ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া তাকদীরের প্রতি ঈমান এবং তাতে যেসব বিষয় শামিল রয়েছে ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
তাকদীরের প্রতি ঈমান এবং তাতে যেসব বিষয় শামিল রয়েছে

الإيمان بالقدر وبيان ما يتضمنه

তাকদীরের প্রতি ঈমান এবং তাতে যেসব বিষয় শামিল রয়েছে:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَتُؤْمِنُ الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ وَالْإِيمَانُ بِالْقَدَرِ عَلَى دَرَجَتَيْنِ كُلُّ دَرَجَةٍ تَتَضَمَّنُ شَيْئَيْنِ

নাজাতপ্রাপ্ত দল অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করে। উহার মধ্যে যেসব ভাল রয়েছে তার প্রতি এবং যেসব মন্দ রয়েছে, তার প্রতিও। তাকদীরের প্রতি ঈমানের দু’টি স্তর রয়েছে। প্রত্যেক স্তরই দু’টি জিনিষকে শামিল করে।


ব্যাখ্যাঃ القدر শব্দটি قدرت الشيئ إذا أحطت بمقداره-এর মাসদার। অর্থাৎ যখন কোন জিনিষ সম্পর্কে সকল দিক অবগত হওয়া যায়, তখন বলা হয় أحطت بمقداره ‘‘আমি উহার পরিমাণ সম্পর্কে অবগত হয়েছি’’। এই কথা আপনি ঠিক ঐ সময়ই বলে থাকেন, যখন সেই বিষয়ের খুঁটিনাটি সবকিছুই আপনি অবগত হতে সক্ষম হন। কাদার বা তাকদীর দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, সকল সৃষ্টি সম্পর্কেই আল্লাহ তাআলার ইলম রয়েছে। মাখলুকসমূহ সৃষ্টি করার আগেই আযালে (আদিতে) আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে অবগত আছেন।[1]

পৃথিবীতে এমন কোন ঘটনা ঘটেনা, যা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেন নি। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই সে সম্পর্কে জানেন এবং সেই ঘটনার সাথে তাঁর ইচ্ছাও রয়েছে। তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের ছয় রুকনের একটি। তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা মানে উহার ভাল-মন্দ উভয়ের প্রতিই বিশ্বাস করা।

শাইখুল ইসলামের উক্তিঃ নাজী ফির্কা অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তাকদীরের ভাল ও মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করে, -এই কথার মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যারা তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করেনা, তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। কুরআন ও হাদীছের দলীলের দাবীও তাই। যেমন হাদীছে জিবরীলে এসেছে, জিবরীল যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি বললেনঃ

«أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ»

‘‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে (১) আল্লাহ পাকের উপর (২) তাঁর ফেরেশতাদের উপর (৩) তাঁর কিতাবসমূহের উপর (৪) তাঁর রাসূলদের উপর (৫) আখেরাত বা শেষ দিবসের উপর এবং (৬) তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর’’।[2] এই হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়নকে ঈমানের ষষ্ঠ রুকন হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ইহা অস্বীকার করবে, সে মুমিন হিসাবে গণ্য হবেনা। তেমনি ঈমানের অন্য কোন রুকন অস্বীকার করলেও মুমিন হিসাবে গণ্য হবেনা।

তাকদীরের প্রতি ঈমান দু’টি স্তরে বিভক্তঃ শাইখুল ইসলাম এখানে উল্লেখ করেছেন যে, তাকদীরের প্রতি ঈমানের সর্বমোট চারটি স্তর রয়েছে। সংক্ষিপ্তাকারে এই স্তরগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ।(১) প্রত্যেক জিনিষ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার আযালী ইলম। অর্থাৎ মাখলুক সৃষ্টি করার আগে থেকেই আল্লাহ তাআলা মাখলুকের সকল অবস্থা সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। বান্দারা যেসব আমল করে থাকে, তা সম্পাদন করার পূর্বেই সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার অবগতিও সেই ইলমে আযালীর অন্তর্ভুক্ত। (২) সেই ইলম অনুযায়ী সবকিছু লাওহে মাহফুযে লিখে রাখা হয়েছে (৩) যা কিছু ঘটে, তার প্রত্যেকটির মধ্যেই আল্লাহর (সৃষ্টি ও নির্ধারণগত) ইচ্ছা শামিল থাকে এবং তা আল্লাহ তাআলার পূর্ণ ক্ষমতাধীন। (৪) আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইলম, নির্ধারণ এবং ইচ্ছা মোতাবেক সমস্ত মাখলুক সৃষ্টি করেছেন। আর তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। তিনি ব্যতীত সবকিছুই সৃষ্টি। এই হচ্ছে সংক্ষিপ্তাকারে তাকদীরের স্তরসমূহ। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা সামনে আসছে।

[1] - আল্লাহ তাআলা বান্দাকে পূর্বের নির্ধারণ অনুযায়ী শাস্তি দিবেন না কিংবা তাকদীর অনুযায়ী কাউকে পুরস্কারও দিবেন না। কুরআন এবং সুন্নাহর কোথাও এই কথা বলা হয়নি; বরং তিনি তাদের আমল অনুযায়ী শাস্তি দিবেন অথবা ছাওয়াব দিবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ছাওয়াব বা শাস্তি আমলের ফলাফল; ভাগ্যের নয়।

অন্য কথায় এভাবে বলা যেতে পারে যে, তাকদীরে আছে বা ছিল কিংবা ভাগ্যে যা আছে তাই হবে এই কথার অর্থ হলো যা কিছু হবে, আল্লাহ তাআলা আযাল (আগে) থেকেই তা জানেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার সকল অবস্থা ও পরিণাম জানেন, তার মানে এই নয় যে তিনি কোন কিছুতে বান্দাকে বাধ্য করেন। তাই বান্দার ভাল-মন্দ আমল কিংবা তার জান্নাতী বা জাহান্নামী হওয়াতে আল্লাহর ইলম প্রভাবহীন।

এ ক্ষেত্রে একটি প্রশ্নের উত্তর বিষয়টিকে সহজভাবে বুঝতে সহযোগিতা করে। তা হলো, আমরা যেসব কাজ করি সেগুলো আল্লাহ ভাগ্যে লিখেছেন বলে আমরা করি? না কি আমরা তা করবো বলে তিনি জানতে পেরেছেন এবং সে অনুযায়ী লিখেছেন?

উত্তর হলো, আমরা করবো বলে আল্লাহ তাআলা জেনেছেন বলেই লিখেছেন। অতএব ভাগ্যলিপিকে দায়ি বানানোর কোনো অবকাশ নেই।

আল্লাহ তাআলা যেহেতু বান্দাকে আকল তথা বোধশক্তি দিয়েছেন, আমল করা বা না করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, শক্তিও দিয়েছেন, বান্দা যেহেতু সেই আকল খাটিয়ে কাজ করে, নিজস্ব ইচ্ছা ও স্বাধীনতার বলে ভাল বা মন্দটা নির্বাচন করে, তাই সে নিজেই ছাওয়াব বা শাস্তির হকদার হয়। নামায যেহেতু বান্দাই পড়ে, তাই নামাযের পুরস্কার সেই পাবে, কুরআন যেহেতু বান্দার মুখ দিয়ে পড়া হয়, তাই প্রতিটি হরফের বিনিময়ে বান্দাই দশটি নেকী পাবে।

বান্দাই যেহেতু যেনা করা এবং অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজের আকল, সুকুমারবৃত্তি, আপন ইচ্ছা ও এখতিয়ারের বদৌলতেই বিরত হয়, সে কারণেই প্রশংসিত হয় বান্দা নিজেই এবং উক্ত কাজগুলোতে লিপ্ত হলে নিন্দিত হয় কেবল বান্দাই।

অসৎচরিত্রের কোনো লোক যদি কারো মা-বোন বা স্ত্রীর সাথে যেনা করতে যায়, তখন বিবেকবান কোন লোক এই কথা বলেনা যে, ঠিক আছে, আমার স্ত্রীর নসীবে যেনা-ব্যভিচার লিখা আছে। তাই আমি তাকে বাধা দিবোনা। তার মন যা চায়, আমার ঘরে তাই করে যাক; বরং সে রাগান্বিত হয়, জান দিয়ে হলেও নিজের ইজ্জত-আভ্রু রক্ষার্থে সিংহের মত ক্ষেপে উঠে এবং অপরাধীকে প্রতিহত করে, হত্যা করতেও উদ্যোত হয়। বাস্তবে এমনটিই হওয়া উচিৎ।

কারো ঘরে চোর ঢুকলে ঘরের মালিক এ কথা বলেনা যে, চোরের মন যা চায় নিয়ে যাক, আমি বাধা দিবোনা......। বিচারকের আদালতে চোরকে হাযির করা হলে এবং সাক্ষী-প্রমাণের মাধ্যমে চুরি প্রমাণিত হলে চোর যদি বলে তাকদীরে লিখা ছিল, তাই চুরি করেছি। পৃথিবীর মুসলিম-অমুসলিম কোন আদালত চোরের এই কথার কোন মূল্যায়ন করবেনা।

সুতরাং কোন মানুষের এই কথা বলা ঠিক নয় যে, তাকদীরে নামায লিখা নেই, তাই পড়ছিনা। তাকদীরে জাহান্নাম লিখা থাকলে নামায পড়েও লাভ হবেনা। আর তাকদীরে জান্নাত লিখা থাকলে নামায না পড়েও জান্নাতে যাওয়া যাবে। এটি কোন বিবেকবান মানুষের কথা হতে পারেনা। ইবলীস ছাড়া অন্য কেউ মানুষের মাথায় এই কথা জাগ্রত করেনা।

তাকদীরের মাসআলাটি অত্যন্ত বড়। সাহাবীদের জ্ঞানের পরিধি ছিল অত্যন্ত বিশাল। তাই তারা সহজভাবে মাসআলাটি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাহাবীদের যুগে সীমিত আকারে তাকদীরের বিষয়ে দু’একটি প্রশ্ন হলেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জবাব শুনে তাদের হৃদয় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। রাসূলের পবিত্র জবানীতে জবাব শুনে কেউ আমল বর্জন করেন নি; বরং আগের চেয়ে আরো বেশী আগ্রহ নিয়ে এবং জান্নাত লাভের আশায় সৎ আমলে মগ্ন হয়েছেন।

কিন্তু সাহাবীদের পরবর্তী যুগসমূহে তাকদীরের মাসআলায় বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েই আসছে। আলেমগণ তাদের জ্ঞান ও বোধশক্তি দিয়ে এবং বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে যুগে যুগে মানুষের সেই প্রশ্নগুলোর বিভিন্ন জবাব দিয়েই আসছেন। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে হেদায়াত করো এবং সেই পথে অবিচল রাখো। আমীন

[2] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।