কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জ, উমরাহ ও মদীনা যিয়ারত নবম অধ্যায় শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি
তাওয়াফ শেষে দু‘রাকা‘আত সলাতে কতিপয় মানুষের ভুল

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিম্নোক্ত আয়াতের অংশটি পাঠ করতেন:

وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى

[ওয়াত্তাখিযু মিম্ মাক্বামি ইবরাহীমা মুসাল্লা]

তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সলাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর।

অতঃপর মাকামে ইবরাহীমকে কা‘বা ঘর ও নিজের মাঝখানে রেখে দুই রাক‘আত সলাত আদায় করতেন। প্রথম রাক‘আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকা‘আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখলাস পাঠ করতেন।[1]

এক্ষেত্রে কতিপয় লোকেরা যে ভুল করে তা হচ্ছে, তাদের ভুল ধারণা যে, এই দুই রাকা‘আত সলাত মাকামে ইবরাহীমের নিকটেই আদায় করতে হবে, যার ফলে তারা এখানে বড় ভীড় করে থাকে এবং বিশেষ করে হাজ্জ ও রমাদ্বানের ভীড়ের মৌসুমে তাওয়াফকারীদের কষ্ট দিয়ে থাকে এবং তাদের তাওয়াফের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের এই ধারণা ভুল; কারণ, এই সলাত মাসজিদে হারামের যে কোন স্থানে আদায় করাই যথেষ্ট। আর মাকামে ইবরাহীম থেকে দূরে সলাত আদায় করেও তাকে নিজের ও কা‘বা ঘরের মাঝখানে রেখে সলাত আদায় করা যেতে পারে। যাতে করে নিজেকে এবং অপর কোন ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়া থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয় এবং বিনয় ও প্রশান্তির সাথে সলাতটি সম্পাদিত হয়। তাই যদি মাসজিদে হারামের দায়িত্বশীলরা মাকামে ইবরাহীমের পিছনে নিকটবর্তী হয়ে যারা সলাত আদায় করে তাওয়াফকারীদের কষ্ট দিয়ে থাকে তাদের এধরণের কাজে বাঁধা দিত এবং তাদেরকে জানিয়ে দিত যে, তাওয়াফের পরের দুই রাকা‘আত সলাতের জন্য মাকামে ইবরাহীমের নিকটবর্তী হওয়া শর্ত নয় তাহলে বড় ভাল হত।

এক্ষেত্রে যে ভুলটি হয়ে থাকে তা হচ্ছে যে, কিছু লোকেরা মাকামে ইবরাহীমের পিছনে বিনা কারণে অধিক পরিমাণে সলাত আদায় করে, অথচ যারা তাওয়াফ সমাপ্ত করে ফেলেছে তাদের এখানে সলাত আদায়ের জায়গার প্রয়োজন।

এখানে আরো একটি ভুল হয়ে থাকে তা হচ্ছে যে, কিছু তাওয়াফকারীরা দুই রাক‘আত সলাত শেষে তাদের নেতা তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চস্বরে সম্মিলিত দু‘আ করতে শুরু করে, ফলে সেখানকার নামাযীদের নামাযে গোলযোগ সৃষ্টি করে তাদের প্রতি অন্যায় করে থাকে। অথচ মহান আল্লাহ বলেন:

ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে বিনয়ের সঙ্গে এবং গোপনে আহবান কর। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।[2]

সাফা ও মারওয়ায় আরোহণ, তার উপর দু‘আ এবং দুই সবুজ বাতির মাঝখানে দৌঁড় দেয়া ও এক্ষেত্রে কতিপয় মানুষের ভুল

নাবী (সা.) থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হলে এই আয়াত পাঠ করতেন:

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ

[ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ‘ইরিল্লাহ্]

নিশ্চয়ই ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম।[3]

তারপর সাফা পর্বতের উপর এমনভাবে চড়তেন যে, তিনি কা‘বা ঘর দেখতে পেতেন। অতঃপর কিবলামুখী হয়ে দুই হাত উত্তোলন করে আল্লাহর প্রশংসা করতেন এবং নিজ পছন্দমত দু‘আ করতেন। সেই সময় নিম্নোক্ত কালিমা তাওহীদ দ্বারা আল্লাহর একত্ব প্রকাশ করতেন এবং মহত্ত্ব ঘোষনা করতেন:

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ

[লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহু ওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু, আনজাযা ওয়া’দাহু, ওয়া নাসারা আব্দাহু, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহ্‌দাহু]

আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, যিনি এক ও একক, যাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, তাঁরই সমস্ত প্রশংসা, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা’বূদ নেই, তিনি নিজ প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই সমস্ত ভ্রান্ত দলসমূহকে পরাজিত করেছেন।

নাবী (সা.) উক্ত কালিমাটি তিনবার করে পাঠ করতেন এবং তার মাঝে দু‘আ করতেন। দু‘আ করার পরে পায়ে হেঁটে নীচের দিকে নেমে আসতেন এবং দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে দৌঁড় দিতেন। অতঃপর তা অতিক্রম করে মারওয়া পর্যন্ত হেঁটে আসতেন এবং মারওয়ার উপর তাই করতেন যা তিনি সাফার উপর করেছিলেন।[4]

কতেক সাঈকারীরা এখানে যে ভুল করে তা হচ্ছে যে, তারা সাফা ও মারওয়ায় আরোহণ করলে কিবলামুখী হয়ে তিনবার তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করে এবং সলাতে হাত তোলার মত দুই হাত উত্তোলন করে ইশারা করে, তারপর নেমে হাটতে শুরু করে। অথচ ইহা নাবী (সা.) হতে বর্ণিত সুন্নাতের পরিপন্থী। তাদের উচিৎ যে, সম্ভব হলে সুন্নাত পালন করবে, আর না হলে তা ছেড়ে দেবে। কিন্তু এমন কোন বিদআতী কাজ করবে না যা নাবী (সা.) করেননি।

আরো কতেক সাঈকারী যে ভুল করে থাকে তা হচ্ছে যে, তারা সাফা ও মারওয়ার মাঝে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৌড় দিতে থাকে। ইহা সুন্নাতের বিপরীত; কারণ, সাঈ শুধুমাত্র দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে সুন্নাত। আর বাকি স্থানে সাধারণভাবে হেঁটে সাঈ করতে হবে। এধরণের ভুলগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে কিংবা তাড়াহুড়া করে সাঈ সমাপ্ত করতে গিয়ে হয়ে থাকে। (মহান আল্লাহ যেন তাদের সুমতি দান করেন।)

আরো ভুল হচ্ছে যে, কতেক মহিলারা দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষদের মতই দৌড় দেয়। অথচ মহিলাদের জন্য দৌড় দেয়া সুন্নাত নয় বরং তারা সাধারণভাবে হাঁটবে। এর দলীল আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.)-এর হদীস তিনি বলেন, মহিলাদের জন্য বায়তুল্লাহর রামাল এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝে দৌঁড় নেই।

আরো ভুল হচ্ছে যে, কতেক সাঈকারী মহান আল্লাহর এই বাণী:

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ

[ইন্নাস্সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ‘ইরিল্লাহ্]

সাফা ও মারওয়ার উপর আসলে প্রত্যেকবার পাঠ করতে থাকে। অথচ সুন্নাত হচ্ছে যে, তা শুধুমাত্র প্রথমবার সাফায় পৌঁছালে পাঠ করবে।আরো ভুল হচ্ছে যে, কতোক সাঈকারী প্রত্যেক চক্করে গদবাঁধা নির্ধারিত একটি করে দু‘আ পাঠ করে, যার কোন ভিত্তি নেই। তাই ইহা একটি বিদ‘আত।

[1]. সহীহ: মুসলিম ১২১৮, সুনানে দারিমী ১৮৯২, নাসাঈ ২৯৫৩।

[2]. সূরাহ্ আল-আ‘রাফঃ ৫৫

[3]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৫৮

[4]. সহীহ মুসলিম ১২১৮।