিকে ভালবেসে এদেরকে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেছেন। তাদের কাছে প্রার্থনা করলে তারা আল্লাহর দেওয়া ক্ষমতাবলে বা আল্লাহর নিকট থেকে প্রার্থনা করে ভক্তদের মনবাঞ্চনা পূরণ করতে পারেন। তারা বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা বা কারামত ও মু‘জিযাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করত। এখানে ঈসা (আ.)-এর বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের পূর্ব থেকেই খৃস্টানগণ ঈসা মসীহ বা ‘যীশু খৃস্টের’ মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা দাবি করতে থাকে। তাদের দাবি ছিল, তিনি মৃতকে জীবিত করেছেন, জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করেছেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর মধ্যে কল্যাণ- অকল্যাণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। তারা তাঁর নিকট প্রার্থনা করত, সাহায্য চাইত এবং তার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করত। এছাড়া তাঁর মাতা মরিয়মকেও তারা সেন্ট বা সাধ্বী রমণী হিসেবে ঐশ্বরিক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করত এবং তার কাছে প্রার্থনা করত, তাঁর মূর্তি বা সমাধিতে সাজদা করত এবং তাঁর নামে মানত, উৎসর্গ ইত্যাদি ইবাদত করত।

কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে এই শির্কের প্রতিবাদ করা হয়েছে। মাসীহ বা তাঁর মাতার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা ছিল না বা নেই তা উল্লেখ করা হয়েছে। এক স্থানে ইরশাদ করা হয়েছেঃ “মরিয়ম-তনয় মসীহ তো কেবল একজন রাসূল; তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে এবং তার মাতা সত্যনিষ্ঠ ছিল। তাহারা উভয়ে খাদ্যাহার করত। দেখ, তাদের জন্য আয়াত কিরূপ বিশদভাবে বর্ণনা করি! আরো

দেখ, তারা কিভাবে সত্য-বিমুখ হয়! বল, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ইবাদত কর যার কোনোই ক্ষমতা নেই তোমাদের ক্ষতি বা উপকার করার?”[1]

লৌকিক প্রার্থনা লোকের কাছে চাওয়া যায়

প্রথম প্রকার ‘প্রার্থনা’ জাগতিকভাবে যে কোনো মানুষের কাছে করা যায়। এগুলি একান্তই জাগতিক বা লৌকিক সাহায্য সহযোগিতা। কেউ এই জাতীয় সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করা উচিত ও দায়িত্ব। মনে করুন আমার গরুটি পালিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে

কোনো মানুষের আভাস পেয়ে চিৎকার করে বললাম, ভাই, আমার গরুটি একটু ধরে দেবেন! অথবা আমি পথ চিনতে পারছি না, তাই

কোনো মানুষকে দেখে অথবা কোনো বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে মানুষ আছে অনুমান করে চিৎকার করে বলছি, ভাই অমুক স্থানে কোন দিক দিয়ে যাব একটু বলবেন!


এখানে আমি লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করছি। ঐ মানুষের মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব বা ঐশ্বরিক গুণ কল্পনা করছি না। ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিচয়ও আমার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আমি জানি যে, স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ একটি গরু ধরতে পারে বা উক্ত স্থানের একজন বাসিন্দা স্বাভাবিকভাবে পথটি চিনবে বলে আশা করা যায়। এজন্য আমি তার থেকে এই লৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করছি। যদি কোথাও এই প্রকারের জাগতিক সমস্যা হয় এবং সেখানে কোনো মানুষজন না থাকে তাহলে উপস্থিত অদৃশ্য ফিরিশতাগণের নিকটও সাহায্য চাওয়া যায়। মুমিন জানেন যে, আল্লাহর অগণিত ফিরিশতাগণ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন। এছাড়া অদৃশ্য সৃষ্টি জীনেরাও বিভিন্ন স্থানে চলাচল করে। উপরের পরিস্থিতিতে যদি কোনো দৃশ্যমান মানুষকে না দেখে তিনি অদৃশ্য ফিরিশতা বা জ্বিনের কাছে লৌকিক সাহায্য চান তাহলে তা জায়েয হবে। কারণ তিনি কোনো নির্দিষ্ট সৃষ্টির মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা অলৌকিকত্ব কল্পনা করছেন না। তথায় কোন্ ফিরিশতা আছেন বা কোন্ জ্বিন রয়েছেন তাও তিনি জানেন না বা জানা তার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তিনি জানেন যে, এখানে কোনো ফিরিশতা বা জ্বিন থাকতে পারেন। আল্লাহর অন্য কোনো বান্দাকে দেখছি না, কাজেই এখানে উপস্থিত আল্লাহর অদৃশ্য বান্দাদের কাছে একটু সাহায্য চেয়ে দেখি কী হয়। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ

إِنَّ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مَلائِكَةً سِوَى الْحَفَظَةِ يَكْتُبُونَ مَا سَقَطَ مِنْ وَرَقِ الشَّجَرِ فَإِذَا أَصَابَ أَحَدُكُمْ عَرَجَةٌ بِأَرْضٍ فَلاةٍ فَلْيُنَادِ أَعِينُوا عِبَادَ اللَّهِ يَرْحَمْكُمُ اللَّهُ تَعَالَى


“বান্দার সাথে তার সংরক্ষণে নিয়োজিত ফিরিশতাগণ ছাড়াও আল্লাহর অনেক ফিরিশতা আছেন যারা সারা বিশ্বে কোথায় কোন গাছের পাতা পড়ছে তাও লিখেন। যদি তোমাদের কেউ কোনো নির্জন প্রান্তরে আটকে পড়ে বা অচল হয়ে পড়ে তাহলে সে ডেকে বলবেঃ হে আল্লাহর বান্দাগণ তোমরা সাহায্য কর, আল্লাহ তোমাদের রহমত করুন।[2]


অনুপস্থিতের কাছে অলৌকিকভাবে লৌকিক পার্থনা শিরক

এই প্রকার লৌকিক বা জাগতিক সাহায্য প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে যদি কেউ অনুপস্থিত কাউকে ডাকেন বা অনুপস্থিত কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন তাহলে তা শিরক হবে। যেমন, কারো রিকশা উল্টে গেছে বা গাড়িটি খাঁদে পড়েছে, তখন স্বাভাবিক লৌকিক কর্ম যে,

সে কাউকে দেখতে পাক বা না পাক, সে চিৎকার করে সাহায্য চাইবে : কে আছ একটু সাহায্য কর। এখানে সে লৌকিক সাহায্য চাচ্ছে। কিন্তু যদি সে এ সময়ে সেখানে অনুপস্থিত কোন সৃষ্টি, জীবিত বা মৃত মানুষকে ডাকতে থাকে তাহলে সে শিরকে লিপ্ত হবে। কারণ সে মনে করছে, অনুপস্থিত অমুক ব্যক্তি সদা সর্বদা সবত্র বিরাজমান বা সদা সর্বদা সকল স্থানের সবকিছু তার গোচরিভূত। কাজেই, তিনি দূরবর্তী স্থান থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন বা আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন এবং দূর থেকে অলৌকিকভাবে আমার বিপদ কাটিয়ে দেওয়ার মতো “অলৌকিক” ক্ষমতা তার আছে। এভাবে সে একটি নির্দিষ্ট সৃষ্টির মধ্যে অলৌকেকত্ব, ঐশ্বরিক শক্তি বা মহান আল্লাহর গুণাবলী আরোপ করে শিরকে নিপতিত হয়েছে। এছাড়াও সে মহান আল্লাহর ক্ষমতাকে ছোট বলে মনে করেছে।


এই প্রার্থনাকারী বা আহবানকারী ঐ বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে যে ক্ষমতা বা গুণ কল্পনা করেছে তা একান্তভাবেই মহান আল্লাহর জন্য নির্ধারিত গুণাবলী। এই প্রাথনাকারী এই গুণাবলীকে শুধুমাত্র আল্লাহর বলে মনে করে না। সে বিশ্বাস করে যে, এই ক্ষমতার মধ্যে আল্লাহর শরীক আছে। এই ক্ষমতাটি যেমন আল্লাহর আছে, তেমনি অমুক ব্যক্তিরও আছে। তবে সে সম্ভবত তার কল্পনার মানুষটির ক্ষমতাকে এ ক্ষেত্রে আল্লাহর ক্ষমতার চেয়ে বেশি বা দ্রুত বলে বিশ্বাস করে। এজন্যই সে আল্লাহকে না ডেকে তাকে ডেকেছে।

এক্ষেত্রে মুশরিকদের দাবি যে, এসকল বাবা, মা, সান্তা, সেন্ট, ফিরিশতা বা জ্বিনদেরকে আল্লাহই ক্ষমতা প্রদান করেছেন। ক্ষমতা মূলত আল্লাহরই, তিনি এদেরকে কিছু বা সকল ক্ষমতা প্রদান করেছেন। মক্কার কাফিররাও এই দাবি করত বলে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কঠিনভাবে প্রতিবাদ করা হয়েছে।

আমাদের নেককার বা বুজর্গ মানুষদেরকে নিয়ে এজাতীয় অনেক মিথ্যা কাহিনী, কিংবদন্তী বা জনশ্রুতি রয়েছে। সকল মুশরিক সমাজেই এই জাতীয় কিংবদন্তী আছে। “অমুক বিপদে পড়ে বাবা অমুক, মা অমুক, সেন্ট বা সান্তা অমুককে ডেকেছিল, অমনি সে তাকে উদ্ধার করে দিয়েছে।” আর এগুলির উপর ভিত্তি করে মানুষ আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত বা আল্লাহর মতো ক্ষমতাবান বা “ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী” বলে কল্পনা করে শিরকে লিপ্ত হয়।


লৌকিক-অলৌকিক সকল প্রার্থনা আল্লাহর কাছে করা


এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জাগতিক ও লৌকিক সাহায্য সহযোগিতা আল্লাহর সৃষ্টির কাছে চাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও এ ধরনের বিষয়ও কারো কাছে না চেয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য উম্মতকে শিক্ষা প্রদান করেছেন উম্মতের রাহবার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। জাগতিক ও সৃষ্টিজগতের সাধ্যাধীন বিষয়ে একে অপরের সাহায্য প্রর্থনা জায়েয আর আল্লাহর কাছে চাওয়া ইবাদত ও সাওয়াব। অপরদিকে দ্বিতীয় প্রকারের সাহায্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাওয়া হারাম ও শিরক আর আল্লাহর কাছে চাওয়া ইবাদত ও সাওয়াব।


কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে দু‘আর অন্যতম দিক যে, বান্দা তার সকল বিষয় শুধুমাত্র তার প্রভু, প্রতিপালক, পরম করুণাময় আল্লাহর কাছেই চাইবেন। আমরা কুরআন কারীমের আয়াতে দেখেছি আল্লাহ বান্দাগণকে তাঁরই কাছে প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি তাদের সকল প্রার্থনায় সাড়া দিবেন বলে জানিয়েছেন। যারা তাঁর কাছে দু‘আ করবে না বা তাঁকে ডাকবে না তাদের জন্য ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) জাগতিক ও ধর্মীয় সকল কাজে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলেও তা আল্লাহর কাছে চাইতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। লবণের দরকার হলেও আল্লাহর কাছে চাইতে হবে।

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

لِيَسْأَلْ أَحَدُكُمْ رَبَّهُ حَاجَتَهُ كُلَّهَا حَتَّى يَسْأَلَهُ شِسْعَ نَعْلِهِ إِذَا انْقَطَعَ وَحَتَّى يَسْأَلَهُ الملح


“তোমরা তোমাদের সকল প্রয়োজন আল্লাহর কাছে চাইবে, এমনকি যদি জুতার ফিতা ছিড়ে যায় তাহলে তাও তাঁর কাছেই চাইবে। এমনকি লবণও তাঁর কাছেই চাইবে।”[3]

আয়েশা (রাঃ) বলেন:

سَلُوا اللَّهَ كُلَّ شَيْءٍ حَتَّى الشِّسْعَ فَإِنَّ اللَّهَ إِنْ لَمْ يُيَسِّرْهُ لَمْ يَتَيَسَّرْ


“তোমরা সবকিছু আল্লাহর কাছে চাইবে। এমনকি জুতার ফিতাও আল্লাহর কাছে চাইবে। কারণ আল্লাহ ব্যবস্থা না করলে জুতার ফিতাও মিলবে না।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[4]

হাদীস শরীফে আমরা দেখতে পাই যে, যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কিছু না চান, তা যত ক্ষুদ্র জাগতিক বিষয়ই হোক, তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জান্নাতের জিম্মাদারী গ্রহণ করবেন। সাওবান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ

من يكفل (يضمن) لي أن لا يسأل الناس شيئا وأتكفل له بالجنة


“কে আছে, যে দায়িত্ব গ্রহণ করবে যে, সে কারো কাছে কিছু চাইবে না, তাহলে আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব গ্রহণ করব।” সাওবান বলেনঃ “আমি বললামঃ, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি।” এরপর সাওবান (রাঃ) কারো কাছে কিছুই চাইতেন না। অনেক সময় উটের পিঠে থাকা অবস্থায় তাঁর লাঠি পড়ে যেত। তিনি কাউকে বলতেন না যে, আমার লাঠিটি উঠিয়ে দিন। বরং তিনি নিজে উটের পিঠ থেকে নেমে নিজের হাতেই লাঠিটি উঠাতেন। হাদীসটি সহীহ।[5]


আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, “তুমি কি আমার কাছে বাই’আত (প্রতিজ্ঞা) গ্রহণ করবে, যদি কর তাহলে

তোমার জন্য রয়েছে জান্নাত।” আমি বললামঃ “হাঁ এবং আমি আমরা হাত বাড়িয়ে দিলাম।” তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার উপর শর্তারোপ করলেনঃ

لا تسأل الناس شيئاً قلت نعم قال ولا سوطك أن يسقط منك حتى تنزل اليه فتأخذه


“মানুষের কাছে কিছুই চাইতে পারবে না। আমি বললামঃ হাঁ। তিনি বললেন, তোমার ছড়িও যদি হাত থেকে পড়ে যায় তাহলে তা কারো কাছে চাইতে পারবে না। নিজে নেমে তা তুলে নেবে।” হাদীসটি সহীহ।[6]

আউফ ইবনু মালিক বলেন, আমরা ৭ জন বা ৮ জন বা ৯ জন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে বসেছিলাম। আমরা কিছু পূর্বেই বাই’আত গ্রহণ করেছি। তখন তিনি বললেন, তোমরা বাই’আত গ্রহণ করবে না? আমরা বললামঃ আমরা তো ইতোমধ্যেই বাই’আত গ্রহণ করেছি। তিনি ৩ বার একই কথা বললেন। তখন আমরা হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমাদের মধ্য থেকে একজন বললঃ আমরা কিসের উপর বাই’আত গ্রহণ করব? তিনি বললেনঃ

أَنْ تَعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَتُصَلُّوا الصَّلَوَاتِ الْخَمْسَ وَتَسْمَعُوا وَتُطِيعُوا وَأَسَرَّ كَلِمَةً خُفْيَةً وَلَا تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا قَالَ فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولَئِكَ النَّفَرِ يَسْقُطُ سَوْطُهُ فَلَا يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ


“তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোনো শিরক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে, রাষ্ট্রের আনুগত্য করবে ... এবং মানুষের নিকট কিছুই চাইবে না।” হাদীসের রাবী বলেনঃ “ঐ মানুষগুলি তাঁদের ছড়িটি পড়ে গেলেও কাউকে তা উঠিয়ে দিতে বলতেন না।”[7]

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কিছু চাইবে কেন মুমিন? কেউ তো তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ করার নূন্যতম ক্ষমতা রাখে না। তিনিই তো সব ক্ষমতার মালিক। আমি কেন অন্যের কাছে চেয়ে নিজেকে হেয় ও আমার মহান দয়ময় প্রভুর প্রতি আমার আস্থাকে কমিয়ে ফেলব?

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিছনে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ

يَا غُلَامُ إِنِّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ احْفَظْ اللَّهَ يَحْفَظْكَ احْفَظْ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلْ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ رُفِعَتْ الْأَقْلَامُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ


“হে বালক, আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিক্ষা দিচ্ছি। তুমি আল্লাহকে (তাঁর বিধানাবলীকে) হেফাযত করবে, তাহলে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহকে (তোমার অন্তরে সদা জাগরুক ও) সংরক্ষিত রাখবে, তাহলে তাঁকে সর্বদা তোমার সামনে পাবে। যখন চাইবে বা প্রার্থনা করবে তখন শুধু আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ, যদি সকল মানুষ তোমার কোনো কল্যাণ করতে সম্মিলিত হয়, তাহলে তারা তোমার শুধুমাত্র ততটুকুই কল্যাণ করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। আর যদি তারা সবাই তোমার অকল্যাণ করতে একজোট হয়, তাহলে তারা তোমার শুধুমাত্র ততটুকুই অকল্যাণ করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার বিরুদ্ধে নির্ধারণ করেছেন। কলমগুলি উঠে গেছে এবং পৃষ্ঠাগুলি শুকিয়ে গিয়েছে।” হাদীসটি সহীহ।[8]


সাধারণ বিপদ-আপদ, কষ্ট-দুঃখ বা সমস্যার কথা আমরা অনেক সময় অন্য কোনো মানুষকে বলে সহযোগিতা কামনা করি বা অন্তত মনকে হাল্কা করি। কিন্তু প্রকৃত মুমিনের অভ্যাস যে, সে কোনো বান্দার কাছে কোনো ব্যথার কথা না বলে তার সকল ব্যথা, বেদনা, কষ্ট ও যাতনার কথা তাঁর মালিকের কাছে পেশ করা। একমাত্র তিনিই তো তা দূর করতে পারেন। আর তিনি না করলে তো কারো কিছু করার নেই। শতবার ফিরিয়ে দিলেও একমাত্র তাঁর দরজাই মুমিনের গন্তব্যস্থল। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’ঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ

مَنْ نَزَلَتْ به فَاقَة فأنزلها بالناس لم تُسَدَّ فاقَتُه ومَنْ نزلتْ به فاقة فأنزلها بالله فيوشك الله له بِرِزْقِ عاجِل أو آجل


“যদি কোনো ব্যক্তি কষ্ট-অভাবে পতিত হয়ে তার অভাবে কথা মানুষের কাছে পেশ করে বা মানুষকে বলে তাহলে তার অভাব মিটবে না। আর যদি সে তার বিপদ বা অভাব আল্লাহর নিকট পেশ করে তাহলে অচিরেই আল্লাহ তাকে নিকটবর্তী বা দূরবতী রিযক প্রদান করবেন।” হাদীসটি সহীহ।[9]

[1] সূরা মায়িয়াঃ ৭৫-৭৬।

[2] ইবনু আবী শাইবা, ৬/৯১, আবু ইয়ালা মাউসিলী ৯/১৭৭, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১০/২১৭, ১৭/১১৭, বাইহাকী শু’আবুল ঈমান ১/১৩৮, ৬/১২৮, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩২, আব্দুর রউফ মানাবী, ফাইযুল কাদীর ১/৩০৭, ইবনুল জাযারী, তুহফাউয যাকিরীন, পৃ. ১৫৫, আলবানী সিলসিলাতুল যয়ীফাহ ২/১০৮-১১০, নং ৬৫৫, যয়ীফুল জামে’, পৃ. ৫৫, ৫৮, নং ৩৮৩, ৪০৪।

[3] হাদিসটি সহীহ। সুনানে তিরমিযী, কিতাবুত দাওয়াত, নং ৩৯৭৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১৪৮, ৩/১৭৬, মাওয়ারিদুয যমআন ৮/৪১-৪৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫০।

[4] আবু ইয়ালা মাওলিসী, আল-মুসনাদ ৮/৪৪-৪৫, নং ৪৫৬০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৫০।

[5] সুনানু আবী দাউদ ২/১২১, নং ১৬৪৩, সুনানুন নাসাঈ ৫/৯৬, নং ২৫৯০, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৫৮৮৮, নং ১৮৩৭, মুসনাদ আহমাদ ৫/২৭২, ২৮১, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ২/৯৮, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫৭১।

[6] মুসনাদ আহমাদ ৫/১৭২, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৯৩।

[7] সুনানু আবী দাউদ ২/১২১, নং ১৬৪২, মুসনাদ আহমাদ ৫/২৭৫, ২৭৭, ২৭৯, ২৮১।

[8] সুনানুত তিরমিযী ৪/৬৬৭, নং ২৫১৬, মুসতাদরাক হাকিম ৩/৬২৩, ৬২৪।

[9] সুনানুত তিরমিযী, কিতাবুয যুহদ, নং ২৩২৬।