ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শির্ক কী ও কেন? তৃতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
শাফা‘আতের প্রথম পর্যায়: হাশরের ময়দানে যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন

যারা হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ চলা কালীন সময়ে শাফা‘আত করবেন, বিভিন্ন হাদীসের বর্ণানানুযায়ী তারা হলেন নিম্নরূপ:

রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত:

বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একাধিক শাফা‘আত রয়েছে। সে-গুলো হলো:

১. শাফা‘আতে কুবরা বা বড় শাফা‘আত: তাঁর প্রথম এ শাফা‘আতটি হবে হাশরের মাঠের ভয়াবহ অবস্থা থেকে সমগ্র হাশরবাসীদের মুক্তির জন্যে। হাশরবাসীরা যখন আদম আলাইহিসি সালাম থেকে আরম্ভ করে একে একে নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম-এর কাছে গিয়ে তাদের এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করার জন্য আবেদন করবেন, তখন তাঁরা সবাই নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতির কথা স্মরণ করে সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন। অবশেষে যখন হাশরবাসীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যেয়ে সুপারিশ করার জন্য আবেদন করবে, তখন তিনি বলবেন: আমি এ-কাজের উপযুক্ত।[1]

তবে যেহেতু আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত সেখানে কোনো কথা বলা যাবে না, সে-জন্য তিনি মাকামে মাহমূদে আরোহণ করে সেজদা রত হয়ে এমন মনোরম ও মনোমুগ্ধকর ভাষায় আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবেন যেমনটি তিনি অতীতে কখনও করেন নি। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাঁকে সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন। তিনি বিচারকার্য আরম্ভ করার জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করলে আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন এবং বিচার কার্য শুরু করবেন।

২. দ্বিতীয় শাফা‘আত হবে তাঁর উম্মতের মধ্যকার কিছু লোকদেরকে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করাবার জন্যে। শাফা‘আতের ব্যাপারে যে দীর্ঘ হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে এ-জাতীয় শাফা‘আতের কথা এ মর্মে রয়েছে যে, আল্লাহ বলবেন:

«...أَدْخِلْ مِنْ أُمَّتِكَ مَنْ لاَ حِسَابَ عَلَيْهِمْ مِنَ الْبَابِ الأَيْمَنِ»

‘‘তোমার উম্মতের মধ্যকার যাদের কোনো হিসাব নেই তাদেরকে জান্নাতের ডানের দরজা দিয়ে প্রবেশ করাও’’।[2]

৩. তৃতীয় শাফা‘আত হবে তাঁর উম্মতের মধ্যকার এমন সব লোকদের জন্যে যাদের পাপ ও পূণ্য সমান হয়ে যাবে। এরাও ইন-শাআল্লাহ তাঁর শাফা‘আতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,

«السَّابِقُ يَدْخُلُ الجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ و الْمُقْتَصِدُ بِرَحْمَةِ اللهِ، وَالظَّالِمُ لِنَفْسِه وَأَصْحَابُ الأَعْرَافِ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ بِشَفَاعَةِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم»

‘‘অগ্রগামীরা বিনা হিসেবে আর মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারীরা আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যারা নিজেদের নফসের উপর জুলুম করেছে এবং যাদের পাপ ও পূণ্য সমান হয়ে গেছে তারাও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আতে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’।[3]

১. চতুর্থ শাফা‘আত হবে তাঁর উম্মতের মধ্যকার এমন সব লোকদের জন্য যাদের পুণ্যের চেয়ে পাপের সংখ্যা অল্প পরিমাণে বেশী হবে। আক্বীদা বিষয়ক কিতাবাদিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ-জাতীয় শাফা‘আতের কথা পাওয়া গেলেও কোনো কিতাবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণের বর্ণনা পাওয়া যায় না। সম্ভবত শাফা‘আত সংক্রান্ত সাধারণ হাদীসসমূহ বিবেচনা করেই এ শাফা‘আতের কথা বলা হয়ে থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেছেন:

«شَفَاعَتِيْ لأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِيْ»

‘‘আমার উম্মতের মধ্যকার কবীরা গুনাহকারীদের জন্য আমার শাফা‘আত হবে’’।[4] অপর হাদীসে বলেন:

«لِكُلِّ نَبِيٍ دَعْوَةٌ يَدْعُوا بِهَا وَأُرِيْدُ أَنْ أَخْتَبِأَ دَعْوَتِيْ شَفَاعَةً لِأُمَّتِيْ فِيْ الآَخِرَةِ»

‘‘প্রত্যেক নবীর জন্য আল্লাহর নিকট একটি আহ্বান রয়েছে যা তাঁরা করবেন। আর আমি আমার সে শাফা‘আত আখেরাতে আমার উম্মতদের শাফা‘আত করার জন্য জমা রাখতে চাই’’।[5]

উক্ত ধরনের হাদীসসমূহ দ্বারা এ শাফা‘আতের কথা প্রমাণিত হলেও তা সকল অপরাধীদের জন্য সমানে পাইকারীভাবে হবে না। বরং তা হবে এমন সব অপরাধীদের জন্যে যাদের পাপের সংখ্যা পুণ্যের চেয়ে অল্প পরিমাণে বেশী হয়েছে। তাদের অবস্থা এমন যে, একজন পরীক্ষার্থীকে যেমন অল্প নম্বর যোগ দিলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারে, তেমনি তাদেরকেও অল্প পুণ্য যোগ দিলে তারাও জান্নাতে চলে যেতে পারে। এমনি ধরনের পাপীদেরকে পূণ্য গ্রেস দেয়া স্বরূপ আল্লাহর অনুমতিক্রমে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাদের জন্য শাফা‘আত করবেন। পরীক্ষায় যারা আদৌ গ্রেস পাবার যোগ্য নয়, তাদের যেমন কোনো গ্রেস দেয়া হয় না, তেমনি যারা পুণ্য গ্রেস পাওয়ার যোগ্য নয়, তাদের জন্যেও হাশরের মাঠে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো শাফা‘আত হবে না।

বরং এ ধরনের লোকেরা তাদের অপরাধের মাত্রানুযায়ী অল্প-বেশী সময়ের জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অল্প ও বেশী অপরাধী সকলেই যদি তাঁর শাফা‘আত পেয়ে হাশরের মাঠেই জাহান্নামে যাওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে যায়, তা হলে অপরাধীদের ব্যাপারে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে যে-সব আয়াত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সে-সবের কী অর্থ দাঁড়াবে? সকল অপরাধীরা যদি সেদিন তাঁর শাফা‘আত পেয়ে মু’মিন ও সৎকর্মশীলদের সাথেই জান্নাতে চলে যায়, তা হলে দুনিয়ায় মু’মিনদের এত কষ্ট করারই-বা কী হেতু থাকতে পারে? তা ছাড়া ফাছিক ও নাফরমান মু’মিনদের জাহান্নামে যাওয়া সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহেরই-বা কী অর্থ থাকতে পারে ?

২. পঞ্চম শাফা‘আত হবে সকল জান্নাতীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবার জন্যে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَنَا أَوَّلُ شَفِيْعٍ فِيْ الْجَنَّةِ»

‘‘জান্নাতে প্রবেশ করার ব্যাপারে আমি হবো প্রথম শাফা‘আতকারী...’’।[6]হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ-কয়টি শাফা‘আতের কথাই কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। তবে এ-ছাড়াও অপরাধী মু’মিনদের জাহান্নামে প্রবেশের পর সেখান থেকে তাদেরকে পুনরায় বের করে নিয়ে আসার জন্যেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরো কিছু শাফা‘আত রয়েছে, যা আমরা পরে বর্ণনা করবো।

>


[1]. হাশরের মাঠে রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর এ শাফা‘আত সংক্রান্ত হাদীসটি হাদীস গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। দেখুন: মুসলিম, প্রাগুক্ত; (ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: সর্বনিম্ন জান্নাতবাসীর স্থান), ১/১৮৩।

[2]. আহমদ, প্রাগুক্ত; ২/৪৩৫।

[3]. শিববীর আহমদ উছমানী, ফতহুল মুলহিম বি শরহে সহীহ মুসলিম; (করাচী: মাকতাবাতুল হেজায, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ১/৩৬১; ফতহুল বারী বি শরহিল বুখারী;১১/৪২৮।

[4]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; (অধ্যায়: সিফতিল কিয়ামাঃ, পরিচ্ছেদ নং: ১১), ৪/৬২৫।

[5]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ঈমান, বাব: ইখতেবাউন নাবীয়্যি দাওয়াতাশ শাফা’আতি লি উম্মাতিহি), ১/১৮৮।

[6].মুসলিম, প্রাগুক্ত;১/১৮৮; আহমদ, প্রাগুক্ত; ৩/১৪০; ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম ৪/৬৬।