ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া কারামতে আওলীয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
কারামতে আওলীয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব

مذهب أهل السنة والجماعة في كرامات الأولياء

কারামতে আওলীয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব[1]

শাইখুল ইসলাম ইমাম তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَمِنْ أُصُولِ أَهْلِ السُّنَّةِ: التَّصْدِيقُ بِكَرَامَاتَ الأَوْلِيَاءِ وما يُجْرِي اللهُ عَلَى أَيْدِيهِم مِنْ خَوَارِقِ الْعَادَاتِ فِي أَنْوَاعِ الْعُلُومِ وَالْمُكَاشَفَاتِ وَأَنْوَاعِ الْقُدْرَةِ وَالتَّأْثِيرَاتِ والْمَأْثُورِ عَنْ سَالِفِ الأُمَمِ فِي سُورَةِ الْكَهْفِ وَعَنْ صَدْرِ هَذِهِ الأُمَّةِ مِنَ الصَّحَابَةِ وَالتَّابِعِينَ وَسَائِرِ فِرَق الأُمَّةِ وَهِيَ مَوْجُودَةٌ فِيهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাহর অন্যতম মূলনীতি হলো অলীদের কারামত এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদের হাতে অলৌকিক ও স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত যে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করেন, তারা তাতে বিশ্বাস করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদের হাতে বিভিন্ন প্রকার ইলম ও কাশ্ফ থেকে যা প্রকাশ করেন এবং তাঁর ক্ষমতা[2] ও প্রভাব থেকে তাদের মাধ্যমে যা কিছু প্রকাশ করেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতে বিশ্বাস করে।

পূর্বের জাতিসমূহের মধ্যে যেসব কারামত সংঘটিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা কাহাফে এবং অন্যান্য সূরায় যেসব কারামতের কথা বর্ণনা করেছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতে বিশ্বাস করে।

সেই সাথে এই উম্মতের প্রথম যুগে সাহাবী, তাবেয়ী[3] এবং পরবর্তীতে আগমণকারী উম্মতের সকল ফির্কার লোকদের মধ্যে প্রকাশিত যেসব কারামতের কথা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতেও বিশ্বাস করে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, এই উম্মতের মধ্যে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কারামত প্রকাশিত হওয়া অব্যাহত থাকবে।


ব্যাখ্যাঃ كرامات শব্দটি كرامة শব্দের বহুবচন। আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদের হাতে অলৌকিক ও অসাধারণ যে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করেন, তারা তাতে বিশ্বাস করে। সুতরাং প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে যা সংঘটিত হয়, তাই কারামত। অর্থাৎ মানুষের নিকট পরিচিত ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম যা সংঘটিত হয়, তাই কারামত। أولياء শব্দটি ولي শব্দের বহুবচন। প্রত্যেক মুমিন মুত্তাকীই আল্লাহর অলী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ لَهُمْ الْبُشْرَى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ

‘‘মনে রেখো যে, আল্লাহর অলীদের কোন ভয় নেই। আর তারা বিষন্নও হবেনা। তারা হচ্ছে সেই সমস্ত লোক যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন করেছে। তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে পার্থিব জীবনে এবং পরকালেও’’। (সূরা ইউনূসঃ ৬২-৬৪)

الولاء শব্দ থেকে অলী শব্দটি নির্গত হয়েছে। আর الولاء অর্থ ভালবাসা অর্জন করা ও নৈকট্য হাসিল করা। সুতরাং আল্লাহ তাআলার পছন্দ এবং মর্জি মোতাবেক কাজ করে তাঁর নৈকট্য হাসিলের মাধ্যমে যে মুমিন মুত্তাকী আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব করেছে, সেই আল্লাহর অলী।

অলীদের কারামত সত্য। আল্লাহ তাআলার কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সাহাবী ও তাবেয়ীদের থেকে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীছ দ্বারা অলীদের কারামত সত্য বলে প্রমাণিত।

অলীদের কারামতের ব্যাপারে লোকেরা তিনভাগে বিভক্ত হয়েছে। (১) বিদআতীদের একটি দল অলীদের কারামত অস্বীকার করে। যেমন মুতাযেলা, জাহমিয়া এবং আশায়েরাদের কিছু লোক কারামত অস্বীকার করে। তাদের দলীল হলো অলীদের হাতে যদি কারামত প্রকাশিত হওয়া জায়েয হয়, তাহলে যাদুকরের সাথে অলীর অবস্থা মিলে যাবে এবং নবীদের থেকে অলীদেরকে পার্থক্য করা অসম্ভব হবে। কেননা মুজেযার মাধ্যমেই নবী এবং অন্যদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। সাধারণ ও চিরাচরিত প্রথার বাইরে যা বের হয়, তার নাম মুজেযা।

(২) সুফী তরীকার লোকেরা এবং কবর পূজারীরা কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে সীমালংঘন করে থাকে। তারা মানুষের সাথে মিথ্যা বলে এবং তাদেরকে শয়তানের তেলেসমাতি দেখায়। যেমন আগুনে ঝাপ দেয়া, নিজেদের শরীরে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা, বিষাক্ত সাপ ধরে ফেলা ইত্যাদি। এমনি কবর পূজারীদের আরো অনেক কাজ-কর্মকে তারা কারামত নাম দিয়ে থাকে।

(৩) শাইখুল ইসলাম তৃতীয় আরেক প্রকার লোকদের কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। তারা হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। তারা অলীদের কারামতে বিশ্বাস করে এবং কুরআন সুন্নাহর দলীল মোতাবেক উহাকে সাব্যস্ত করে।

নবীদের সাথে অন্যদের সাদৃশ্য ঠেকানোর দোহাই দিয়ে যারা কারামত অস্বীকার করে, তাদের জবাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা বলে থাকে যে, নবীদের মাঝে এবং অন্যদের মধ্যে কারামত ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। অলী কখনো নবুওয়াতের দাবী করেনা। যদি নবুওয়াতের দাবী করে, তাহলে সে অলী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারে পরিণত হয়; সে তখন আর অলী থাকেনা। আল্লাহ তাআলার অন্যতম রীতি হলো, তিনি নবুওয়াতের দাবীদারকে অপদস্ত করেন। যেমন অপদস্ত হয়েছিল মুসাইলামা কায্যাব এবং অন্যরা।

আর যারা কারামত সাব্যস্ত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করে এবং ভেলকিবাজ ও মিথ্যুকদের জন্যও তা সাব্যস্ত করে তাদের জবাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা বলে যে, আসলে তারা আল্লাহর অলী নয়; বরং শয়তানের অলী। তাদের হাতে যা কিছু সংঘটিত হয়, তা হয়ত মিথ্যা ও ধোঁকাবাজি অথবা তাদের জন্য এবং অন্যদের জন্য ফিতনা স্বরূপ। অথবা তিনি তাদেরকে অবকাশ দিয়ে ধীরে ধীরে পাকড়াও করবেন। এই বিষয়ে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ)এর একটি মূল্যবান কিতাব রয়েছে। কিতাবটির নাম, الفرقان بين أولياء الرحمن وأولياء الشيطان (আল্লাহর অলী এবং শয়তানের অলীদের মধ্যে পার্থক্য)।

আল্লাহ তাআলা অলীদের হাতে বিভিন্ন প্রকার ইলম ও কাশ্ফ থেকে যা প্রকাশ করেন এবং তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব থেকে তাদের মাধ্যমে যা কিছু প্রকাশ করেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতেও বিশ্বাস করেঃ এখানে শাইখুল ইসলাম ইঙ্গিত করেছেন যে, কারামতের কিছু অংশ ইলম ও কাশফের অন্তর্ভূক্ত। যেমন অলীগণ এমন কিছু শুনলেন যা অন্যরা শুনলনা কিংবা তারা এমন কিছু দেখলেন, যা অন্যরা দেখেনি। এটি জাগ্রত অবস্থায় হতে পারে কিংবা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মাধ্যমেও হতে পারে। অথবা অলীগণ এমন কিছু জানতে পারলেন, যা অন্যরা জানতে পারলনা। আবার কারামতের কিছু অংশ কুদরত ও ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

প্রথম প্রকারের উদাহরণ হলো, যেমন উমার (রাঃ)এর উক্তি يا سارية الجبل হে সারিয়া! পাহাড়ে আশ্রয় নাও। এই কথা বলার সময় তিনি মদীনার মিম্বারে দাঁড়িয়ে জুমআর খুতবা দিচ্ছিলেন। আর সারিয়া ছিল পূর্বের কোন একটি অঞ্চলে।[4]

আবু বকর (রাঃ) বলেছিলেন যে, তাঁর স্ত্রীর পেটে কন্যা সন্তান রয়েছে। উমার (রাঃ) তাঁর সন্তানদের থেকে কে কে ন্যায়পরায়ন হবে, তা আগেই বলে দিয়েছিলেন।[5] মুসা ও খিযির (আঃ)এর ঘটনায় রয়েছে যে, খিযির (আঃ) যে ছেলেটিকে হত্যা করেছিলেন, তার অবস্থা তিনি জানতে পেরেছিলেন।

দ্বিতীয় প্রকার কারামতের উদাহরণঃ আর কারামতের যেই প্রকার হলো ক্ষমতা ও প্রভাবের অন্তর্ভূক্ত, তার উদাহরণ হলো যেমন ঐ ব্যক্তির ঘটনা, যার নিকট কিতাবের জ্ঞান ছিল এবং চোখের পলকে বিলকীসের আরশ সুলায়মান (আঃ)এর সামনে হাযির করেছিলেন, আসহাবে কাহাফের ঘটনা। মারইয়াম (আঃ)এর ঘটনা,[6] খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)এর ঘটনা, তিনি যখন বিষ পান করলেন, তখন তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি।

শাইখুল ইসলাম বলেনঃ পূর্বের জাতিসমূহের মধ্যে যেসব কারামত সংঘটিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা কাহাফে এবং অন্যান্য সূরায় যেসব কারামতের কথা বর্ণনা করেছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতে বিশ্বাস করে।[7] সেই সাথে এই উম্মতের প্রথম যুগে সাহাবী, তাবেয়ী এবং পরবর্তীতে আগমণকারী ফির্কার লোকদের মধ্যে প্রকাশিত যেসব কারামতের কথা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাতেও বিশ্বাস করে। এখানে শাইখুল ইসলাম ঐসব কারামতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা অতীতে প্রকাশিত হয়েছে এবং কুরআনুল কারীম ও অন্যান্য গ্রন্থে সহীহভাবে তা বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী জাতির কারামতগুলো থেকে কুরআনুল কারীমে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে স্বামী ছাড়াই মারইয়ামের গর্ভধারণ করা, সূরা কাফের আসহাবে কাহাফের ঘটনা, মুসার সাথে খিযির আলাইহিস সালামের ঘটনা এবং যুল কারনাইনের ঘটনা অন্যতম।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা এই উম্মতের প্রথম যুগের লোকদের থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত কারামতগুলোর প্রতি বিশ্বাস করে। তাদের প্রথমে রয়েছেন সাহাবী ও তাবেঈগণ। যেমন উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) মদীনার মিম্বার থেকে সারিয়াকে দেখতে পেলেন। তিনি ছিলেন মদীনার মিম্বারের উপর দাঁড়ানো। আর সারিয়া ও তাঁর বাহিনী ছিল ইরাকের নাহাওয়ান্দে যুদ্ধরত। তিনি সেনাপতি সারিয়াকে ‘‘ইয়া সারিয়াতা আল-জাবাল’’ বলে ডাক দিলেন। সারিয়া এই ডাক শুনতে পেল এবং উমারের দিক নির্দেশনা পেয়ে উপকৃত হলো। মুসলিম বাহিনী শত্রুদের চক্রান্ত থেকে বেঁচে গেল।[8]তারা আরো বিশ্বাস করে যে, এই উম্মতের মধ্যে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কারামত প্রকাশিত হওয়া অব্যাহত থাকবে।[9] অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার বেলায়াত পাওয়ার শর্তসমূহ পাওয়া গেলে এই উম্মতের লোকদের মধ্যে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কারামত প্রকাশিত হতেই থাকবে।

[1] - অলীদের কারামতের মাসআলাটি আকীদাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা জরুরী। আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীকে সাহায্য ও শক্তিশালী করা, তার ঈমানকে সুদৃঢ় করা অথবা দ্বীনের সাহায্য করা ও কাফের-মুশরিকদেরকে পরাজিত করার জন্য আউলীয়াদের হাতে কারামত প্রকাশ করেন। অলীদের সম্মান ও ফযীলত বৃদ্ধি করার জন্যও কারামত প্রকাশ করা হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনের সাহায্য এবং কাফের মুশরেকদেরকে পরাজিত করার জন্য যেসব কারামত প্রকাশ করেন তার মধ্যে আলা ইবনুল হাযরামীর ঘটনাটি অন্যতম। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, তিনি উমার (রাঃ)এর খেলাফতকালে একদল সৈনিক নিয়ে যুদ্ধে বের হলেন। শত্রু ও তার বাহিনীর মধ্যে একটি সাগর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। তিনি আল্লাহর কাছে দু’আ করে সাগরের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটালেন। সাগর পার হয়ে তিনি শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করে ফেরার পথে পুনরায় আল্লাহর কাছে দুআ করে মুসলিম বাহিনী নিয়ে সাগরের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে পার হলেন। (দেখুন আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৬/১৬২)

আবু মুসলিম খাওলানীর কারামাতটিও এই প্রকারের মধ্যে গণ্য। আবু মুসলিমের ঘটনার বিবরণ এই যে, ভন্ড নবী আসওয়াদ আনাসী আবু মুসলিম খাওলানীকে ডেকে নিয়ে বললঃ তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে আমি আল্লাহর রাসূল? আবু মুসলিম বললেনঃ আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছিনা। আসওয়াদ আনাসী পুনরায় বললঃ তুমি কি এই সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল? আবু মুসলিম বললেনঃ হ্যাঁ। অতঃপর আবু মুসলিমকে আগুনে নিক্ষেপ করা হলে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে লাগলেন। ইবরাহীম (আঃ)এর ন্যায় আগুন তাঁর জন্য ঠান্ডা হয়ে গেল। তাঁর শরীরের একটি পশমও পুড়লনা। ইতিহাসের কিতাবগুলোতে এই ঘটনা বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

মাদায়েন (পারস্য) অভিযানের সময় সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)এর জন্য কারামত প্রকাশিত হয়েছিল। জলযান ছাড়াই তিনি এবং তাঁর সৈনিকগণ দিজলা নদী পার হয়েছিলেন। ইতিহাসের কিতাবগুলোতে এই প্রসিদ্ধ ঘটনাটি উল্লেখিত হয়েছে। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই যে, উমার (রাঃ)এর খেলাফতকালে মুসলিমগণ সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে যখন ইরাকের মাদায়েন অঞ্চলের পূর্বাংশ তাইসুন তথা পারস্য সম্রাটের রাজপ্রাসাদ জয় করার জন্য অগ্রসর হলো, তখন দিজলা নদী তাদের অগ্রযাত্রার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো। ঐদিকে দিজলা নদীর পানিও তখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। মুসলিম বাহিনীর অভিযানের খবর পেয়ে দিজলার পূর্ব তীরে অবস্থিত তাইসুন অঞ্চলের অধিবাসীরা নদী থেকে সকল নৌযান ও ফেরী উঠিয়ে নিলো এবং পারাপারের সমস্ত পুল ও সেতু ধ্বংস করে ফেলল। এতে করে দিজলা পার হওয়ার মত কোন উপকরণই আর মুসলিমদের জন্য অবশিষ্ট রইলনা। কিন্তু সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং মুসলিম অশ্বারোহীগণ আল্লাহ তাআলার করুণা ও রহমত থেকে নিরাশ হলোনা। মাদায়েন (পারস্য) বিজয়ের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যৎ বাণীতে তারা পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলো। তাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, তাদের হাতেই সেই ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবায়ন হবে এবং পারস্য বিজয় হবে। খালেদ বিন ওয়ালীদ সে সময় স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁর সৈনিকরা দিজলাতে ঝাপিয়ে পড়েছে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে এবং আল্লাহ তাআলার উপর ভাল ধারণা পোষণ করে তিনি নদীর উপর ঘোড়া ছুটানোর ইচ্ছা পোষণ করলেন। তার আগে তিনি বিষয়টি মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে পেশ করলেন। সৈনিকরা আল্লাহ তাআলার সাহায্যে পূর্ণ আস্থা রেখে বললোঃ আল্লাহ আপনাকে এবং আমাদেরকে সঠিক পথই দেখিয়েছেন। আপনি যা ইচ্ছা করেছেন, তাই করুন।

ঐদিকে রাতের বেলায় হঠাৎ করে মুসলিম সৈনিকদের চোখে দিজলার পূর্ব তীরে অবস্থিত পারস্য সম্রাটের সাদা প্রাসাদটি চকচক করে ভেসে উঠেছিল। তখন তারা দিজলা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থান করছিলো। পারস্য সম্রাটের সাদা রাজপ্রাসাদ দেখে আল্লাহু আকবার ধ্বনীতে তারা তাদের আশপাশের অঞ্চলকে মুখরিত করে তুলল। তারা বলতে লাগলঃ এই তো পারস্য সম্রাট কিসরার সাদা রাজ প্রাসাদ। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল ওয়াদা করেছেন যে, ইহা আমাদের হস্তগত হবে। এই বলে তারা সমগ্র রাত তাকবীর পাঠ করতে করতে কাটিয়ে দিলো। অতঃপর সা’দ তাঁর সৈনিকদেরকে নদীতে ঘোড়াসহ ঝাপ দেয়ার অনুমতি দিলেন। তিনি তাদেরকে আদেশ করলেন, তারা যেন নদীতে ঝাপ দেয়ার সময় এই কথাগুলো পাঠ করেঃ

نستعين بالله ونتوكَّل عليه حسبُنا الله ونعم الوكيل لا حولَ ولا قوَّة إلا بالله العليِّ العظيم

সৈনিকরা ইহা পাঠ করতে করতে নদীতে ঝাপ দিল। স্বয়ং সা’দও ঝাপ দিলেন। সেসময় সালমান ফারসী পানির উপর দিয়ে সা'দের সাথে চলছিলেন। সা’দ তখন বলছিলেনঃ

حسبنا الله ونعم الوكيل واللهِ لينصرنَّ الله وليه وليظهرنَّ دينه وليهزمن عدوَّه إن لم يكن في الجيش بغيٌ أو ذنوب تغلب الحسنات

মোটকথা, মুসলিম সৈনিকরা দিজলাতে ঝাপ দিল। পানির উপর দিয়ে ঘোড়া তাদেরকে নিয়ে চলল এবং সৈনিকদের সকলেই নিরাপদে পার হয়ে গিয়ে মাদায়েন জয়ের মাধ্যমে পারস্য সম্রাটের প্রাসাদ, তাঁর রাজমুকুট এবং সেখানকার ধনভান্ডার অধিকার করলো। এর মাধ্যমে খন্দকের যুদ্ধের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে পারস্য সাম্রাজ্য এবং সেখানকার ধনভান্ডার দখল করার যেই ওয়াদা করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলো। আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন। (ঘটনার সূত্রঃ তারীখে তাবারী, বালাযুরী, উস্দুল গাবা, তারীখে বাগদাদ, ইসাবা ইত্যাদি)

[2] - আল্লাহর নবী সুলায়মান আলাইহিস সালাম ‘সাবা’র রাণী বিলকীসের কাছে চিঠি লিখলেনঃ তুমি আত্মসমর্পন করে আমার কাছে চলে আসো। চিঠি পেয়ে সে প্রথমে সুলায়মানকে পরীক্ষা করার জন্য অনেক মূলবান উপঢৌকন পাঠালো এবং তাঁকে এগুলো দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চাইলো। কিন্তু সুলায়মান আলাইহিস সালাম যখন উপঢৌকন ফেরত দিলেন এবং আত্মসমর্পন করে চলে না আসার ভয়াবহ পরিণতির কথা জানিয়ে দিলেন তখন সে দলবলসহ সুলায়মানের কাছে চলে আসার জন্য রওয়ানা দিল। রওয়ানা হওয়ার আগে সে তার সিংহাসনকে একটি সুরক্ষিত স্থানে রেখে দিল। সুলায়মান আলাইহি সালাম ইহা জানার পর বললেনঃ কে আছে বিলকীস আত্মসমর্পন করে এখানে চলে আসার আগেই তার সিংহাসনকে আমার সামনে হাযির করতে পারবে? তখন জিনদের মধ্য হতে শক্তিধর এক দানব বললঃ আপনি এই মজলিস ত্যাগ করার আগেই উহা এনে দিবো। সুলায়মান বললেনঃ আমি চাই যে আরো দ্রুত উহা উপস্থিত করা হোক। তখন কিতাবের ইলমের অধিকারী একজন সৎ লোক বললঃ আমি আপনার চোখের পলকের পূর্বেই উহাকে আপনার সামনে হাযির করবো। ইমাম সুহাইলী বলেনঃ সে ছিল সুলায়মান আলাইহিস সালামের খালাতো ভাই আসেফ বিন বারখীয়া। আল্লাহ তাআলার অতি সুন্দর নামগুলো থেকে আসেফের ইসমে আযাম জানা ছিল।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে জিনদের দানব বিলকীসের সিংহাসন নিয়ে আসার জন্য সময় চেয়েছিল। সুলায়মানের মজলিস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সময়। তা সম্ভবত এক ঘন্টা বা কয়েক ঘন্টা হতে পারে। দানব এই সময়ের মধ্যে সেখানে যেত। সেখানে গিয়ে সিংহাসনটি উঠিয়ে নিয়ে আসতো। কিন্তু সুলায়মান তাকে এত সময় দিলেন না। আরো দ্রুত আনতে চাইলেন। যাতে করে মহান আল্লাহর অতুলনীয় ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই আসেফ চোখের পলকের মধ্যে সেটি হাযির করার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। আল্লাহ তাআলা তা এনে দিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে এভাবেই তাঁর অসীম ক্ষমতা থেকে কিছু কিছু ক্ষমতা প্রকাশ করেন। বিলকীসের দেশে গিয়ে সিংহাসন উঠিয়ে আনার প্রয়োজন হলোনা। কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, إن الله على كل شيئ قدير নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিষের উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ তাআলার পক্ষে কোন কিছুই কঠিন নয়। তাঁর সকল কাজ শুধু কাফ ও নূন অক্ষরের মাঝখানে। অর্থাৎ শুধু كن শব্দের দু’টি অক্ষরের মাঝখানে। এমনকি তা বলে শেষ করার আগেই তা হয়ে যায়।

এখানে ঐ লোকের ঘটনাও উল্লেখ করা যেতে পারে, আল্লাহ তাআলা যার মৃত ঘটিয়েছিলেন। একশ বছর পর্যন্ত সে মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁর অসীম কুদরতের কিছু সেই লোককে দেখানো এবং তার ঈমান মজবুত করার জন্য একশ বছর পর তাকে পুনরায় জীবিত করলেন। সেই সাথে তাকে এর মাধ্যমে সম্মানিত করা এবং অন্যদের জন্য নিদর্শন স্বরপ করাও উদ্দেশ্য ছিল। আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারা ২৫৯ নং আয়াতে এই লোকের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

﴿أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَىٰ قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّىٰ يُحْيِي هَٰذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِائَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالَ بَل لَّبِثْتَ مِائَةَ عَامٍ فَانظُرْ إِلَىٰ طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ وَانظُرْ إِلَىٰ حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آيَةً لِّلنَّاسِ وَانظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا ۚ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

‘‘অথবা দৃষ্টান্তস্বরূপ সেই ব্যক্তিকে দেখো যে এমন একটি লোকালয় অতিক্রম করেছিল, যার গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল৷ সে বললোঃ এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জনবসতি! একে আল্লাহ আবার কিভাবে জীবিত করবেন? এ কথায় আল্লাহ তার প্রাণ হরণ করলেন এবং সে একশ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় পড়ে রইলো৷ তারপর আল্লাহ পুনর্বার তাকে জীবন দান করলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ বলো, তুমি কত বছর এখানে পড়েছিলে? সে জবাব দিলঃ এই তো এক দিন বা একদিনের চেয়েও কম। আল্লাহ বললেনঃ ‘‘বরং একশটি বছর এই অবস্থায় তোমার উপর দিয়ে চলে গেছে৷ এবার নিজের খাবার ও পানীয়ের উপর দৃষ্টি দাও। দেখোঃ এগুলোর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি৷ অন্যদিকে তোমার গাধাটিকে দেখো৷ এটা আমি এ জন্য করেছি যে, মানুষের জন্য তোমাকে আমি একটি নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করাতে চাই তুমি এর হাড়সমূহের প্রতি দৃষ্টি দাও। কিভাবে একে উঠিয়ে খাড়া করি এবং এর গায়ে গোশত ও চামড়া লাগিয়ে দেই৷এভাবে সত্য যখন তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো তখন সে বলে উঠলোঃ আমি জানি, আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’’।

এই ব্যক্তির নাম সম্পর্কে একাধিক কথা পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন সে ছিল বনী ইসরাঈলের হিযিকীল। আবার কেউ বলেছেনঃ উযায়ের আলাইহিস সালাম। আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন।

[3] - নাখঈ গোত্রের একজন লোকের গাধা রাস্তায় মারা গেল। সাথীরা তাকে বললঃ তোমার আসবাবপত্র নিয়ে আসো। আমরা আমাদের বাহনের উপর বহন করবো। তুমিও আমাদের সাথে আরোহন করো। কিন্তু এতে সে রাজী হলোনা। সাথীরা তাকে রেখেই চলে গেল। সাথীদের চলে যাওয়ার পর সে অযু করে দুই রাকআত নামায পড়ে গাধার মাথার কাছে গিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করলো যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে এবং তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় বের হয়েছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমিই মৃতকে জীবিত করে থাকো এবং তুমি নিশ্চয়ই মৃতদেরকে কবর থেকে পুনরুত্থিত করবে। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আজ কারো অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী করোনা। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি যে, তুমি আমার গাধাটিকেই জীবিত করে দাও। অতঃপর গাধাটি তার দুই কান নাড়াতে নাড়াতে দাঁড়িয়ে গেল। গাধায় আরোহন করে সে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়ে সাথীদের সাথে মিলিত হলো। উল্লেখ্য যে, এটি ছিল উমার রাযিয়াল্লাহুর খেলাফতকালের ঘটনা। (ঘটনার সূত্রঃ বায়হাকী, তাযকিরাতুল হুফফায, বেদায়া ওয়ান নেহায়া ইত্যাদি)

[4] - সারিয়ার সাথে উমার (রাঃ)এর কারামাতের বিস্তারিত বিবরণ এইযে, উমার (রাঃ) একদল সৈনিক পাঠালেন এবং সারিয়া নামক এক ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করলেন। উমার (রাঃ) মদীনার মিম্বারে জুমআর দিন খুৎবারত অবস্থায় ইয়া সারিয়াতা! আল-জাবালা ইয়া সারিয়াতা! আল-জাবালা বলে উচ্চস্বরে ডাক দিলেন। সৈনিকরা এই ডাক শুনে আশ্চর্যবোধ করলেন। তারা মদীনায় এসে বললেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন! আমরা শত্রুদের মুকাবিলা করতে গেলে তারা আমাদেরকে পরাজিত করে ফেলে। আমরা প্রায় ধ্বংস হয়েই গিয়েছিলাম। তখন আমরা একজন লোককে চিৎকার করে বলতে শুনলামঃ ইয়া সারিয়াতা! আল-জাবাল। অর্থাৎ হে সারিয়া পাহাড়ে আশ্রয় নাও। আওয়াজটি আপনার আওয়াজের মতই মনে হচ্ছিল। এতে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করে পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। শত্রুদের আক্রমণের কবল হতে নিরাপদ হলাম। আল্লাহ্ তাআলা শত্রুদেরকে পরাজিত করলেন।

উমার (রাঃ) তখন বললেন, তাঁর জন্য সারিয়ার অবস্থা উন্মুক্ত করা হয়েছিল। তাই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সারিয়াকে শত্রুরা ঘেরাও করে ফেলেছে। তিনি তাকে এই বলে পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিতে বলেছেন যে, يا سارية! الجبل হে সারিয়া! পাহাড়ে উঠে যাও। সারিয়া তা শুনেছে এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। আল্লাহই অধিক অবগত আছেন। (মাজমূআ ফাতাওয়া ইবনে তাইমীয়াঃ ১১/২৭৮)

[5] - বাস্তবেও তাই হয়েছে। উমাইয়া খেলাফতের সর্বাধিক ন্যায় পরায়ন খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীয তাঁর সন্তানদের মধ্য হতেই ছিলেন।

[6] - তাতে উল্লেখিত হয়েছে যে, যাকারিয়া (আঃ) যখনই তার নিকট প্রবেশ করতেন, তখনই সেখানে বিভিন্ন প্রকার ফল-ফলাদি দেখতে পেতেন। মৌসম না হওয়া সত্ত্বেও তার কাছে সবসময় মৌসমি ফল পাওয়া যেত। তিনি মারইয়ামকে জিজ্ঞেস করতেনঃ হে মারইয়াম তুমি এগুলো কোথায় পেলে? তিনি জবাব দিতেনঃ এগুলো আল্লাহর তরফ থেকে। তিনি যাকে ইচ্ছা বিনা হিসাবে রিযিক দিয়ে থাকেন। স্বামী ছাড়াই ঈসা (আঃ)কে প্রসব করাও মারইয়াম (আঃ)এর অন্যতম একটি কারামত। আরো যেসব বিষয় দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁকে সম্মানিত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রসব ব্যথায় কাতর হয়ে তিনি একটি খেজুর গাছের গোড়ায় গেলেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে খেজুর গাছের গোড়ায় ধরে ঝাকি দিতে বললেন। এতে করে খেজুর গাছ থেকে তোমার নিকট তরতাজা খেজুর ঝড়ে পড়বে। উল্লেখ্য যে, খেজুর বৃক্ষের কাচা ফল ও পাতা এত শক্তভাবে ডালার সাথে যুক্ত থাকে যে, তা কখনই ঝড়ে পড়েনা। সেই সাথে একজন দুর্বল মহিলার নাড়ানোতে খেজুর গাছ নড়াচড়া করার কথা নয় এবং তা থেকে কাচা খেজুর ঝড়ে পড়ারও কথা নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর রিযিকের ব্যবস্থা করার জন্য এবং তাঁকে সম্মানিত করার জন্যই তা করেছেন।

[7] - পূর্বের জাতিসমূহের মধ্যে প্রকাশিত যেসব কারামত সহীহ সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, তার মধ্য হতে কতিপয়ের উদাহরণ এখানে পেশ করা হলো।

গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির কারামতঃ

ইবনে উমার (রাঃ) নবী (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, অতীত কালে তিনজন লোক পথ চলতেছিল। পথিমধ্যে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে তারা একটি পাহাড়ের গুহায় ঢুকে পড়ল। উপর থেকে বিশাল আকারের একটি পাথর গড়িয়ে এসে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। তাদের জন্য বের হওয়ার কোন সুযোগ অবশিষ্ট রইলনা। তাদের একজন অপরজনকে বলতে লাগল, তোমরা প্রত্যেকেই আপন আপন সৎআমল আল্লাহর দরবারে তুলে ধরে তার উসীলা দিয়ে দু’আ কর। এতে হয়ত আল্লাহ আমাদের জন্য বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন।

তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতা অতি বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হয়েছিল, আমার কতিপয় শিশু সন্তানও ছিল। আমি ছিলাম তাদের জন্য একমাত্র উপার্জনকারী। আমি প্রতিদিন ছাগল চরানোর জন্য মাঠে চলে যেতাম। বিকালে ঘরে ফেরত এসে দুধ দহন করে আমি প্রথমে পিতা-মাতাকে পান করাতাম, পরে আমার শিশু সন্তানদেরকে পান করাতাম। এটি ছিল আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। একদিন ঘাসের সন্ধানে আমি অনেক দূরে চলে গেলাম। এসে দেখি আমার পিতা-মাতা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার অভ্যাসমত আমি দুধ দহন করে দুধের পেয়ালা নিয়ে তাদের মাথার পাশে দাড়িয়ে রইলাম। আমি তাদেরকে ঘুম থেকে জাগ্রত করাকে অপছন্দ করলাম। যেমন অপছন্দ করলাম পিতা-মাতার পূর্বে সন্তানদেরকে দুধ পান করানোকেও। শিশু সন্তানগুলো আমার পায়ের কাছে ক্ষুধার তাড়নায় চিৎকার করতেছিল। এভাবে সারা রাত কেটে গিয়ে ফজর উদীত হল। আমার পিতা-মাতা ঘুম থেকে জাগলেন। আমি তাদেরকে প্রথমে পান করালাম অতঃপর আমার ছেলে-মেয়েদেরকে পান করালাম।

হে আল্লাহ! আপনি অবশ্যই জানেন যে, আমি একাজটি একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সম্পাদন করেছি। এই আমলটির উসীলায় আমাদের জন্য বের হওয়ার রাস্তা করে দিন। এভাবে দু’আ করার সাথে সাথে পাথরটি একটু সরে গেল, তারা আকাশ দেখতে পেল, কিন্তু তখনও বের হওয়ার মত রাস্তা হয়নি। দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! আমার একজন চাচাতো বোন ছিল। সে ছিল আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং একজন পুরুষ কোন মহিলার প্রতি যতদূর আসক্ত হতে পারে, আমি ছিলাম তার প্রতি ততটুকু আসক্ত। আমি তার কাছে আমার মনোবাসনা পেশ করলাম। সে একশত স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার শর্তে তাতে সম্মত হল। আমি অনেক পরিশ্রম করে একশত স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করে তার কাছে গমণ করলাম। সে সম্মতি প্রকাশ করার পর আমি তার উভয় উরুর মধ্যে বসে পড়লাম। এমন সময় সে বলে উঠল, হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর, আমার স্বতীত্ব নষ্ট করোনা। একথা শুনে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। এমনকি স্বর্ণ মুদ্রাও তাকে দিয়ে দিলাম।

হে আল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন যে, আমি আপনার ভয়ে সেদিন পাপের কাজ থেকে বিরত হয়েছি, তাহলে আজ আমাদেরকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। সাথে সাথে পাথরটি আরো একটু সরে গেল কিন্তু তখনও বের হওয়ার মত রাস্তা হয়নি।

তৃতীয়জন বললঃ হে আল্লাহ! নির্ধারিত বেতনের বিনিময়ে আমি একজন শ্রমিক নিয়োগ করলাম। কাজ শেষ করে সে আমার কাছে পারিশ্রমিক চাইলে আমি তা প্রদান করলাম, কিন্তু সে উহা গ্রহণ না করেই চলে গেল। আমি তার প্রাপ্য টাকা বাড়াতে থাকলাম। একপর্যায়ে তা একপাল গরুতে পরিণত হল। আমি গরুগুলো মাঠে চরানোর জন্য একজন রাখালও নিয়োগ করলাম।

অনেক দিন পর সেই লোকটি আমার কাছে এসে তার মজুরী চাইল। আমি বললামঃ তুমি রাখালসহ উক্ত গরুর পালটি নিয়ে চলে যাও। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার প্রাপ্য দিয়ে দাও এবং আমার সাথে বিদ্রুপ করোনা। আমি বললাম, বিদ্রুপ করি নাই। বরং এগুলো তোমার। আমি তোমার এক দিনের মজুরী দিয়ে এগুলো করেছি। তাই তুমি রাখালসহ গরুর পালটি নিয়ে চল। অতঃপর সে গরুর পালটি নিয়ে চলে গেল। একটিও রেখে যায়নি।

হে আল্লাহ! আপনি যদি মনে করেন যে, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য একাজটি করেছি, তাহলে আজ আমাদেরকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। সাথে সাথে পাথরটি সম্পূর্ণরূপে সরে গেল। তারা নিরাপদে সেখান থেকে বের হয়ে এল।

একজন বৃদ্ধ লোকের কারামতঃ

অতীত কালে একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলছিল। হঠাৎ মাথার উপর মেঘমালা থেকে একটি শব্দ শুনল যে, অমুকের বাগানে বর্ষণ কর। লোকটি মেঘমালাকে অনুসরণ করে পথ চলতে থাকল। অবশেষে একটি যমিনে বৃষ্টি বর্ষণ হল। সে খানে দেখতে পেল একজন লোক কোদাল হাতে নিয়ে বাগানে কাজ করছে। লোকটি বাগান ওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল তোমার নাম কি? সে বললঃ আমার নাম অমুক। যে নামটি সে মেঘ থেকে শুনেছিল। তারপর বাগানের মালিক জিজ্ঞাসা করল, তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞাসা করছ? উত্তরে সে বললঃ যে মেঘ থেকে এই বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে, আমি তোমার নামটি সেই মেঘের ভিতরে শুনতে পেয়েছি। তাই আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করছি। তোমার কাছে আমার আরো একটি প্রশ্ন হল, তুমি কিভাবে এই বাগানের ফসল ব্যয় কর, তাও আমি জানতে চাই।

সে বললঃ আমার যমিনে উৎপাদিত ফসলকে তিনভাগে বিভক্ত করি। একভাগ আমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করি। একভাগ পুনরায় ফসল আবাদের কাজে ব্যয় করি। আর এক ভাগ ফকীর, মিসকীন এবং মুসাফিরদের মাঝে বন্টন করে দেই।

[8] - সাহাবীদের মধ্যে যেসব কারামত প্রকাশিত হয়েছে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। একটু পূর্বে আমরা আবু বকর ও উমার (রাঃ)এর একাধিক কারামত আমরা বর্ণনা করেছি। আরো যেসব সাহাবীর কারামত প্রকাশিত হয়েছিল, তার মধ্যে উসায়েদ ইবনে হুযায়ের এবং আববাদ বিন বিশরের কারামত অন্যতম।

উসাইদ ইবনে হুজাইর (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাত্রি বেলায় সূরা বাকারা তেলাওয়াত করছিলাম। আমার ঘোড়াটি কাছেই বাধা ছিল। হঠাৎ করে ঘোড়াটি লাফিয়ে উঠল। আমি কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। ঘোড়াটিও থেমে গেল। পুনরায় তেলাওয়াত শুরু করলাম। ঘোড়াটি পুনরায় লাফাতে শুরু করল। আমি এবারও কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। ঘোড়াটিও থেমে গেল। তারপর আমি একেবারেই তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। কারণ আমার শিশু পুত্র ইয়াহয়া ঘোড়াটির পাশেই ঘুমন্ত ছিল। আমার ভয় হল যে, ঘোড়াটি হয়ত ইয়াহয়াকে আঘাত করতে পারে, এই ভয়েই আমি মূলত কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম, মাথার উপরে অসংখ্য আলোক বর্তিকার মত কি যেন দেখা যাচ্ছে। আলোক বর্তিকাগুলো আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে গেল। একটিও অবশিষ্ট রইলনা।

সকাল বেলা আমি রাসূল (সাঃ)এর নিকট গিয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। বললাম হে আল্লাহর নবী! গত রাত্রে আমি কুরআন তেলাওয়াত করছিলাম। আমার ঘোড়াটি কাছেই বাধা ছিল। হঠাৎ করে ঘোড়াটি লাফিয়ে উঠল। আমি কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। ঘোড়াটিও থেমে গেল। আবার তেলাওয়াত শুরু করলাম। আবার ঘোড়াটি লাফাতে শুরু করল। আমি আবার কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। ঘোড়াটিও থেমে গেল। তারপর আমি একেবারেই তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। কারণ আমার শিশু পুত্র ইয়াহয়া ঘোড়াটির পাশেই ঘুমন্ত ছিল। আমার ভয় হল যে, ঘোড়াটি হয়ত ইয়াহয়াকে আঘাত করতে পারে, এই ভয়েই আমি মূলত কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। অতঃপর আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম, মাথার উপরে অসংখ্য আলোক বর্তিকার মত কি যেন দেখা যাচ্ছে। আলোক বর্তিকাগুলো আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে গেল। একটিও অবশিষ্ঠ রইলনা।

রাসূল (সাঃ) আমাকে বললেন, তুমি কি জান এগুলো কী? তারা হলো আল্লাহর ফেরেশতা। তোমার কুরআন তেলাওয়াত শুনার জন্য তারা আগমণ করেছিল। তুমি যদি সকাল পর্যন্ত তেলাওয়াত অব্যাহত রাখতে, তাহলে দুনীয়ার মানুষেরা তাদেরকে দেখতে পেত। কারণ কুরআন তেলাওয়াত শুনা ছেড়ে দিয়ে আত্মগোপন করা কখনই তাদের পক্ষে সম্ভব হতনা।

আববাদ বিন বিশ্র এবং উসাইদ ইবনে হুজাইর নবী (সাঃ)এর সাথে ইশার নামায আদায় করার পর অনেক ক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সাথে কথাবার্তা বললেন। এতে অনেক রাত হয়ে গেল। রাত্রিটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। কথাবার্তা শেষে তারা যখন নবী (সাঃ)এর দরবার থেকে বের হলেন তখন তাদের সামনে একটি আলোক বর্তিকা প্রকাশিত হয়ে রাস্তা আলোকিত করে দিল। আলোক বর্তিকাটি তাদের আগে আগে চলতে লাগল। রাস্তায় যখন তাদের পৃথক হওয়ার সময় হল একটি আলোক বর্তিকা দু’টিতে পরিণত হয়ে গেল। একটি আববাদ বিন বিশরের রাস্তাকে আলোকিত করে তার আগে আগে চলতে লাগল। তিনি উক্ত আলোতে পথ চলতে চলতে বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। এমনিভাবে অন্য আলোটি উসাইদ বিন হুজাইরের রাস্তাকে আলোকিত করলে তিনিও নির্ভিগ্নে বাড়িতে চলে গেলেন। (বুখারী, অধ্যায়ঃ আববাদ বিন বিশর ও উসাইদ বিন হুযায়েরের ফজীলত।)

[9] - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের ঘটনায় সংবাদ দিয়েছেন যে, সে একজন যুবক মুমিনকে ডাক দিবে। যুবক তার কাছে এসে বলবেঃ তুমি মিথ্যুক দাজ্জাল। তোমার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে পূর্বেই সংবাদ দিয়েছেন। দাজ্জাল তখন তাকে হত্যা করে দুই টুকরা করে ফেলবে এবং তার মাঝখানে হাঁটবে। অতঃপর দাজ্জাল যুবকটিকে ডাক দিবে। তখন যুবকটি আল্লাহর একত্বের ঘোষণা দিতে দিতে উঠে দাঁড়াবে। দাজ্জাল পুনরায় তার নিজের জন্য যুবকটির কাছ থেকে উলুহীয়াতের স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করবে। লোকটি বলবেঃ তোমার সম্পর্কে আজকের চেয়ে অধিক অভিজ্ঞতা আমার ইতিপূর্বে ছিলনা। অর্থাৎ তুমি যে মিথ্যুক দাজ্জাল, -আমার এই বিশ্বাস আগের চেয়ে এখন আরো বেশী মজবুত হয়েছে। দাজ্জাল তখন দ্বিতীয়বার তাকে হত্যা করতে চাইবে। কিন্তু সে আর তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবেনা। দাজ্জাল দ্বিতীয়বার ঐ যুবকটিকে হত্যা করতে না পারা বিনা সন্দেহে যুবকের কারামতের অন্তর্ভুক্ত।