আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».

“যে ব্যক্তি রমযানের রাতে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।”[1]

...

রমযানে কিয়ামুল লাইলের (তাহাজ্জুদের) ফযীলত সম্পর্কে এখানে কুরআন ও হাদীস থেকে কতিপয় উদ্ধৃতি পেশ করব। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمۡ عَنِ ٱلۡمَضَاجِعِ يَدۡعُونَ رَبَّهُمۡ خَوۡفٗا وَطَمَعٗا وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ١٦﴾ [السجدة : ١٦]

“তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয় (মুমিনরা গভীর রাতে শয্যা ত্যাগ করে)। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে”। [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ১৬]

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ١٨﴾ [الذاريات: ١٧، ١٨]

“রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত”। [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১৭-১৮]

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَٱلَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمۡ سُجَّدٗا وَقِيَٰمٗا٦٤﴾ [الفرقان: ٦٤]

“আর যারা তাদের রবের জন্য সিজদারত ও দণ্ডায়মান হয়ে রাত্রি যাপন করে”। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৪]

আব্দুল্লাহ ইবন সালাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِسَلَامٍ».

“হে লোক সকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাবে, লোকদের খাদ্য দিবে এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকবে (শেষ রাতে) তখন (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করবে। তাহল তোমরা শান্তি ও নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।”[2]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَفْضَلُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ».

“ফরয সালাতের পরে সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো তাহাজ্জুদের সালাত।”[3]

বিলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأَبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَإِنَّ قِيَامَ اللَّيْلِ قُرْبَةٌ إِلَى اللَّهِ، وَمَنْهَاةٌ عَنْ الإِثْمِ، وَتَكْفِيرٌ لِلسَّيِّئَاتِ، وَمَطْرَدَةٌ لِلدَّاءِ عَنِ الجَسَدِ».

তোমাদের অবশ্যই তাহাজ্জুদের সালাত পড়া উচিৎ। কেননা এটি তোমাদের পূর্ববর্তী ভালো লোকদের অভ্যাস, কিয়ামুল লাইলে রয়েছে আল্লাহর নৈকট্য, গুনাহ থেকে বিরতকারী, গুনাহের কাফফারা এবং শরীরের রোগ-ব্যধির প্রতিষেধক।”[4]

কাফফারাত ও দারাজাতের হাদীসে এসেছে,

«وَمِنَ الدَّرَجَاتِ إِطْعَامُ الطَّعَامِ، وَطَيِّبُ الْكَلَامِ، وَأَنْ تَقُومَ بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ».

“মর্যাদার স্তরের থেকে অন্যতম হলো, খাদ্য খাওয়ানো, উত্তম কথা বলা এবং মানুষ যখন ঘুমে থাকে তখন তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা।”[5]

...

«عَجِبَ رَبُّنَا عَزَّ وَجَلَّ مِنْ رَجُلَيْنِ: رَجُلٍ ثَارَ عَنْ وِطَائِهِ وَلِحَافِهِ، مِنْ بَيْنِ أَهْلِهِ وَحَيِّهِ إِلَى صَلَاتِهِ، فَيَقُولُ رَبُّنَا: أَيَا مَلَائِكَتِي، انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي، ثَارَ مِنْ فِرَاشِهِ وَوِطَائِهِ، وَمِنْ بَيْنِ حَيِّهِ وَأَهْلِهِ إِلَى صَلَاتِهِ، رَغْبَةً فِيمَا عِنْدِي.

“আমাদের রব দু’ ব্যক্তির কাজে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হন। একজন যিনি বিছানা ও লেপ-তোশক ছেড়ে পরিবার-পরিজনের মধ্য থেকে উঠে গিয়ে সালাতে দাঁড়ায়। তখন আমাদের রব ফিরিশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফিরিশতাগণ! আমার বান্দাকে দেখ, সে আমার কাছে যা আছে তা পাওয়ার আশায় নিজ শয্যা ত্যাগ করে পরিবার-পরিজনের মধ্য থেকে উঠে তাহাজ্জুদের সালাতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।”[6]

....

«رَجُلَانِ مِنْ أُمَّتِي يَقُومُ أَحَدُهُمَا مِنَ اللَّيْلَ يُعَالِجُ نَفْسَهُ إِلَى الطَّهُورِ وَعَلَيْهِ عُقَدٌ فَيَتَوَضَّأُ، فَإِذَا وَضَّأَ يَدَيْهِ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، وَإِذَا وَضَّأَ وَجْهَهُ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، وَإِذَا مَسَحَ بِرَأْسِهِ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، وَإِذَا وَضَّأَ رِجْلَيْهِ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَيَقُولُ اللهُ لِلَّذِينَ وَرَاءَ الْحِجَابِ: انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي هَذَا يُعَالِجُ نَفْسَهُ يَسْأَلُنِي، مَا سَأَلَنِي عَبْدِي فَهُوَ لَهُ.

“আমার উম্মতের দুব্যক্তির মধ্যে একব্যক্তি রাতের (তাহাজ্জুদের) সালাত পড়তে উঠে নিজে নিজেই পবিত্রতা অর্জন করতে জোর চেষ্টা করল; অথচ তার উপরে ছিল শয়তানের বিছিয়ে রাখা কতগুলো গিরা বা বন্ধন। ফলে সে অযু করল। সে যখন অযু করতে দুহাত ধৌত করল তখন তার হাতের গিরা খুলে গেল। আবার যখন চেহারা ধৌত করল তখন তার চেহারার গিরা খুলে গেল। এভাবে যখন মাথা মাসেহ করল তখন তার মাথার গিরা খুলে গেল। আবার যখন দু’পা ধৌত করল তখন তার পায়ের গিরা খুলে গেল। তখন রব যারা পর্দার আঁড়ালে রয়েছেন তাদেরকে ডেকে বলেন, আমার এ বান্দাহকে দেখ। সে নিজেই নিজের অনুশীলন করছে। এ বান্দা আমার কাছে যা চাইবে আমি তাকে তাই দিব।”[7]

...

আল্লাহ প্রতি রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি বলতে থাকেন, কোন তাওবাকারী কি আছ? আমি তার তাওবা কবুল করব। কোন ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছ? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো দো‘আকারী আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। এভাবে তিনি ফজর পর্যন্ত বলতে থাকেন।

কোনো এক সৎলোক রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করত। হঠাৎ একরাতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। তখন স্বপ্নে তার কাছে একজন এসে বলল, উঠ। তুমি কি জানো না যে, জান্নাতের চাবি রাত জাগরণকারীদের কাছেই থাকে।

ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে একদল লোক বলল, আমরা রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে পারি না। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের গুনাহ তোমাদেরকে ঘুমিয়ে রাখে।

কোনো এক লোককে তার কতিপয় প্রিয় লোক বলল, আমরা কিয়ামুল লাইল আদায় করতে অক্ষম। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের গুনাহ-খাতা তোমাদেরকে বন্দী করে রেখেছে।

ফুদাইল রহ. বলেন, তুমি যদি তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে অক্ষম হও এবং দিনের বেলায় সাওম পালনে অপারগ হও তাহলে জেনে রাখ তুমি একজন বঞ্চিত মানুষ, তোমার গুনাহ তোমাকে বন্দী করে রেখেছে।

ওহে! যে আল্লাহর অনুগত্য ব্যতীত জীবন নিঃশেষ করেছ, ওহে যে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুমিয়ে রাত কাটিয়েছ, ওহে যার পণ্য-সামগ্রী শুধু সময়ক্ষেপণ ও অলসতা, কতই না নিকৃষ্ট তোমার মালামাল, ওহে! যে রমযান মাস আসা সত্ত্বেও কুরআনকে তোমার প্রতিপক্ষ বানিয়েছ, কীভাবে তুমি তার শাফা‘আত কামনা করো যাকে তুমি প্রতিপক্ষ বানিয়েছ? যে সালাতে দণ্ডায়মান হওয়া ব্যক্তিকে অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে না, সেসব তো ব্যক্তির দুর্ভাগ্যই শুধু বৃদ্ধি করে, আর এমন প্রত্যেক সিয়াম পালনকারী যার সিয়াম অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে না, এসব সিয়াম ব্যক্তির জন্য শাস্তি ও ফেরৎ প্রদান ছাড়া কিছুই জন্ম দেয় না। হে জাতি! কোথায় সিয়ামের প্রভাব? কোথায় রাত্রি জাগরণ করে দাঁড়ানোর নূর?হে আল্লাহর বান্দা! এটি রমযান মাস। অবশিষ্ট দিনগুলোর সুযোগ গ্রহণ করুন। এ আল্লাহর কিতাব পড়া হচ্ছে এবং শোনা হচ্ছে। এ কিতাব যদি পাহাড়-পর্বতের উপর নাযিল করা হতো তাহলে তা আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হতো। অথচ আমাদের অন্তর ভয়ে প্রকম্পিত হয় না, আমাদের চক্ষু ক্রন্দন করে না, আমাদের সাওম পাপাচার থেকে রক্ষা করে না, ফলে আমরা উপকৃতও হই না, আমাদের রাত্রি জাগরণ আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করতে পারে না ফলে আমরা সালাতের দ্বারা শাফা‘আতও আশা করতে পারি না। আমাদের অন্তর তাকওয়া শুণ্য, এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহের ন্যায়, এতে ধারাবাহিকভাবে গুনাহ আসছেই, ফলে তা সৎপথ দেখে না, ভালো কথা শোনে না। আমাদের কাছে কতবার কুরআন তিলাওয়াত করা হয় অথচ আমাদের অন্তর এখনও পাথরের মতো শক্ত বা এর চেয়েও বেশি কঠিন। কত রমযান আমাদের মাঝে আসে আবার চলে যায় অথচ আমাদের অবস্থা দুর্ভাগাদের মতোই। আমরা তাহলে সে জাতি থেকে কোথায় আছি যারা আল্লাহর ডাক শুনলেই সে ডাকের সাড়া দেয়, যখন তাদের কাছে আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করা হয় তখন তাদের অন্তর প্রকম্পিত হয় এবং তারা আল্লাহর দিকে এগিয়ে আসে।

>
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৫৯।

[2] তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৮৫, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৩।

[4] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৪৯, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে গরীব বলেছেন। সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১১৩৫, আলবানী রহ. হাদীসটিকে শাওয়াহেদের ভিত্তিতে হাসান বলেছেন।

[5] তিরমিযী, হাদীস নং ৩২৩৫, ইমাম তিরমিঈ হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[6] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৩৯৪৯, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

[7] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৭৭৯১, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।