ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ প্রথম পর্ব - তাওহীদ ও ঈমান মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত্তুওয়াইজিরী
৩. ইবাদত

ইবাদতের অর্থ:

ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালা। ইবাদত শব্দটি দু’টি জিনিসের উপর প্রয়োগ হয়:

প্রথম: ইবাদত করা: মহব্বত ও সম্মানের সথে আল্লাহর আদেশসমূহের বাস্তবায়ন ও নিষেধসমূহ বর্জন করে তাঁর জন্য নিজেকে বিলিন ও অবনত করা।

দ্বিতীয়: যার দ্বারা ইবাদত করা হয়: আর তা কথা হোক বা কাজ হোক, প্রকাশ্য হোক বা গোপনীয় হোক যা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং করলে খুশি হন। যেমন: দোয়া, জিকির, সালাত, ভালোবাসা ইত্যাদি। সুতরাং, সালাত একটি ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা হয়। আমরা অবনত হয়ে এবং মহব্বত করে ও সম্মানের সঙ্গে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করব। আর শুধুমাত্র তাঁর শরিয়ত সম্মতই ইবাদত করব।


জ্বিন ও ইনসান সৃষ্টির হিকমত:

আল্লাহ জ্বিন-ইনসানকে অযথা সৃষ্টি করেন নাই। পানাহার, খেলাধুলা ও হাসি-তামাশা করার জন্য সৃষ্টি করেন নাই। বরং তাদের সৃষ্টি করেছেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে, তাঁরই মহত্ব গাইবে এবং তাঁরই আনুগত্য করবে। তাঁর নির্দেশসমূহ মানবে এবং নিষেধসমূহ ত্যাগ করবে। তাঁর দেয়া সীমারেখা লঙ্ঘন করবে না। আর অন্য সবার ইবাদত ত্যাগ করবে। যেমন: আল্লাহ তা‘য়ালা এরশাদ করেন:

وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ﴿۵۶﴾

‘‘আমি জ্বিন ও ইনসানকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’’ [সূরা যারিয়াত: ৫৬]

 

ইবাদতের হিকমত:

আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে তাঁর সমস্ত নির্দেশ পালন ও নিষেধ ত্যাগ করা। আর সর্বদা সৃষ্টিকর্তা ও অন্তরের মালিকের ধিয়ান করা। ইহা আল্লাহর বেশি বেশি জিকির ও সব সময় অন্তরে তাঁর ধিয়ান এবং ইবাদতের মাধ্যমে হওয়া সম্ভব। আর যখন ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং শক্তিশালী হয় তখন তার আমলও বৃদ্ধি পায় ও মজবুত হয়। এরপর দুই জগতের সাফলতার দ্বারা সকল অবস্থা সঠিক হয়ে যায়। আর বিপরীত হলে বিপরীত দাঁড়ায়।

আল্লাহর তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَاالَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوا اللّٰهَ ذِکۡرًا کَثِیۡرًا﴿ۙ۴۱﴾  وَّ سَبِّحُوۡهُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿۴۲﴾


‘‘মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। আর সকাল-বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।’’ [সূরা আহজাব:৪১-৪২]

আল্লাহর তা‘য়ালার বাণী:

وَ لَوۡ اَنَّ اَهۡلَ الۡقُرٰۤی اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ بَرَکٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ کَذَّبُوۡا فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۹۶﴾

‘‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং আল্লাহভীরু হত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে।’’ [সূরা আ‘রাফ: ৯৬]


ইবাদতের পদ্ধতি:

আল্লাহর ইবাদত দু’টি বিশাল মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত:

(১) আল্লাহ তা‘য়ালার পরিপূর্ণ ভালোবাসা।  

(২) আল্লাহর জন্য নিজেকে পূর্ণ অবনত মস্তকে বিলিন করা।

এ দু’টি মূলনীতি আবার অন্য দু’টি বড় মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, আর তা হলো:

(এক) আল্লাহর অনুকম্পা, এহসান, দয়া ও দানসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যা ভালোবাসাকে অপরিহার্য করে দেয়।

(দুই) আত্মা ও আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি লক্ষ্য করা, যা দ্বারা জন্ম নেয় আল্লাহর জন্য অবনতি হওয়া ও নিজেকে বিলিন করা।

আর সব চাইতে নিকটের দরজা যার দ্বারা বান্দা তার রবের নিকট পৌঁছতে পারে তা হলো মুখাপেক্ষীর দরজা। নিজেকে গরিব-মিসকিন ভাবা এবং নেই কোন উপায়-উপান্ত ও নেই কোন পন্থা ও অসিলা এমন ভেবে নিজেকে বিলিন করে দেয়া। এ ছাড়া পূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহর প্রয়োজন বোধ করা এবং তিনি ব্যতীত সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবে মনে করা।

১. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ مَا بِکُمۡ مِّنۡ نِّعۡمَۃٍ فَمِنَ اللّٰهِ ثُمَّ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فَاِلَیۡهِ تَجۡـَٔرُوۡنَ ﴿ۚ۵۳﴾


‘‘তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। অত:পর তোমরা যখন দু:খ-কষ্টে পতিত হও তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর। ’’ [সূরা নাহা্ল: ৫৩]

২. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ اِلَی اللّٰهِ ۚ وَ اللّٰهُ هُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۱۵﴾

‘‘হে মানুষ সমাজ! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’’ [সূরা ফাতির:১৫]


ইবাদতের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মানুষ:

নিঃসন্দেহে নবী-রসূলগণ (আঃ) আল্লাহর পরিপূর্ণ বান্দা; কারণ তাঁরা আল্লাহ সম্পর্কে সবার চেয়ে বেশি জানেন। তাঁরা অন্যদের চেয়ে তাঁকে বেশি তা‘যীম তথা সম্মান করেন। এর অতিরিক্ত আল্লাহ তাঁদেরকে মানুষের নিকটে রসূল হিসেবে প্রেরণ করে আরো তাঁদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের রেসালাতের ফজিলত তার সঙ্গে বিশেষ উবূদিয়্যাত তথা বন্দেগীর ফজিলতও সমন্বয় ঘটেছে।

এঁদের পরে স্থান হলো সিদ্দিকীনদের, যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্য পূর্ণ সত্যতা লাভ করেছে। যার ফলে তাঁরা আল্লাহর আদেশসমূহে অটল ও অনড়। এরপর স্থান হলো শহীদগণের। এরপর সলেহীন তথা সৎ ও নেক লোকদের।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ فَاُولٰٓئِکَ مَعَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیۡقِیۡنَ وَ الشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیۡنَ ۚ وَ حَسُنَ اُولٰٓئِکَ رَفِیۡقًا ﴿ؕ۶۹﴾


‘‘আর যারা আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করবে, তারা ওদের সঙ্গী হবে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাঁদের কতই না উত্তম সঙ্গী।’’ [ সূরা নিসা: ৬৯]


বান্দার প্রতি আল্লাহর হক (অধিকার):

আসমান ও জমিনবাসীদের উপর আল্লাহর হক হলো: তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। তাঁর আনুগত্য করবে, নাফরমানি ও অবাধ্যতা করবে না। তাঁকে সর্বদা স্মরণ করবে কখনো ভুলে যাবে না। তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে কখনো অকৃতজ্ঞতা করবে না। আর যার জন্য সৃষ্ট (ইবাদত) তার বিপরীত কিছু সংঘটিত হওয়াটা হয়তো অপারগতা কিংবা অজ্ঞতা আর না হয় বাড়াবাড়ি ও অবহেলার কারণে হয়ে থাকে।

তাই তো আল্লাহ আসমান ও জমিনবাসীকে আজাব দিলে তাতে তিনি কোন প্রকার জুলুমকারী হবেন না। আর যদি তাদের প্রতি দয়া করেন তাহলে তা হবে তাঁর পক্ষ থেকে তাদের উপর বিশেষ রহমত যা কাজের চেয়ে অনেক বেশি।


عَنْ مُعَاذٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: كُنْتُ رِدْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى حِمَارٍ يُقَالُ لَهُ عُفَيْرٌ فَقَالَ:্র يَا مُعَاذُ هَلْ تَدْرِي حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ ؟ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلَا يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لَا يُعَذِّبَ مَنْ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ: أَفَلَا أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ ؟ قَالَ: لَا تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا .متفق عليه.

মু‘য়ায ইববে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি নবী (সা.)-এর পিছনে ‘উফায়ের নামের গাধার উপর বসে ছিলাম। তখন তিনি (সা.) বলেন: ‘‘হে মু‘য়ায! তুমি কি জানো আল্লাহর হক তাঁর বান্দার উপর এবং বান্দার হক আল্লাহর উপর কি? মু‘য়ায (রাঃ) বলেন আমি বললাম: এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলই বেশি জানেন। রসূল (সা.) বলেন: বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো: একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো: যে তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক করে না তাকে শাস্তি না দেয়া। মু‘য়ায (রাঃ) বলেন: আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এ ব্যাপারে মানুষকে সুসংবাদ প্রদান করি? তিনি (রসূল সা.) বলেন: তাদের সুসংবাদ দিও না; কারণ তারা হাত-পা গুটিয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে কাজ-কর্ম ও ইবাদত করা ছেড়ে দেবে।’’[1]


পূর্ণ দাসত্ব ও বন্দেগি:

প্রতিটি বান্দা তিনটি অবস্থার মধ্যে আবর্তন বিবর্তন করতে থাকে: (এক) আল্লাহর প্রচুর নেয়ামতের মধ্যে, যার ফলে আল্লাহর শুকরিয়া ও প্রশংসা করা বান্দার জন্য ওয়াজিব। (দুই) পাপকাজে লিপ্ত যার জন্য তওবা ও ক্ষমা চাওয়া ওয়াজিব। (তিন) আপদ-বিপদে যার দ্বারা আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করেন। সে মুহূর্তে ধৈর্যধারণ করা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি এ তিনটি ওয়াজিব আদায় করবে সে দুনিয়া ও আখেরাতে নিশ্চই সফলকামী হবে।  

আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন তাদের ধৈর্যশক্তি ও দাসত্বের পূর্ণতা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে। তাদের ধ্বংস ও শাস্তি দেয়ার জন্য নয়। তাই বান্দার বিপদকালে যেমন আল্লাহর পূর্ণ বন্দেগি করা জরুরি তেমনি ভালো অবস্থাতেও পূর্ণ বন্দেগি করা একান্ত প্রয়োজন। পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুতে আল্লাহর বন্দেগি করা জরুরি। আর বেশির ভাগ মানুষ পছন্দে পূর্ণ গোলামি করে কিন্তু আসলে কঠিন সময়েও পূর্ণ বন্দেগি করাই হলো জরুরী। বন্দেগিতে বান্দারা সবাই সমান নয় বরং তাদের মাঝে কম-বেশি রয়েছে। ধরা যাক ওযু যা প্রচন্ড গরমে ঠান্ডা পানি দ্বারা করা এক প্রকার ইবাদত। পরম সুন্দরী নারীকে বিবাহ করাও একটি ইবাদত। অনুরূপ প্রচন্ড শীতে ঠান্ডা পানি দ্বারা ওযু করা ইবাদত। যে পাপ কাজ করতে আত্মা উৎসাহি তা মানুষের ভয়েও নয় বরং ইচ্ছা করেই ত্যাগ করাও বন্দেগি। ক্ষুধা ও কষ্টে ধৈর্যধারণ করাও দাসত্ব। কিন্তু এ দু’প্রকার বন্দেগির মাঝে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান।

অতএব, যে ব্যক্তি সুখে-দুঃখে ও পছন্দে-অপছন্দে সর্বাবস্থায় আল্লাহর বন্দেগি করতে পারে, তিনিই আল্লাহর সেই বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হন যাদের নেই কোন ভয়-ভীতি ও চিন্তা। আর তার উপর শত্রুদের নেই কোন শক্তি; কারণ আল্লাহই তার হেফাজতকারী। কিন্তু কখনো শয়তান তাকে ধ্বংস করে ফেলে। বান্দা কখনো গাফলতি-অমনোযোগী, মনপূজারী তথা কামনা-বাসনায় ও রাসে নিপতিত হয়, যার ফলে শয়তান তার মাঝে এ তিনটি দরজা দ্বারা প্রবেশ করে বসে। আল্লাহ পরীক্ষা করার নিমিত্তে প্রতিটি বান্দার উপর তার প্রবৃত্তি ও শয়তানকে শক্তি প্রদান করে দিয়েছেন। এ কথা জানা ও দেখার জন্যে যে, সে তার প্রতিপালকের আনুগত্য করছে না নাফরমানি করছে।

کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ نَبۡلُوۡکُمۡ بِالشَّرِّ وَ الۡخَیۡرِ فِتۡنَۃً ؕ وَ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۳۵﴾

‘‘আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’’ [সূরা আম্বিয়া:৩৫]

মানুষের উপর আল্লাহর যেমন নির্দেশ রয়েছে তেমনি তার প্রবৃত্তিরও নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তা‘য়ালা চান মানুষ তার ঈমান ও সৎকর্ম পূর্ণ করুক। আর প্রবৃত্তি চায় সম্পদ ও কামনা-বাসনা পূর্ণ করুক। আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের থেকে চান আখেরাতের কাজ আর প্রবৃত্তি চায় দুনিয়াবী কাজ।

স্মরণ রাখতে হবে যে, কেবলমাত্র শক্তিশালী ঈমানই নাজাতের রাস্তা ও আলোর বাতি যার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার মাধ্যে পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। আর ইহাই হলো পরীক্ষাগার।

১. আল্লাহর বাণী:

اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ هُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۲﴾ وَ لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡکٰذِبِیۡنَ ﴿۳﴾


‘‘মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যহতি পেয়ে যাবে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি, তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বের ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয় জেনে নিবেন মিথ্যুকদের।’’ [ সূরা আনকাবূত: ২-৩]

 

২. আরো আল্লাহর বাণী:

وَ مَاۤ اُبَرِّیٴُ نَفۡسِیۡ ۚ اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ ؕ اِنَّ رَبِّیۡ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۵۳﴾

‘‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মন মন্দ কর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয় যার প্রতি আমার পালনকর্তা অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সূরা ইউসুফ: ৫৩]


বন্দেগির সঠিক বুঝ:

জমিন মিষ্টি ও তিতা সবধরণের ফলের গাছ রোপণের জন্য উপযুক্ত। আর ফিতরৎ তথা দ্বীনের মূল স্বভাব সেখানে যে কোন গাছ লাগানোর জন্য এক মুক্তাঙ্গন। অতএব, যে তাতে ঈমান ও তাকওয়ার গাছ লাগাবে সে চিরস্থায়ী স্বাদের ফল পাড়বে। আর যে কুফরি, অজ্ঞতা ও পাপের গাছ লাগাবে সে চিরস্থায়ী দুঃখের ও অনীষ্টের ফল পাড়বে।


মনে রাখতে হবে যে, সবচেয়ে যার জ্ঞান রাখা বেশি প্রয়োজন তা হলো: আপনার প্রতিপালকের পরিচয় এবং তাঁর ব্যাপারে যা ওয়াজিব তা জানা। যার ফলে মহান আল্লাহর ব্যাপারে আপনি জ্ঞানে অজ্ঞতা--, কাজে অবহেলা--, প্রবৃত্তির ত্রুটি, আল্লাহর হকে শিথিলতা--- ও লেনদেনে জুলুম করেন তা স্বীকার করতে পারবেন।

বান্দা যদি কোন নেকির কাজ করে তাহলে ভাবে ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ। আল্লাহ যদি তা কবুল করে নেন তাহলে দ্বিতীয় অনুগ্রহ। আর যদি দ্বিগুণ বর্ধিত করেন তাহলে তৃতীয় অনুগ্রহ। কিন্তু যদি প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে এরূপ আমল গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হবে।

আর যদি বান্দা কোন পাপ করে তাহলে মনে রাখতে হবে যে, তার প্রতিপালক তাকে ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার হেফাজতের রশির বন্ধন কেটে ফেলেছেন। আর যদি তার পাপের জন্য তাকে পাকড়াও করেন তাহলে ইহা তাঁর ইনসাফ। কিন্তু যদি পাকড়াও না করেন তাহলে ইহা তাঁর অনুগ্রহ। আর যদি মাফ করে দেন তাহলে ইহা বান্দার প্রতি তাঁর বিশেষ এহসান ও অনুকম্পা।

আসমান-জমিনে যতকিছু সবই আল্লাহর বান্দা। প্রতিটি মানুষের স্বীকার করা ওয়াজিব যে, সে সৃষ্টিগত ও শরিয়তগতভাবে আল্লাহর বান্দা। আপনি তাঁরই বান্দা; কারণ তিনিই আপনার সৃষ্টিকর্তা, আপনার মালিক, আপনার সকল বিষয়ের মহাব্যবস্থাপক। আর আপনি তাঁর বান্দা চাইলে দিবেন আর না চাইলে দিবেন না। তিনি চাইলে আপনাকে ধনী বানাবেন আর চাইলে গরিব বানাবেন। তিনি চাইলে আপনাকে হেদায়েত দান করবেন আর চাইলে পথভ্রষ্ট করবেন। তিনি তাঁর হিকমত ও দয়ার দাবি মোতাবেক যা চাইবেন অপনার জন্যে তাই করবেন। শরিয়তগতভাবে আপনি তাঁর বান্দা; তাই তিনি যা বিধিবিধান করেছেন সে অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করা আপনার প্রতি ওয়াজিব। তাঁর নির্দেশসমূহ আদায় করবেন ও নিষেধসমূহ ত্যাগ করবেন এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবেন যার ফলে দুনিয়া ও আখেরাতে সুখী হবে।


সমস্ত সৃষ্টিজীব আল্লাহর মুখাপেক্ষী:

তাদের মুখাপেক্ষীতা দুই প্রকার:

বাধ্যগত মুখাপেক্ষীতা - ইহা সমস্ত সৃষ্টিকুলের প্রতিপালকের মুখাপেক্ষীতা, তাদের অস্তিত্ব, চলাফেরা এবং যা তাদের প্রয়োজন তার জন্য।
নির্বাচিত মুখাপেক্ষীতা - আর ইহা দু’টি জিনিস জানার ফলাফল: বান্দার তার প্রতিপালকের পরিচয় জানা ও বান্দার তার নিজের পরিচয় জানা। অতএব, যে তার প্রতিপালককে সর্বতভাবে অমুখাপেক্ষী জানবে সে নিজেকে সর্বতভাবে মুখাপেক্ষী জানতে পারবে এবং বন্দেগির দরজাকে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করা পর্যন্ত নিজের প্রতি জরুরি করে নেবে।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ اِلَی اللّٰهِ ۚ وَ اللّٰهُ هُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۱۵﴾

‘‘হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’’ [সূরা ফাতির:১৫] 

[1]. বুখারী হাঃ নং ২৮৫৬ ও মুসলিম হাঃ নং ৩০