الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد

ভাষা চর্চাকারীর কাছে অভিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। শব্দকোষ ছাড়া যে কোনো বিদেশী ভাষার মর্ম বোঝা ও আয়ত্ব করা দুরূহই নয়- অসম্ভবও বটে। ভাষা চর্চাকারীগণ এ সত্যটুকু পদে পদে উপলব্ধি করেন। এমনকি ভাষাবিদগণের মতে, ‘যে কোনো ভাষার অর্ধেক জ্ঞান তার অভিধানেই নিহিত।’

বহুদিন যাবত কুরআনে কারীম বোঝার জন্য উন্নতমানের একটি আধুনিক অভিধানের অভাব অনুভব করছি- যা দ্বারা ‘নাহব সরফ’ পাঠকারীগণ সহজেই কালামুল্লাহর মর্ম বুঝতে পারবেন। এতে আরবী সাহিত্যের আদি ও সদা-চলমান শব্দভাণ্ডার হাতে এসে যাবে। তদুপরি মাদরাসায় পড়ার সার্থকতাও হাসিল হবে। কেননা ইসলামী শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য কুরআন হাদীস বুঝে মহান রবের সন্তুষ্টি মোতাবেক আমল করার যোগ্যতা অর্জন করা। হেদায়াতের ওপর অটল থাকা। যার ভিত্তি কুরআন হাদীসের মূলনীতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন,

«تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ».

‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, তোমরা বিভ্রান্ত হবে না যতদিন এ দুটি আঁকড়ে থাকবে : আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ (হাদীস)।’ [মুয়াত্তা মালেক : ৩৩৩৮]

অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত মাদরাসাগুলোর সর্বোচ্চ ক্লাস পড়েও অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে না। কোনো সরল আয়াতের অর্থ জিজ্ঞেস করলেও বলতে হয়- তরজমা দেখে পরে বলব। অথচ নামের সঙ্গে মাওলানা, আলিম উপাধি যুক্ত হয়েছে। তাহলে কি আরবী কিছু কিতাবাদি পড়লেই লোকে আলেম হয়ে যায়! আরবী ভাষাভাষী সকলেই কি তাহলে আলেম! না, না, এলেম তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া সম্পত্তি। কুরআন ও সুন্নাহ।

আফসোস! শত আফসোস!! ইতোপূর্বে ইমামের ছাত্র ইমাম হয়েছেন, মুত্তাকীর প্রতিবেশী ওলিউল্লাহ হয়ে গেছেন। এখন আলেমের ছেলেও আলেম হয় না। মৌলভী মাওলানা হয় না। হয় কত কিছু।

হায় ভাগ্য! অজ্ঞতার ফেতনা স্রোতের মত বয়ে এলো। উত্তাল সাগরের ন্যায় ধেয়ে এলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম বলেছিলেন,

«تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا »

‘অচিরেই ফেতনা-ফাসাদ চাটায়ের পাতা গাঁথার ন্যায় ধারাবাহিকভাবে মানুষের অন্তরে আসতে থাকবে।’ [মুসলিম : ৩৮৬]

তাই হলো। যে জাতি অতীতে ছিলো “উন্নত শির’’, আজ তারা অধঃমুখী “আসফালা সাফিলিন”। যাঁরা হবেন শাসক, আজ তারা শাসিত।

বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ইলমের বিষয়ে আমরা চরম দুর্দিনে বাস করছি। বিশেষত কুরআন ও সুন্নাহ বিষয়ে। তাই এখনি উদ্যোগী না হলে অদূর ভবিষ্যতে কুরআন তরজমা তার গ্রন্থেই সীমিত থাকবে। তাফসীর, বিশ্লেষণ ও গবেষণা তো সুদূরপরাহত। এখন আহ্বান এসেছে ভবিষ্যৎ গড়ার, আগামীর প্রস্তুতির। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সে নির্দেশনাই দিয়েছেন,

﴿ وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ ﴾ [الانفال: ٦٠]

‘আর তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি সঞ্চয় কর’। (সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৬০)

স্মর্তব্য যে, কুরআনে হাকীম প্রজ্ঞাময় কিতাব, মহান আল্লাহর ভাষা। যার পূর্ণ মর্মোদঘাটন দুর্বল মানুষের সাধ্যাতীত ব্যাপার। তবুও তিনি প্রেরণা দিচ্ছেন,

﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ ٢٤ ﴾ [محمد: ٢٤]

‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’ (সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ২৪)

আরেক আয়াতে আল্লাহ আমাদের বলছেন,

﴿ وَلَقَدۡ يَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرٖ ١٧ ﴾ [القمر: ١٧]

‘নিশ্চয় আমি স্মৃতিচারণের জন্য কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, অতএব কেউ কি আছে স্মৃতিচারণকারী গবেষক?’ (সূরা আল-কামার, আয়াত : ১৭)

আরেক আয়াতে বলেছেন,

﴿ ثُمَّ إِنَّ عَلَيۡنَا بَيَانَهُۥ ١٩ ﴾ [القيامة: ١٩]

‘অতপর আমারই দায়িত্বে রইলো তার ব্যাখ্যা বর্ণনা করা।’ (সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত : ১৯)

এসব বাণীর কারণেই মনে নিরাশা নেই, বরং আশান্বিত। তাই বুকভরা আশা নিয়ে এই অভিধান প্রণয়নের ক্ষুদ্র প্রয়াস গ্রহণ করেছি। এতে তৃষ্ণাতুরের তেষ্টা সামান্য হলেও মিটবে বলে মনে আল্লাহর কাছে আশা করি।

সুপ্রিয় পাঠকমণ্ডলি! আরবী ব্যকরণের শব্দপ্রকরণশাস্ত্র ‘সরফ’ ও বাক্যগঠনশাস্ত্র ‘নাহব’ ছাড়া কুরআন বোঝা সম্ভব নয়। এই অভিধানের প্রথম অধ্যায়ে কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত সকল শব্দ তার শব্দমূল তথা মাদ্দানুক্রমে সাজানো হয়েছে। এতে মাদ্দা সংখ্যা আছে প্রায় সাড়ে সতেরশ। একই শব্দমূল থেকে কুরআনে বর্ণিত সকল “ইসম” (বিশেষ্য) “ফি‘ল” (ক্রিয়া) “বাব” (ক্রিয়াশ্রেণী) “মাছদার” (ক্রিয়াবিশেষ্য) রূপ ও “হরফ” (অব্যয়) একাধিক বাংলা প্রতিশব্দসহ দেখানো হয়েছে। শব্দার্থের শেষে প্রয়োগক্ষেত্রের উদাহরণস্বরূপ আগে সূরা ও পরে আয়াত নম্বর এভাবে ‘০০-০০’ প্রদান করা হয়েছে। ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাবের অতীতকালবাচক রূপ (মাযী ওয়াহেদ মুযাক্কার গায়বের সিগা) ইসমের ওয়াহেদ ও জমা মুকাসসারের সিগাসহ সর্বমোট প্রায় ৫৫০০ শব্দ এন্ট্রি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। একই বাব থেকে সমার্থসূচক বিভিন্ন “সিগা” উল্লেখ করে অযথাই গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করা হয়নি। কেননা কুরআন তরজমা তাদের কাজ যারা সিগার পরিবর্তনে অর্থের পরিবর্তন অনায়াসে বুঝতে পারেন। সমঝদারের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। তাছাড়া তাতে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। ক্রয় করতেও লেগে যায় অনেক মূল্য।

অভিধানের দ্বিতীয় পর্বে কুরআনুল কারীমের যেসব শব্দের মাদ্দা খুঁজে বের করতে গলদঘর্ম হতে হয়, তার একটি তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। যা সহজে মাদ্দা অনুধাবনে সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।

তৃতীয় পর্বে পাঠকবর্গের হিফয করার সুবিধার্থে প্রথম অধ্যায়ের এন্ট্রিগুলোই বাংলা অর্থসহ সংক্ষেপে পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। যাতে পাঠকগণ সহজে মুখস্থ করতে পারেন। দীর্ঘ পরিধির কারণে মনোবল হারিয়ে হীনবল না হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমার ছাত্রদের প্রতি লক্ষ্য করেছি, তারা “নাহব সরফ” যথেষ্ট পারে। পারে না শুধু শাব্দিক অর্থ। এ কারণেই বাক্যার্থ মিলানো আর হয়ে ওঠে না। ফলে ইলমী জিন্দেগী হ-য-ব-র-ল ছাড়া তেমন কিছু হয় না।

আমার বিশ্বাস আগ্রহী পাঠকগণ দৃঢ়প্রত্যয়ী হলে আল্লাহর ফযলে দৈনন্দিন অর্ধশত মাদ্দাও আয়ত্ব করতে পারবেন। এভাবে মুখস্থধারা চালু থাকলে সবকটি মাদ্দা অল্পদিনেই সমাপ্ত হবে ইন শাআল্লাহ। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন উদ্যম, অন্তর্জ্বালা, মনোযোগ ও অধ্যবসায়। দরকার ইখলাস ও একাগ্রতা। তাহলে বিন্দু বিন্দু মেহনত সাগরসম আশা পূরণে যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

২০০৫ সালে অভিধানের পাণ্ডুলিপি তৈরি হলেও এ কথা ভেবে কোনো প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি যে, আমার মতো অধমের লেখা কে আবার ছাপানোর ব্যবস্থা করবে? সাহিত্য জগতে প্রবীণগণের মূল্যায়ন বেশি, হওয়াও উচিত। নতুন কলম মুক্তা ঝরালেও তা মরীচিকার ন্যায় ম্লান হয়ে যায়, যা অনুচিত।

কুরআনে কারীমের সকল মাদ্দা, ইসম, ফি‘ল, হরফ ও বাব সংক্ষিপ্ত পরিসরে মুখস্থ করার উপযুক্ত এক অনন্য অভিধান।