ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ১২ - আল্লাহ তাআলার জন্য দু’টি চোখ সাব্যস্ত করা ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
আল্লাহ তাআলার জন্য দু’টি চোখ সাব্যস্ত করা

১২- إثبات العينين لله تعالى

১২- আল্লাহ তাআলার জন্য দু’টি চোখ সাব্যস্ত করা:

আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেন,

﴿وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ حِينَ تَقُومُ﴾

‘‘হে নবী! তোমার রবের ফায়সালা ও হুকুম আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করো৷ নিশ্চয়ই তুমি আমার চোখে চোখেই আছো। (সুতরাং কাফের-মুশরেকরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা) তুমি যখন উঠবে তখন তোমার রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করো’’। (সূরা আত-তূরঃ ৪৮)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿وَحَمَلْنَاهُ عَلَى ذَاتِ أَلْوَاحٍ وَدُسُرٍ تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَن كَانَ كُفِرَ﴾

‘‘আর নূহকে আমি কাষ্ঠফলক ও পেরেক সম্বলিত বাহনে আরোহন করিয়ে দিলাম, যা আমার চোখের সামনেই চলছিলো৷ এ ছিলো সেই ব্যক্তির জন্য প্রতিশোধ, যাকে অস্বীকার করা হয়েছিলো’’। (সূরা কামারঃ ১৩-১৪) আললাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَىٰ عَيْنِي﴾

‘‘আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’’। (সূরা তোহাঃ ৩৯)


ব্যাখ্যাঃ الصبر শব্দের আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া ও আটকিয়ে রাখা। দুঃখ-বেদনায় পড়ে বিরক্তি ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা থেকে নফস্কে আটকিয়ে রাখা, জবান দিয়ে অভিযোগ করা ও বিরক্তি প্রকাশ করা হতে জবানকে আটকিয়ে রাখা এবং হাত দিয়ে গালে চপেটাঘাত করা ও পরিহিত জামা বুকের দিক থেকে ছিড়ে ফেলা থেকে হাতকে আটকিয়ে রাখাকে শরীয়তের পরিভাষায় সবর বলা হয়। তোমার রবের ফয়সালা ও হুকুম আসা পর্যন্ত সবর করো। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিগত ফয়সালা ও শরীয়তের ফয়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنَا নিশ্চয়ই তুমি আমার চোখে চোখেই আছোঃ অর্থাৎ আমার দৃষ্টির সামনে এবং আমার হেফাযতের অধীনেই আছো। সুতরাং কাফেররা তোমাকে কষ্ট দিবে, -এই পরোয়া করোনা। কষ্ট দেয়ার জন্য তারা কখনোই তোমার নিকট পৌঁছতে পারবেনা।

আমি নূহকে কাষ্ঠফলক ও পেরেক সম্বলিত বাহনে আরোহন করিয়ে দিলামঃ অর্থাৎ লম্বা ও প্রশস্ত কাঠ দিয়ে তৈরী নৌকার মধ্যে তাকে উঠালাম। সেই কাষ্ঠগুলোতে অনেকগুলো পেরেক মেরে দেয়া হয়েছিল। دسر (পেরেক) শব্দটি دسار এর বহুবচন। নৌকাটি আমার চোখের সামনে দিয়েই পানির উপর চলছিল। অর্থাৎ আমার দৃষ্টি পড়ার স্থান দিয়ে এবং আমার হেফাযতেই চলছিল।

جَزَاءً لِّمَن كَانَ كُفِرَ এ ছিল সেই ব্যক্তির জন্য প্রতিশোধ যাকে অস্বীকার করা হয়েছিলোঃ অর্থাৎ আমি নূহ (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে নাজাত দিয়ে তাঁর জাতির অবিশ্বাসী লোকদের সাথে যেই আচরণ করেছিলাম এবং মহাপ্লাবনের পানিতে ডুবিয়ে মেরে যেই শাস্তি তাদেরকে দিয়েছিলাম তা মূলতঃ নূহ (আঃ)এর সাথে কুফুরী করার কারণে ও তাঁর আদেশ অমান্য করার কারণেই।

وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِّنِّي আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলামঃ এখানে মুসা (আঃ)কে সম্বোধন করে এই কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমি তোমার উপর আমার ভালবাসা স্থাপন করলাম এবং তোমাকে ভালবাসলাম। সেই সাথে আমার সৃষ্টির কাছেও তোমাকে প্রিয় করে দিলাম।

وَلِتُصْنَعَ عَلَىٰ عَيْنِي এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হওঃ অর্থাৎ আমার দৃষ্টির সামনেই যাতে তুমি প্রতিপালিত হও এবং ফিরাআউনের ঘরে তোমাকে যেন খাওয়ানো হয়, আমি তোমার জন্য সেই ব্যবস্থা করলাম। সেই সাথে সর্বদা আমি তোমাকে দেখছি, তোমার প্রতি আমার দৃষ্টি রাখছি এবং তোমাকে হেফাজত করছি।

উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে জানা গেল যে, তাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার মর্যাদা ও বড়ত্বের জন্য যেমন দু’টি চোখ শোভনীয়, তাঁর জন্য ঠিক সেরকমই দু’টি চোখ রয়েছে। কুরআনুল কারীমে العين (চোখ) শব্দটি আল্লাহর প্রতি একবচন ও বহুবচন এই উভয়ভাবেই مضاف (সম্বোধিত) হয়েছে। হাদীছেও এটিকে আল্লাহর প্রতি দ্বি-বচন হিসাবে সম্বোধিত হয়েছে। দাজ্জালের হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

(إِنَّ اللَّهَ لاَ يَخْفَى عَلَيْكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِأَعْوَرَ)

‘‘সে সময় আল্লাহর পরিচয় তোমাদের নিকট অস্পষ্ট থাকবেনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ অন্ধ নন’’।[1] এ কথা বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চোখের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এখানে সুস্পষ্ট যে, এই হাদীছের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য একচোখ সাব্যস্ত করা উদ্দেশ্য নয়। যার চোখ মাত্র একটি সে তো প্রকাশ্য কানা। আল্লাহ তাআলা এই দোষের অনেক উর্ধ্বে।

আরবদের ভাষায় مضاف إليه এর অবস্থা অনুপাতে مضاف কখনো একবচন, কখনো দ্বি-বচন আবার কখনো বহুবচন হয়। একবচনের اسم বা বিশেষ্যকে যদি একবচনের ضمير এর (সর্বনামের) দিকে ইযাফত (সম্বন্ধ) করা হয়, তাহলে সেই ইসমকেও একবচন ব্যবহার করতে হয়। যেমনঃ هذا قلمك এটি তোমার কলম। আর যদি বহুবচনের শব্দের দিকে ইযাফত করা হয়, চাই সে বহুবচন ইসমে যাহের হোক কিংবা সর্বনাম হোক, তাহলে শাব্দিক মিল রাখার জন্য সেই مضاف বা সম্বোধিত পদকে বহুবচন ব্যবহার করাই উত্তম। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا (আমার চোখসমূহের সামনেই নৌকাটি চলছিল)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا خَلَقْنَا لَهُم مِّمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَا أَنْعَامًا فَهُمْ لَهَا مَالِكُونَ﴾

‘‘এরা কি দেখে না, আমার নিজের হাতসমূহের তৈরী জিনিষের মধ্য থেকে এদের জন্য সৃষ্টি করেছি গবাদি পশু? এখন তো এরা সেগুলোর মালিক হয়ে গেছে’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৭১) আর যখন আরবরা তাদের ভাষায় দ্বি-বচনের শব্দকে অপর কোন দ্বি-বচনের শব্দের দিকে ইযাফত করে, তখন তারা বাক্যকে অধিকতর ফসীহ (সুস্পষ্ট) করার জন্য দ্বি-বচনকেও (মুযাফকেও) বহুবচন ব্যবহার করে থাকে। যেমনঃ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِن تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا وَإِن تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذَٰلِكَ ظَهِيرٌ﴾

‘‘তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর কাছে তাওবা করো (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম হবে)। কেননা তোমাদের মন সরল-সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে। আর যদি তোমরা নবীর বিরুদ্ধে পরস্পর সংঘবদ্ধ হও, তা হলে জেনে রাখো, আল্লাহ তার অভিভাবক, তাছাড়া জিবরীল, সৎকর্মশীল ঈমানদারগণ এবং সব ফেরেশতা তাঁর সাহায্যকারী’’। (সূরা তাহরীমঃ ৪) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুইজন স্ত্রীর অন্তর মাত্র দু’টি। দ্বি-বচনের শব্দকে দ্বি-বচনের দিকে ইযাফত করার কারণে দ্বি-বচন মুযাফকে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে।

সুতরাং نراك بأعيننا ونأخذك بأيديناআমরা তোমাকে চোখ দিয়ে দেখছি এবং হাত দিয়ে ধরে রাখছি, -কারো এই কথা কোন শ্রোতারই বুঝতে অসুবিধা হয়না। এ থেকে পৃথিবীর কোন মানুষই এই কথা থেকে বুঝেনা যে, একটি চেহারায় অনেকগুলো (দুইএর অধিক) চোখ থাকে।

[1] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তাওহীদ, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।