ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা প্রথম অধ্যায়: পরিচিতি, উৎস ও গুরুত্ব ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
১. ২. ৬. ৫. ধর্মগুরুগণ বা আলিমগণের মতামত

সকল ধর্মেই আলিমগণ বা ধর্মগুরুগণ ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং ধর্মের বিধিবিধান ও ধর্মবিশ্বাস শিক্ষা প্রদান করেন। তবে ইহূদী-খৃস্টান সম্প্রদায়, বিশেষত খৃস্টান সম্প্রদায় ধর্মগুরু বা বুজুর্গদের ইসমাত বা অভ্রান্ততা ও পবিত্র-আত্মা থেকে প্রাপ্ত কাশফ-ইলহামে বিশ্বাস করে তাদের মতামতকেই দীনের চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করেছে। তাদের বুজুর্গি, কারামত, কাশফ ও বিশেষ জ্ঞানের উপর নির্ভর করে তাদের মতামতকে তারা ওহীর মতই মর্যাদা দান করেছে। বরং ওহীর আর বিশেষ কোনো মূল্য থাকে নি। এ সকল ধর্মগুরু ওহীর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। তাদের বক্তব্যের সারকথা ছিল, ওহীর বক্তব্য আমরা বুঝব না, এগুলি সাধারণ মানুষদের জন্য নয়, পবিত্র আ্ত্মায় পূর্ণ হয়ে কাশফ, ইলহাম ও বিশেষ জ্ঞানের মাধ্যমে ধর্মগুরু, পাদ্রী বা পোপ যে সিদ্ধান্ত দিবেন সেটিই ওহীর একমাত্র ব্যাখ্যা বলে গণ্য হবে। মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে এরূপ বিশ্বাসকে শিরক বলে আখ্যায়িত করেছেন। পরবর্তীকালে আমরা তা বিস্তারিত আলোচনা করব।

মুসলিম উম্মাহর আকীদাগত বিভক্তি ও বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ পরবর্তী আলিমগণের বক্তব্যকে আকীদার উৎস হিসেবে গ্রহণ করা। মূলত শীয়া ফিরকার অনুসারীগণই প্রথমত ইমাম ও নেককারদের ইসমাত ও তাদের ইলমু লাদুন্নী, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির অভ্রান্ততার বিশ্বাস প্রচার করে। পরবর্তীকালে মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক দুর্বলতার দিনগুলিতে কারামিতা, ফাতিমিয়্যাহ, ইসামঈলিয়্যাহ, বাতিনিয়্যাহ, নুসাইরিয়্যাহ, দুরুয ইত্যাদি শীয়া ফিরকা সকল মুসলিম সমাজে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। অনেক সাধারণ নেককার মানুষও তাদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হন। ফলে আলিম-বুজুর্গগণের মতামতকেই আকীদার মূল ভিত্তি ধরা হয়। অমুক আলিম অমুক কথা বলেছেন, তিনি কি কিছুই জানতেন না? কাজেই কথাটি ঠিক এবং শুধু ঠিকই নয়, এর বিপরীত কথা বিভ্রান্তি।

নিঃসন্দেহে ইসলামে আলিম ও নেককারগণের মর্যাদা রয়েছে। তবে তাঁরা মা’সূম নন, তাদের মতামত কুরআন সুন্নাহর আলোকে বিচার করে গ্রহণ করতে হবে। ভুলের কারণে যেমন কোনো নেককার ব্যক্তি বিষয়ে কু-ধারণা পোষণ করা যায় না, তেমনি কোনো নেককার বলেছেন বলেই তা অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করা যায় না।

আমরা উপরে দেখেছি যে, কুরআন ও হাদীসের পরে ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মকে কুরআন ও হাদীসে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে কথা কুরআনে বা প্রথম তিন যুগে প্রসিদ্ধ ইমামগণ কর্তৃক গৃহীত সহীহ হাদীসে নেই সে কথা আকীদার অংশ হতে পারে না, ইলমী আলোচনার বিষয় হতে পারে। আকীদা একমাত্র কুরআন ও হাদীস থেকেই শিখতে হবে। যদি কুরআন বা হাদীসের কোনো নির্দেশন সুস্পষ্টতই পরস্পর বিরোধী হয় অথবা সে বিষয়ে মতভেদের সষ্টি হয় এবং ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় তবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যার অধিকার সাহাবীগণের। তাঁরা যদি কিছু না বলেন তবে আমাদের কিছু বলার আর প্রয়োজন নেই। যে বিষয়ে যতটুকু বলে অথবা কিছু না বলে সাহাবীগণের ঈমান সঠিক থেকেছে সে বিষয়ে ততটুকু বললে অথবা কিছু না বললে আমাদের ঈমানও সঠিক থাকবে।

পরবর্তী যুগের আলিমগণ অনেক কথাই বলেছেন। প্রথম তিন মুবারক শতাব্দীর পরে, এবং বিশেষত, ক্রুসেড যুদ্ধে আক্রান্ত এবং পরে তাতার আক্রমনে পরাজিত ছিন্নভিন্ন মুসলিম সমাজগুলিতে অনেক আলিম, বুজুর্গ অনেক কথা বলেছেন, তাদের বিপরীতেও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আমাদের দেখতে হবে, এ সকল কথা কি সাহাবীগণ বলেছেন? যদি তাঁরা কিছু না বলেন তবে আমাদের মুক্তির পথ হলো কিছু না বলা। কিছু বললে তা অলস ইলমী বিতর্ক হতে পারে, তবে আকীদার বিষয় হতে পারে না।

উম্মতের সকল আলিম ও বুজুর্গই সম্মানিত। তাদের সম্মান করা মুমিনের দায়িত্ব। তাদের মাধ্যমেই দীন আমরা পেয়েছি। তবে সম্মান করা এবং অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করা এক নয়। উম্মাতের পরবর্তী যুগের আলিমগণ অনেক কথা বলেছেন, তাদের মতামতের সম্মান করতে হবে এবং কোনো মত বাহ্যত সুন্নাতের বিপরীত হলে তার ভাল ব্যাখ্যা করতে হবে। তবে কখনোই তাকে আকীদার মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না বা এরূপ মতের ভিত্তিতে কুরআন বা সুন্নাতের নির্দেশনার ব্যাখ্যা করা যায় না।