ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হোদায়বিয়া সন্ধির গুরুত্ব (أهمية صلح الحديبية)

(১) হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা এবং নিঃসন্দেহে তা ছিল মুসলমানদের জন্য স্পষ্ট বিজয়। কারণ ইতিপূর্বে কুরায়েশরা আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের ধর্মীয় ও পার্থিব নেতৃত্বের একচ্ছত্র অধিকারী বলে সর্বদা গর্ব অনুভব করত। আর সেকারণে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তিকে তারা আমলেই নিত না। কিন্তু হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে তারা এই প্রথম রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে মদীনার ইসলামী শক্তিকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দিল। চুক্তির তৃতীয় ধারাটির মাধ্যমে একথাটি স্পষ্টভাবেই স্বীকার করা হয়েছে।

(২) আগামী দশ বছরের জন্য ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তিটাই ছিল প্রকৃত অর্থে মুসলিম শক্তির জন্য ‘স্পষ্ট বিজয়’(فَتْحٌ مُبِينٌ)। কেননা সর্বদা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে কোন আদর্শই যথার্থভাবে সমাজে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই চুক্তির ফলে কাফিরদের সাথে যোগাযোগ সহজ হয় এবং তাদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াতের পথ খুলে যায়। এতে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে। অতএব নির্বিঘ্ন প্রচারের সুযোগ লাভের স্বার্থে এবছর ওমরাহ না করে ফিরে যাবার মত অবমাননাকর শর্ত মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও শান্তিপ্রিয়তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। এতে ফল হ’ল এই যে, পরের বছর ক্বাযা ওমরাহ করার সময় ২০০০ এবং তার দু’বছর পর মক্কা বিজয়ের সময় ১০,০০০ মুসলমান রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী হন।

(৩) যুদ্ধই যে সবকিছুর সমাধান নয়, বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব, এ সন্ধি তার বাস্তব প্রমাণ। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) শক্তিশালী অবস্থানে থেকেও এবং কুরায়েশদের শত উসকানি সত্ত্বেও তিনি সর্বদা যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছেন। তিনি নিজেই অগ্রণী হয়ে ওছমান (রাঃ)-কে কুরায়েশ নেতাদের কাছে দূত হিসাবে পাঠিয়েছেন। এর দ্বারা ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এবং তিনি যে বিশ্ব মানবতার জন্য শান্তির দূত(رَحْمَةٌ لِّلْعَالَمِيْن) হিসাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন (আম্বিয়া ২১/১০৭), তিনি সেটারই স্বাক্ষর রেখেছেন। কেননা মুসলমান তার জীবন ও সম্পদ সবকিছুর বিনিময়ে দুনিয়াতে স্রেফ আল্লাহর খেলাফত ও তাঁর বিধানাবলীর প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়। গণীমত লাভ বা বাদশাহী করা তাদের জীবনের লক্ষ্য নয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই মহাকবি ইকবাল বলেন,

شہادت ہے مطلوب ومقصود مؤمن

نہ مال غنيمت نہ كشور كشائي

‘মুমিনের লক্ষ্য হ’ল শাহাদাত লাভ। গণীমত বা বাদশাহী লাভ করা নয়’।[1]

(৪) প্রথম দফাটি মুসলিম পক্ষের জন্য অবমাননাকর মনে হ’লেও এতে পরের বছর নিরাপদে ওমরাহ করার গ্যারান্টি ছিল। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর স্বপ্ন স্বার্থক হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

(৫) হোদায়বিয়ার সন্ধির চার দফা চুক্তির মধ্যে কুরায়েশগণ মুসলমানদের তিনটি বিষয়ে সুযোগ দানের বিনিময়ে নিজেরা মাত্র একটি সুযোগ লাভ করে। মুসলমানদের তিনটি সুযোগ হ’ল : পরের বছর ওমরাহ করার নিশ্চয়তা, আগামী দশ বছর যুদ্ধ না করা এবং সাধারণ আরব গোত্রগুলিকে মুসলিম পক্ষে যোগদানের সুযোগ প্রদান করা। পক্ষান্তরে কুরায়েশরা সুযোগ লাভ করেছিল কেবল চতুর্থ দফার মাধ্যমে। যাতে বলা হয়েছে যে, তাদের কেউ পালিয়ে গিয়ে মুসলিম পক্ষে যোগ দিলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এটা ছিল নিতান্তই গুরুত্বহীন। কেননা এভাবে প্রকাশ্যে যারা হিজরত করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা এটা করে। আবু জান্দাল, আবু বাছীর, সুহায়েল বিন আমর প্রমুখের ঈমানী জাযবাকে এই চুক্তি দিয়ে আটকে রাখা যায়নি। তারা সিরিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রোপকূলে ঈছ (العِيْص) পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের নিয়ে দল গঠন করে ও কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলার জন্য কঠিন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এক বছরের মধ্যে সেখানে প্রায় তিনশ মুসলমান জমা হয়ে যায়। ফলে এই ধারাটি অবশেষে কুরায়েশদের বিপক্ষে চলে যায় এবং তারা মদীনায় গিয়ে উক্ত ধারা বাতিলের আবেদন জানায় (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫১)। এভাবে কার্যতঃ চুক্তির ৪র্থ ধারাটি বাতিল গণ্য হয়।

পরের বছর অর্থাৎ ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে ওছমান বিন ত্বালহা, খালেদ বিন অলীদ ও আমর ইবনুল ‘আছ-এর মত সেরা ব্যক্তিগণ মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন।[2] এছাড়াও গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা ছিল অগণিত। যারা মক্কা বিজয়ের পরে নিজেদের প্রকাশ করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ফলাফলের বিচারে পুরা চুক্তিটাই মুসলমানদের পক্ষে চলে গেছে। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর গভীর দূরদৃষ্টির পরিচয় ফুটে ওঠে। হোদায়বিয়ার সন্ধি তাই নিঃসন্দেহে ছিল ‘ফাৎহুম মুবীন’ বা স্পষ্ট বিজয়। যা শুরুতে ওমরের মত দূরদর্শী ছাহাবীরও বুঝতে ভুল হয়েছিল।

[1]. আর-রাহীকুল মাখতূম (উর্দূ) ৫৬০ পৃঃ। প্রকাশকের বক্তব্য মতে উর্দূ সংস্করণটি লেখকের নিজহাতে অনূদিত ও সম্পাদিত হয়েছে (প্রকাশক : মাকতাবা সালাফিইয়াহ, শীশমহল রোড, লাহোর ৩য় সংস্করণ ১৪০৯ হি./১৯৮৮ খৃ.)। কবিতাটি আরবী সংস্করণে নেই।

[2]. আর-রাহীক্ব ৩৪৭-৪৮ পৃঃ।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এঁদের দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেছিলেন, هَذِهِ مَكَّةُ قَدْ أَلْقَتْ إلَيْكُمْ أَفْلاَذَ كَبِدِهَا ‘মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে আমাদের কাছে সমর্পণ করেছে’ (আর-রাহীক্ব ৩৪৮ পৃঃ; সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/৮৮)। বক্তব্যটি সনদ বিহীন।