ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শির্ক কী ও কেন? প্রথম পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে মান্যবর ইমামগণের মত

  এ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেন :

"وله يد ووجه و نفس ... فهو له صفات بلا كيف... وغضبه ورضاه صفتان من صفاته بلا كيف."

‘‘আল্লাহ তা‘আলার হাত, মুখ ও আত্মা ... গুণাবলী রয়েছে, তবে এর ধরণ নির্ধারণ করা যাবে না। আর তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টির গুণদ্বয় রয়েছে, তবে এগুলোর ধরণ ও প্রকৃতির কোনো বর্ণনা দেয়া যাবে না।’’[1]

অপর এক বর্ণনায় তিনি বলেন :

‘‘আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে কারো কোনো কথা বলা ঠিক নয়। তবে আল্লাহ নিজেকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন তাঁকে সে গুণে গুণান্বিত করা উচিত। এক্ষেত্রে নিজের চিন্তা প্রসূত কোনো কথা বলা ঠিক নয়।’’[2]

আল্লামা ইমাম মালিক (রহ.)-কে

﴿ ٱلرَّحۡمَٰنُ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ ٱسۡتَوَىٰ ٥ ﴾ [طه: ٥]

‘রহমান আরশের উপর ইসতেওয়া করেন’’ (উঠেন), এ আয়াতে বর্ণিত ‘ইসতেওয়া’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলে তিনি অপর কোনো প্রতিশব্দ দিয়ে এ শব্দের তা’বীল বা ব্যাখ্যা না করে বলেন :

"الاستواء معلوم والكيف مجهول، والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة."

‘‘ইস্তেওয়ার অর্থ বোধগম্য, এর প্রকৃতি অজ্ঞাত, এর প্রতি ঈমান আনয়ন ওয়াজিব, এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বেদ‘আত।’’[3]

ইমাম শাফিঈ (রহ.) কে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : ‘‘আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সে গুলোর উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করি, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁর পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে আল্লাহর যে সব গুণাবলীর বর্ণনা এসেছে, আমি সেগুলোর উপরেও ঈমান রাখি।’’[4]

এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন: ‘‘আল্লাহর গুণাবলীসমূহের প্রতি আমি ঈমান আনয়ন করি, এগুলো সত্য বলে বিশ্বাস করি। তবে এগুলোর আকৃতি-প্রকৃতি জানি না, এর কোনো কিছুকে আমি প্রত্যাখ্যানও করি না।’’[5]

আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী সম্পর্কে এটাই হচ্ছে মূল ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর অনুসারীদের আক্বীদা বা বিশ্বাস। তবে আব্বাসী খেলাফত আমলে যখন মুসলিম মনীষীগণ গ্রীক দর্শন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হন, তখন অনেকের কথামতে আল্লাহ তা‘আলাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা আল্লাহর এ সব গুণাবলীর ব্যপারে তাঁদের পূর্বসূরীদের কথা থেকে সরে এসে এ সবের তা’বীল বা ব্যাখ্যায় লিপ্ত হন। এ মতের পুরোধা ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী (মৃ.৩২৪হি.) প্রথমত আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীর মধ্য থেকে কেবল কান, চক্ষু, ইচ্ছা, সামর্থ্য, কথা, জ্ঞান ও জীবন এ সাতটি গুণকে স্বীকার করে অবশিষ্ট যাবতীয় গুণাবলী যেমন- ইসতেওয়া বা উপরে উঠা, অবতরণ, আগমন করা, হাসা, সন্তুষ্ট হওয়া, ভালোবাসা, অপছন্দ করা, রাগান্বিত ও আনন্দিত হওয়া, এ সব গুণাবলীর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করে এ-গুলোর তা’বীল বা ব্যাখ্যা করেন। তাঁরই পথ ধরে ইমাম গাযালী[6], ইমাম রাযী[7] এবং আরো অনেকে মুসলিম বিশ্বে তাঁর এ মতবাদ প্রচার করেন, যা আজও আমাদের দেশসহ অনেক মুসলিম দেশে প্রচলিত রয়েছে।

তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, যার নামে এই মতবাদ প্রচলিত রয়েছে সেই ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী তিনি তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর এ মত পরিবর্তন করেছিলেন এবং ‘আল-এবানাহ ‘আন উসূলিদ দিয়ানাঃ’ নামে একটি গ্রন্থ লিখে তাতে তিনি আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ব মত পরিহার করে সালাফগণের মতের পূর্ণ অনুসরণ করেছিলেন। আমাদের কাছে আশ্চর্য বোধ হয় যে, আমরা যেখানে পদে পদে মহামান্য ইমামগণকে অনুসরণ করে চলেছি, সেখানে কী করে এ ক্ষেত্রে আমরা তাদের বিপরীত চিন্তার অনুসারী হয়ে গেলাম। এর অর্থ কি এ নয় যে, আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে সাহাবাদের থেকে নিয়ে সমস্ত সালাফগণের আক্বীদা সঠিক ছিলনা!! نعوذ بالله রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নিজেই আল্লাহ তা‘আলার সত্তাগত গুণাবলীর ধরণ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা করেন নি, তখন কারো পক্ষেই এ সবের তা’বীল করা সমীচীন ছিল না।

কেননা, এ সবের তা’বীল করা আর অস্বীকার করা মূলত একই কথা। মু‘তাযিলারা ভেবেছিল- আল্লাহর এ সব গুণাবলী থাকলে তাঁর প্রতিটি গুণকে একেকটি আল্লাহ বলে গণ্য করতে হবে, কিন্তু আল্লাহ এক, সুতরাং আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁকে এ সব গুণাবলী থেকে মুক্ত বলে বিশ্বাস করতে হবে (এ ভ্রান্ত ধারণাই মু’তাযিলাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে)। বস্তুত যারা সিফাত বা আল্লাহর গুণাবলীর তা’বীল করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এ সবের তা’বীল না করেও যে আল্লাহ তা‘আলাকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা থেকে রক্ষা করা যায়, তা তাঁদের চিন্তায় আসে নি।

আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তার সাথে তাঁর কোনো সৃষ্টির সত্তার যখন কোনো সাদৃশ্য নেই, তখন তাঁর জাতের সাথে সংশ্লিষ্ট গুণাবলীর সাথেও তাঁর কোনো সৃষ্টির গুণাবলীর কোনো সাদৃশ্য থাকবে না- এটাই স্বাভাবিক কথা। নামের দিক থেকে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে বাহ্যিক কিছু মিল পাওয়া গেলেও এতে উভয়ের মাঝে আকৃতি ও প্রকৃতিগত মিল হয়ে যাওয়া জরুরী হয়ে যায় না।

কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿وَلَهُ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰ﴾ [الروم: ٢٧]

‘‘আল্লাহর জন্যেই রয়েছে উৎকৃষ্ট উদাহরণ।’’[8]

তাঁর সত্তা ও গুণাবলীর উদাহরণ সকল কিছুর উর্ধ্বে। এ প্রসঙ্গে মিশরের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সইয়্যিদ সাবেক বলেন :

‘‘আল্লাহ তা‘আলার সাথে তাঁর কোনো কোনো গুণাবলীতে তাঁর সৃষ্টির তুলনা কেবল নামকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, প্রকৃতি বা মূলগতভাবে উভয়ের মাঝে কোনো প্রকার সাদৃশ্য নেই। কারো ব্যপারে যদি বলা হয় যে, তিনি একজন জ্ঞানী, তিনি জীবিত, তিনি আছেন, তিনি সামর্থ্যবান, তিনি বিজ্ঞ ও দয়ালু, তখন এর অর্থ এ দাঁড়াবে যে, তিনি বাহ্যিক দিক থেকে এ সব গুণে গুণান্বিত, তবে তার এ সব গুণাবলী আল্লাহর গুণাবলীর তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থিত; আর আল্লাহর ব্যাপারে এ সব গুণের অর্থ হবে তিনি এ সব গুণের ক্ষেত্রে পূর্ণতার চরম শিখরে অবস্থিত।’’[9]

ড. বুরাইকান বলেন : ‘‘সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোনো কোনো গুণাবলীর ক্ষেত্রে এমন একটি সাধারণ অর্থের দিক থেকে মিল রয়েছে যা কারো জন্যে এককভাবে প্রযোজ্য নয়। এ মিল থাকার ফলে উভয়ের মাঝে সেই নিন্দিত তুলনা আবশ্যক হয়ে যায় না, যা শরী‘আতের দলীল ও সুস্থ বুদ্ধি অগ্রাহ্য করে; এ জন্যে যে, প্রতিটি অস্তিত্ববান দু’টি বস্তুর মাঝে অল্প পরিমাণে হলেও উভয়ের মাঝে কিছুটা মিল থাকে। এ মিল থাকাতে প্রত্যেকের যে আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাতে একে অপরের অনুরূপ হওয়া জরুরী হয়ে যায় না। কারণ, বিশেষত্বের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের গুণের যে অবস্থা থাকে, তা উভয়ের যৌথ গুণাবলীর অবস্থার চেয়ে ভিন্নতর হয়ে থাকে এবং প্রত্যেকের সে ভিন্ন গুণাবলীই তখন একের দ্বারা অপরকে বুঝানোর পথে অন্তরায়ের সৃষ্টি করে।’’[10]

আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী সম্পর্কে কোনো অযথা তর্কে লিপ্ত না হয়ে সহজ সরলভাবে যে বিশ্বাস পোষণ করা উচিত, সে সম্পর্কে অবগত হওয়াই আমাদের একান্ত প্রয়োজন। আর সে প্রয়োজনটুকু পূরণ করার জন্যেই আমি নিম্নে মসজিদে নববীর পেশ ইমাম শেখ ‘আব্দুর রহমান আল-হুযাইফী এর বক্তব্য পাঠক সমাজের সম্মুখে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরলাম। তিনি বলেন :

‘‘আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী মূলত দু’ধরনের রয়েছে:

এক. এমন সব গুণাবলী যা আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে রয়েছে, যেগুলোকে প্রমাণিত বা হাঁ বাচকগুণাবলী (ثُبُوْتِيَّةْ) বলা হয়ে থাকে।

দুই. এমন সব গুণাবলী যা আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে নেই, যেগুলোকে অপ্রমাণিত বা নাবাচক (سَلْبِيَّةْ) বলা হয়ে থাকে।

আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও কর্ম সংক্রান্ত যে সব গুণাবলীর বর্ণনা কুরআন ও সহীহ হাদীসে এসেছে, সেগুলোকে প্রমাণিত ধরনের গুণাবলী বলা হয়। এ জাতীয় গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের জন্য এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ পূর্ণতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন এবং এর বিপরীতে অবস্থিত যে সব অসম্পূর্ণতা রয়েছে, তাত্থেকে যে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র, তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলী হলো সেগুলোই যদ্দ্বারা তিনি অনন্তকাল থেকে গুণান্বিত রয়েছেন এবং চিরকাল যে সব গুণে তিনি গুণান্বিত থাকবেন। সত্তাগত গুণাবলীর ন্যায় তিনি কর্মগত গুণেও অনন্তকাল থেকেই গুণান্বিত রয়েছেন। উভয় প্রকার গুণের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে- সত্তাগত গুণাবলীসমূহ তাঁর ইচ্ছার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। আর কর্মগত গুণাবলীসমূহ তাঁর ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত। তিনি ইচ্ছা করলে তা করেন, না হয় না করেন। কর্মগত গুণাবলীর মধ্যে এমনও কিছু গুণাবলী রয়েছে যা বিশেষ বচনের ক্ষেত্র ছাড়া আল্লাহর বেলায় তা সাধারণভাবে প্রযোজ্য হয় না। সেরূপ গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে- আল্লাহর চক্রান্তকারী ও বিদ্রূপকারী হওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া।

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٥٤ ﴾ [ال عمران: ٥٤]

‘‘কাফিররা চক্রান্ত করলো, আল্লাহ তা‘আলাও (তাদের বিপরীতে) চক্রান্ত করলেন। আর তিনি উত্তম চক্রান্তকারী।’’[11]

অপর আয়াতে রয়েছে :

﴿ ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ﴾ [البقرة: ١٥]

‘‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে বিদ্রূপ করেন।’’[12]

উপর্যুক্ত দু’টি আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা নিজেকে সাধারণভাবে চক্রান্তকারী ও বিদ্রূপকারী হওয়ার দু’টি গুণে গুণান্বিত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সাধারণ অর্থে তিনি এ দু’টি গুণে গুণান্বিত নন। কেননা; প্রকৃতপক্ষে তিনি এ দু’টি কর্ম দ্বারা কাফির ও ইসলামের শত্রুদের ইচ্ছা ও কর্মের বিরুদ্ধে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে, তাই ব্যক্ত করেছেন। উদ্দেশ্য এটা বুঝানো যে, কাফিরদের চক্রান্ত ও বিদ্রূপের মুকাবেলায় আল্লাহ যে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, তা যেন তাদের কর্মেরই সমান হয়ে থাকে। এ-জাতীয় গুণ আল্লাহ তা‘আলার জন্যে পূর্ণতা প্রমাণকারী কেবল তখনই হয়ে থাকে যখন তা কাফিরদের কর্মের মুখোমুখি অবস্থানের কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়। অন্যথায় তা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে পূর্ণতা প্রমাণকারী নয়।

যে সকল গুণাবলী অসম্পূর্ণতা (نقص) এর অর্থ বহন করে, সে-সব গুণে আল্লাহ তা‘আলা গুণান্বিত হতে পারেন না। যেমন- তন্দ্রা ও নিদ্রা, এ দু’টি অসম্পূর্ণতার অর্থ বহন করে বিধায়, আল্লাহ তাঁর নিজের পূর্ণতা প্রমাণ এবং নিজ থেকে অসম্পূর্ণতা দূরীকরণের জন্যে তিনি এ দু’টি গুণে গুণান্বিত না থাকার কথা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন :

﴿ ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَيُّ ٱلۡقَيُّومُۚ لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ وَلَا نَوۡمٞۚ ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অপর কোনো হক্ব উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সব কিছুকে তিনি ধারণ করে রয়েছেন, তন্দ্রা ও নিদ্রা কখনও তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।’’[13]

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের জন্যে ‘হাইউন’ ও ‘কাইউম’ নামের দু’টি গুণ প্রমাণ করেছেন কারণ; এর দ্বারা তাঁর পূর্ণতা প্রমাণিত হয়; পক্ষান্তরে ‘তন্দ্রা’ ও ‘নিদ্রা’ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না বলে এ দু’টি গুণে তিনি গুণান্বিত নয় বলে জানিয়েছেন কারণ; এ দু’টি অসম্পূর্ণতা এবং তা তাঁর পূর্ণতা প্রমাণকারী প্রথম দু’টি গুণের পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী।

উপর্যুক্ত এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা যে সব গুণাবলী তাঁর নিজের জন্য প্রমাণ করেছেন, এর দ্বারা তিনি তাঁর নিজের পূর্ণতা প্রমাণ ও অসম্পূর্ণতা দূর করতে চেয়েছেন। আর যে সব গুণে তিনি গুণান্বিত না থাকার কথা বলেছেন, এর দ্বারা তিনি তাঁর নিজ থেকে অসম্পূর্ণতা দূরীকরণ ও এর বিপরীতে যে পূর্ণতা রয়েছে, তা তাঁর নিজের জন্য প্রমাণ করতে চেয়েছেন।

আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- কারো সাথে কোনো প্রকার সাদৃশ্য ছাড়াই তিনি এ সব গুণে গুণান্বিত রয়েছেন। এগুলোর ক্ষেত্রে একত্ববাদী হওয়ার অর্থ হচ্ছে- এ কথা মনে প্রাণে স্বীকার করা যে, এ-গুলো দ্বারা মহান আল্লাহ এককভাবে গুণান্বিত। কোনো ভাবেই তাঁকে এ সব গুণাবলী থেকে মুক্ত করা যাবে না। এগুলোর অর্থের ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া যাবে না, এর কোনো তুলনা ও প্রকৃতিও বর্ণনা করা যাবে না।

এ সব ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের করণীয় হচ্ছে- কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার এ সব সত্তাগত ও গুণগত গুণাবলী থাকার ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা এবং এগুলোর আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জানার জন্য কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করা, কেননা; আমরা শরী‘আত কর্তৃক এরূপ বিশ্বাস স্থাপনের জন্যেই আদিষ্ট হয়েছি। যারাই এ সব গুণাবলী নিয়ে অধিক চিন্তা-ভাবনা করেছেন, তারা হয় (معطلين) তথা মহান আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী থেকে মুক্তকারীদের অন্তর্গত হয়েছেন, নতুবা (محرفين) তথা বিকৃতকারীদের অন্তর্গত হয়েছেন, তা না হয় (ممثلين) তথা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যকারী অথবা (مكيفين) তথা এর ধরন-প্রকৃতি বর্ণনাকারীদের অন্তর্গত হয়েছেন। এতে করে তারা সালাফে সালেহীন তথা মূল ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অনুসৃত পন্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।

আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী থাকার স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে এবং যে সব গুণের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো দলীল প্রমাণ নেই, আল্লাহ তা‘আলার ব্যপারে সে সব গুণ প্রমাণের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাতগণের অনুসৃত পন্থা হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলা নিজের জন্য স্বীয় কিতাবে এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখে যে সব গুণাবলী প্রমাণ করেছেন, সে সব গুণাবলী কোনো প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ-প্রকৃতি ও সাদৃশ্য বর্ণনা ছাড়াই প্রমাণ করা। আর অস্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাঁদের পন্থা হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলা নিজ কিতাবে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার জন্য যে সব গুণাবলী না থাকার কথা বলেছেন, সেগুলো অস্বীকার করা। এ সব অস্বীকৃত গুণাবলীর বিপরীতে অবস্থিত গুণাবলীর মধ্যেই আল্লাহর পূর্ণতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা। আর যে সব গুণাবলীর প্রমাণে বা অপ্রমাণে কোনো দলীল প্রমাণাদি না থাকা সত্ত্বেও লোকেরা তা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে, যেমন- আল্লাহর শরীর থাকা বা না থাকা, তাঁর জন্য স্থান ও দিক নির্ধারণ করা ইত্যাদি।

আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ সব শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে তাঁরা নীরবতা পালন করেন। কুরআন ও হাদীসে এ সবের কোনো বর্ণনা না থাকায় তাঁরা এগুলো স্বীকারও করেন না, আবার অস্বীকারও করেন না। আল্লাহর বেলায় কেউ এগুলো উচ্চারণ করলে তাঁরা সে ব্যক্তির নিকট এর অর্থ জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে যদি আল্লাহ তা‘আলাকে পবিত্র রাখা জরুরী এমন কোনো বাতিলের উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, তা হলে তাঁরা তা অস্বীকার করেন। আর যদি এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে এমন কোনো সত্যকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তা হলে তাঁরা তা স্বীকার করেন। আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে যত মত ও পথ রয়েছে, তন্মধ্যে উপর্যুক্ত এ মত ও পথই হচ্ছে অনুসরণের অত্যাবশ্যক পথ। এ মতই হচ্ছে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী ও সাদৃশ্য পোষণকারীদের মতের মাঝে অবস্থিত একটি মধ্যপন্থী মত।’’[14]

উপরে আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাত, রুবূবিয়্যাত, তাঁর নামাবলী ও গুণাবলী সম্পর্কে যা আলোচিত হলো এর দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলার অনেক নাম ও গুণাবলী রয়েছে। এর সাথে তাঁর সৃষ্টির কারো কোনো নামের বা গুণের বাহ্যিকভাবে মিল থাকতে পারে, তবে এ মিল থাকাটা উভয়ের নামের ও গুণের অর্থ ও প্রকৃতির দিক থেকে কোনো অবস্থাতেই এক ও অভিন্ন বা সাদৃশ্যপূর্ণ নয়; বরং উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে, যা বর্ণনা করে বুঝাবার মত কোনো উপায় নেই। কারণ, সৃষ্টি আর স্রষ্টা কোনো দিন এক হতে পারে না এবং স্রষ্টার নামের ও গুণের যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টিকে কোনো দিন সে বৈশিষ্ট্যের অধিকারীও করেন না, কোন সৃষ্টি নিজ প্রচেষ্টায়ও সে বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে না। আল্লাহর এ সব নাম ও গুণাবলীর যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সে বৈশিষ্ট্য গুণেই তিনি আমাদের ও সমগ্র জগতের একমাত্র রব বা প্রতিপালক।

আর তিনি এ জগতের সব কিছুর একক প্রতিপালক হওয়ার কারণেই এ জগতের সব কিছুর একক উপাস্যের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, কারণ; কাউকে উপাস্য হতে হলে তাঁকে উপাসকের প্রতিপালকের মর্যাদায় আসীন হতে হয়। আল্লাহই যখন আমাদের একক প্রতিপালক, তাঁর হাতেই যখন আমাদের সৃষ্টি, জীবন, জীবিকা, ইহ ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ নিহিত, তখন তিনি ব্যতীত অপর কেউ আমাদের উপাস্য হতে পারে না। অতএব, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যকার কোনো নবী-রাসূল, ফেরেশ্তা, কোনো অলী-দরবেশ, জিন-পরী, কোনো গাছ-পালা বা পাথর ইত্যাদিকে তাঁর নাম ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে- বুঝে বা না বুঝে তাদের বিশ্বাসে বা কথায় বা কর্মে- শরীক করে নেয়, তারা প্রকারান্তরে তাঁদেরকে ও সে সবকে তাদের প্রতিপালক ও উপাস্য বানিয়ে কোনো না কোনো শির্কে নিমজ্জিত হয়।

[1]. দেখুন : ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’ কিতাবের ব্যাখ্যা হিসাবে লিখিত মুল্লা ‘আলী ক্বারী আল-হানাফী এর ‘শরহু কিতাব আল-ফিকহুল আকবার’; (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাঃ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ. ৫৮-৫৯।

[2]. আল-আলূছী, মাহমূদ, রূহুল মা‘আনী; (বৈরুত : দারু এহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৫ খ্রি..), ১৫/১৫৬।

[3]. আল-হানাফী, ইবনু আবিল ইজ্জ, শরহুল ‘আক্বীদাতিত ত্বাহাবিয়্যাঃ ; (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৫ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ১২৮; আল-খাযিন, ‘আলা উদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মদ, তাফছীরুল খাযিন; (লাহোর : নু‘মানী কুতুবখানা , সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), ১/১০০।

[4]. ‘আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আস-সালমান, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৪।

[5]. তদেব।

[6]. ইমাম গাযালী, ‘আল-ইক্বতেসাদ ফী উসূলিল এ‘তেকাদ’ গ্রন্থের ৬৯ পৃষ্টা দ্রষ্টাব্য।

[7]. ইমাম রাযী ‘ইসতেওয়া’ শব্দের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করে ‘ইসতীলা’ শব্দ দ্বারা এর তা‘বীল করেছেন। দেখুন : আর-রাযী, তাফসীরুল কবীর, (স্থান বিহীন, ৩য় সংস্করণ , তাং বিহীন), ১১/৬।

[8]. আল-কুরআন, সূরা আন-নাহাল : ৬০।

[9]. আস-সাইয়্যিদ সাবেক, ‘আল-আক্বাইদুল ইসলামিয়্যাহ; (বৈরুত : দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৭৫ খ্রি..), পৃ. ৫৮।

[10]. ড. ইব্রাহীম আল-বুরাইকান, প্রাগুক্ত; পৃ. ৯৩।

[11]. আল-কুরঅন, সূরা আলে ইমরান : ৫৪।

[12]. আল-কুরআন, সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫।

[13]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ২৫৫।

[14].এ কথাগুলো তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনায় আমাদেরকে আক্বীদা : বিষয়ে পাঠ দান উপলক্ষে ক্লাসে লিখিয়ে দিয়েছিলেন।