ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা পঞ্চম অধ্যায়: অবিশ্বাস ও বিভ্রান্তি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৫. ৫. ৩. শিরকের সেকাল ও একাল

শিরক বিষয়ক আলোচনা থেকে আমরা কুরআনে বর্ণিত মুশরিকদের শিরকের সাথে মুসলিম সমাজের শীয়াগণ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত বা অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী বা পার্শবর্তী ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত শিরকে লিপ্ত মানুষদের চিন্তা, যুক্তি ও কর্মের মধ্যে আমরা অদ্ভুৎ মিল দেখতে পাই।

(১) সকলেই আল্লাহকে একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রতিপালক হিসেবে বিশ্বাস করেন। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কারো কোনো ক্ষমতা নেই বলে স্বীকার করেন।

(২) সকলেরই শিরকের ভিত্তি এই যে, মহান আল্লাহ তাঁর কিছু বান্দাকে বিশেষভাবে ভালবেসে তাঁদেরকে কিছু অলৌকিক মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা দিয়েছেন এবং তাদের সুপারিশ তিনি ফেলেন না। এরূপ বান্দাদের ডাকলে তাঁরা তা শুনতে ও জানতে পারেন এবং নিজেদের ক্ষমতায় বা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। এদের ডাকলে আল্লাহ খুশি হন এবং এদের ডাকলে এরা বান্দাকে আল্লাহ বেলায়াত বা নৈকট্য লাভ করিয়ে দেয়।

(৩) আল্লাহর ‘প্রিয় বান্দা’ নির্ধারণও সকলের ক্ষেত্রে একইরূপ: ওহীর মাধ্যমে পরিজ্ঞাত কিছু সত্যিকার আল্লাহর প্রিয় বান্দার পাশাপাশি অনেক কল্পিত ব্যক্তিত্বকে এরা ‘আল্লাহর প্রিয়’ বলে দাবি করে।

(৪) সকলেরই দলীল দু‘আ ও শাফা‘আত বিষয়ক ওহীর নির্দেশনার বিকৃতি, মুজিযা বিষয়ক ভুল ধারণা, কিছু যুক্তি, কল্পনা, দাবি এবং লোকাচার।

(৫) শিরকের অযৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় কুরআনের যে সকল যুক্তি ও বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি তা সবই পূর্ববর্তী মুশরিকদের মত একইভাবে মুসলিম সমাজের মধ্যে বিদ্যমান শিরকে লিপ্ত মানুষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখানে আমরা শুধু একটি আয়াত পর্যালোচনা করব।

(৬) আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘বল, তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? তারা পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে তা আমাকে দেখাও, অথবা আকাশমন্ডলীর সৃষ্টিতে তাদের কোন অংশ আছে কি? না কি আমি তাদেরকে কোন কিতাব দিয়েছি (ওহীর জ্ঞান দান করেছি) যার প্রমাণের উপর তারা নির্ভর করে? বস্ত্তত জালিমরা একে অপরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।’’[1]

(৭) সাধারণ মানবীয় বুদ্ধি, বিবেক ও যুক্তির তো দাবি এই যে, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা, প্রতিপালক ও সকল ক্ষমতার মালিক তাকেই একমাত্র ডাকতে হবে এবং ইবাদত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, নবীগণ, ফিরিশতাগণ, সত্যিকার বা কাল্পনিক ওলীগণ বা কাল্পনিক দেব-দেবিগণ যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে বিপদে আপদে আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকা হয় তাদের ডাকার পিছনে যৌক্তিকতা বা দলিল কি? এদের মধ্যে যারা ফিরিশতা, নবী বা সত্যিকার নেককার মানুষ তাঁদেরকে ভালবাসতে হবে এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে হবে। কিন্তু তাদেরকে ডাকতে হবে কেন? তাদের নামে মানত করতে হবে কেন? তারা কি বিশ্বের কোনো কিছু সৃyুষ্ট করেছেন? সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছে যে, তারা কোনোকিছুই সৃষ্টি করেন নি, বরং মহান আল্লাহই মহাবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক। এতে স্বাভাবিক বিবেক ও বুদ্ধি দ্বারা যে কোনো জ্ঞানী মানুষ স্বীকার করবেন যে, মহান আল্লাহই যেহেতু একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক ও সকল ক্ষমতার মালিক, তাহলে তাকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করা বা বিপদে আপদে অন্য কাউকে ডাকা বিবেক-বিরুদ্ধ ও অর্থহীন।

মুসলিম সমাজের যাদের ইবাদত করা হয় বা বিপদে আপদে যাদের ডাকা হয় যেমন আলী (রাঃ), ফাতিমা (রাঃ), পাক-পাঞ্জাতন, আলী বংশের ইমামগণ, ‘গাওস’, ‘কুতুব’ বা অন্যান্য নামে পরিচিত বিভিন্ন ওলী-আল্লাহগণ এদের বিষয়েও একই প্রশ্ন এবং উত্তরও একই।

(৭) এরপর ওহীর প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। যুক্তি ও বিবেকের দাবি যে, একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালককেই ইবাদত করতে হবে। তবে তিনি যদি ওহীর মাধ্যমে বলে দেন যে, আমার ইবাদতের প্রয়োজন নেই, আমার নৈকট্য পেতে হলে আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের ইবাদত কর, তারা তোমাদেরকে আমার নৈকট্য পাইয়ে দেবে, অথবা আমার কাছে সরাসরি কিছু চাইলে তা পাওয়া যাবে না, বরং আমার প্রিয় বানদাদের নিকট তোমাদের আব্দার পেশ করবে, তারা আমার কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশ করবে। যদি এরূপ কোনো নির্দেশ তিনি সুস্পষ্টভাবে দিতেন তবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকার, মানত করার বা সাজদা করার বৈধতা প্রমাণিত হতো। কিন্তু কখনোই মুশরিকগণ এরূপ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। কুরআনে এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বারংবার বলা হয়েছে যে, আল্লাহর সাথে শিরক করো না, যে বিষয়ে তিনি কোনো ‘সুলতান’ বা সুস্পষ্ট প্রমাণ নাযিল করেন নি।[2]  আর আল্লাহর সাথে শিরক করার মত যুক্তি, বিবেক ও ওহী বিরুদ্ধ কাজ ওহীর সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া করার অর্থ আল্লাহর নির্দেশের সাথে কুফরী করা।

(৮) মুসলিম সমাজের যে সকল মানুষে শিরকে লিপ্ত তাদের অবস্থাও একই। তারা কখনোই কুরআন-হাদীস থেকে একটি নির্দেশনাও দেখাতে পারেন না যে, মহান আল্লাহ তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ডাকতে, সাহায্য চাইতে, সাজদা করতে, অন্য কারো নামে মানত, উৎসর্গ করতে বা অন্য কাউকে ইবাদত করতে কোনোরূপ নির্দেশ বা অনুমতি দিয়েছেন। কিছু বিকৃতি, অপব্যাখ্যা, যুক্তি, কল্পনা বা গল্পকাহিনী তাদের সম্বল।

(৯) উপরের আয়াতে সবশেষে তাদের শিরকের প্রকৃত অবস্থা মহান আল্লাহ জানিয়েছেন। বস্ত্তত মুশরিকগণ একে অপরকে তাদের মিথ্যা কল্পনা ভিত্তিক প্রসূত প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। তোমরা এদের ইবাদত কর, এদের কাছে প্রার্থনা কর, এদেরকে ডাক, এরা তোমাদের ত্রাণ করবে, আখিরাতে মুক্তি দেবে ইত্যাদি মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই তাদের একমাত্র সম্বল। এর পাশাপাশি জিন ও মানুষ শয়তানের প্রচারিত জনশ্রুতি ও কিংবদন্তী: ‘‘অমুক বিপদে পড়ে বাবা অমুক, মা অমুক, সেন্ট বা সান্তা অমুককে ডেকেছিল, অমনি সে তাকে উদ্ধার করে দিয়েছে।’’ এগুলিই মুশরিকদের সম্বল।

(১০) মুসলিম কেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে ডাকবেন? মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি সবকিছু দেখেন, জানেন, শুনেন। তিনি দয়াময় এবং তিনি বান্দাকে তার মায়ের চেয়েও ভালবাসেন। তিনি প্রদান করলে কেউ ঠেকাতে পারে না এবং তিনি ঠেকালে কেউ দিতে পারে না। তাঁকে ডাকলে এবং তাঁর কাছে চাইলে তিনি খুশি হন এবং এবং সাড়া দেন। তাহলে আমি কেন তাকে ছেড়ে অন্যকে ডাকব? আমরা  প্রতিদিন বারংবার ‘ইয়্য়াকা না’বুদু ওয়া ইয়্য়াকা নাস্তা‘ঈন’ (إياك نعبدُ وإياك نستعين) বলে ঘোষণা করি যে: একমাত্র তাঁরই কাছে আমরা সাহায্য চাই। তবে কেন আমরা অন্যকে ডাকব? মহান আল্লাহ বারংবার বলেছেন একমাত্র তাঁকেই ডাকতে। এর বিপরীতে কোথাও তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ডাকতে অনুমতি দেন নি। এরপরও আমরা কেন অন্যকে ডাকব বা অন্যের কাছে ত্রাণ চাইব?

(১১) তাবিল-ব্যাখ্যা করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) নির্দেশ অমান্য করা হলো ইবলিসের প্রতারণার মূল সূত্র। মহান আল্লাহ বলেন:

فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُورِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآَتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِينَ وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِينَ

‘‘অতঃপর শয়তান তাদের গোপনকৃত লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, ‘পাছে তোমরা উভয়ে ফিরিশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা স্থায়ী হও এ জন্যই শুধু তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে এ বৃক্ষ সম্বন্ধে নিষেধ করেছেন। সে তাদের উভয়ের নিকট শপথ করে বলে যে, আমি অবশ্যই তোমাদের একজন হিতাকাংক্ষী।’’[3]

এখানে শয়তান আদম ও হাওআ (আঃ)-কে এ কথা বলে নি যে, আল্লাহর আদেশ মানার দরকার নেই। বরং সে বলেছে যে, আল্লাহর আদেশ অবশ্যই মানতে হবে, তবে আল্লাহর আদেশের ‘ইল্লাত’ কারণ, হেকমত ও রহস্যটা জানতে হবে এবং সে অনুসারে কাজ করতে হবে। এখানে আল্লাহ তোমাদেরকে ফল খেতে নিষেধ করেছেন কারণ এ ফল খেলে তোমরা ফিরিশতা হয়ে যাবে এবং জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। এখন যদি তোমরা জান্নাতে স্থায়ী থাকতে চাও তবে এ ফল খেতে পার। পাশাপাশি সে আল্লাহর কসম করে বলে যে, কেবলমাত্র তাদের ভালর জন্যই সে কষ্ট করে এ বুদ্ধি দিয়েছে....।

সকল যুগেই শয়তান এভাবেই আদম সন্তানদেরকে প্রতারণা করছে। মহান আল্লাহ সকল বিপদে আপদে একমাত্র তাঁকে ডাকতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ডাকতে নিষেধ করেছেন। এখন শয়তান বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলছে, অমুক তমুক কারণে তা করা যেতে পারে। শিরকের পথ রোধ করতে কবর পাকা করতে, কবররে উপর ঘর বা গম্বুজ বানাতে, কবর উচু করতে, কবরে কিছু লিখতে কবরের নিকট মসজিদ বানাতে, কবরে বাতি দিতে নিষেধ করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। এর বিপরীতে কখনোই এরূপ কোনো কাজ করতে নির্দেশ বা উৎসাহ দেন নি। এখন শয়তান বলছে, অমুক বা তমুক কারণে তা নিষেধ এবং অমুক বা তমুক কারণে তা করা যেতে পারে। সকল শিরক, কুফর ও বিদ‘আতের ক্ষেত্রেই শয়তানের মূল যুক্তি এটাই। এ বিষয়ে মুমিনকে সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ নির্দ্বিধায় আক্ষরিকভাবে পালনই নাজাতের পথ।

[1] সূরা ফাতির: ৪০ আয়াত।
[2] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৫১; সূরা (৬) আন‘আম: ৮১; সূরা (৭) আ’রাফ: ৩৩; সূরা (২২) হজ্জ: ৭১।
[3] সূরা (৭) আ’রাফ: ২০-২১।