জাহিলদের নেতা হলো পাপাচারী আলিম (عالِمٌ فاجرٌ) ও মূর্খ ইবাদতকারী (عابدٌ جاهلٌ)। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِنْ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلا بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ قَالُوا أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ لِيُحَاجُّوكُمْ بِهِ عِنْدَ رَبِّكُمْ أَفَلا تَعْقِلُونَ أَوَلا يَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ) [البقرة: 75-78]

তাদের একটি দল ছিল যারা আল্লাহর বাণী শুনত অতঃপর তা বুঝে নেয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে। আর যখন তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে, বলে আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয়, বলে তোমরা কি তাদের সাথে সে কথা আলোচনা কর, যা আল্লাহ তোমাদের উপর উম্মুক্ত করেছেন, যাতে তারা এর মাধ্যমে তোমাদের রবের নিকট তোমাদের বিরূদ্ধে দলীল পেশ করে? তবে কি তোমরা বুঝ না? তারা কি জানে না যে, তারা যা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে, তা আল্লাহ জানেন? (সূরা আল-বাক্বারাহ ২: ৭৫-৭৭)।

.............................................

ব্যাখ্যা: ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও অন্যান্য জাহিল জাতির আদর্শ ব্যক্তি হলো পাপাচারী আলিম, যারা নিজের জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে না, যেমন ইয়াহুদী পন্ডিতগণ। আর যে বিদ্যা ছাড়াই আমল করে, সে হলো মূর্খ ইবাদতকারী। যেমন খ্রিষ্টান সংসার বিরাগীগণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَاباً مِنْ دُونِ اللَّهِ) [التوبة: 31]

তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পন্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসাবে গ্রহণ করেছে (সূরা আত-তাওবাহ ৯:৩১)।

অর্থাৎ তারা হারামকে হালাল ও হালালকে হারামে পরিণত করে। এ ব্যাপারে জাহিলরা তাদের অনুসরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(أَفَتَطْمَعُونَ أَنْ يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِنْ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ) [البقرة: 75]

তোমরা কি এই আশা করছ যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল যারা আল্লাহর বাণী শুনত অতঃপর তা বুঝে নেয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে (সূরা আল বাক্বারাহ ২:৭৫)।

(أَفَتَطْمَعُونَ أَنْ يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ)

তোমরা কি এই আশা করছ যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল যারা আল্লাহর বাণী শুনত অতঃপর তা বুঝে নেয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে অর্থাৎ আল্লাহর কালামের শব্দ ও সঠিক অর্থ জানার পরও কুপ্রবৃত্তি, উদ্দেশ্যে ও আকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য কালাম পরিবর্তন করে।

যেমন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মদিনায় ইয়াহুদী ব্যভিচারীর বিচারে ইয়াহুদীরা যা চেয়েছিল (তা নিম্নরূপ)। ইয়াহুদীদের একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ব্যভিচার করলে ইয়াহুদীরা বলল, তোমরা এ লোক অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট চল, কেননা, তারা জানতো যে, তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার বিধান আছে। তারা প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করার বিচার চায় না। মুহাম্মাদ যাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার চেয়ে সহজভাবে বিচার করে দেন (তারা এটা চেয়েছিল)। অতঃপর তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারীনির বিচার চাইল।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

"ما تجدون في التوراة على من زنى؟ " وفي رواية: "ما تجدون في التوراة في شأن الرجم" قالوا: فيها أننا نُسَوِّدُ وجوههم، ونُركبهم على حمير، ونطوف بهم في الأسواق. فسأل النبي صلى الله عليه وسلم عبد الله بن سلام (لأنه من أحبارهم، وقد أسلم) قال: كذبوا يا رسول الله، فطلب النبي صلى الله عليه وسلم منهم التوراة، فلما أحضروها وضع ابن صوريا أصبعه على آية الرجم، فقال له عبد الله بن سلام: ارفع أصبعك، فلما رفعه إذا آية الرجم تلوح في التوراة، فأمر بهما النبي صلى الله عليه وسلم فرجما بالحجارة حتى ماتا

তোমরা তাওরাতে ব্যভিচারীর কি বিধান পেয়েছ? অন্য রেওয়ায়েতে আছে, তাওরাতে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার বিধান সম্পর্কে কি পেয়েছ? তারা বলল, আমরা তাদেরকে অপমানিত করবো, তাদেরকে গাঁধার পিঠে চড়িয়ে বাজারে ঘুড়াবো। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের নিকট তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। (কেননা তিনি তাদের আলেম ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন)। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল! তারাতো মিথ্যা বলেছে। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওরাত কিতাব খুঁজলেন। অতঃপর তারা তাওরাত পেশ করলো। ইবনু সুরিয়া প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কীয় আয়াতের উপর তার হাত রাখলো। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন, তোমার হাত সরাও। সে হাত সরালে দেখা গেল প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা সম্পর্কে আয়াত আছে। তখন নাবী প্রস্তর নিক্ষেপে দু‘জনকে হত্যার নির্দেশ দিলেন এবং তারা মারা গেল।[1]

এটাই হলো ইয়াহুদী আলেমদের মাধ্যমে আল্লাহর কালামকে পরিবর্তন করা। তারা আল্লাহ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করতো এবং আল্লাহর বিধানকে গোপন করতো। তাদের পরিবর্তনের উদাহরণ: আল্লাহ তা‘আলা সেজদারত অবস্থায় তাদেরকে দরজা দিয়ে প্রবেশের নির্দেশ দেন এবং (حطة) হিত্তাতুন তথা ‘ক্ষমা কর’ এ কথা বলতে বলেন। অর্থাৎ আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দাও। অতঃপর তারা (حطة) হিত্তাতুন শব্দকে (حنطة) হিনতাতুন (গম) শব্দ দ্বারা ‘ن’ নুন বর্ণ বৃদ্ধি করে পরিবর্তন করে, যা তার কালাম নয়।

আল্লাহর কিতাবের (তথ্য) কম-বেশি করা অথবা অর্থ ছাড়া অপব্যাখ্যা করাই (التحريف) তাহরিফ বা পরিবর্তন। আর শব্দ ও অর্থগত উভয় দিক থেকেই পরিবর্তন হতে পারে। আর এভাবে যারা সঠিক অর্থ ব্যতীত কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে পরিবর্তন করে, তা মূলতঃ নিজের মাযহাব প্রতিষ্ঠা অথবা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ অথবা অর্থ উপার্জনের জন্যই করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا) [البقرة: 76]

আর যখন তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাৎ করে, বলে আমরা ঈমান এনেছি (সূরা বাক্বারাহ ২:৭৬)।

এটাই নেফাকী (কপটতা) হিসাবে গণ্য। আর নেফাকী ও মূল রচনার পরিবর্তন করা ইয়াহুদীদের রীতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ) [البقرة: 78]

আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর, তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ব্যতীত কিতাবের কোন জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে (সূরা বাক্বরাহ ২:৭৮)।ঐ সবলোকই হলো মূর্খ ইবাদতকারী যারা তাওরাত পড়ে কিন্তু এর অর্থ বুঝে না। অথচ ইয়াহুদীরা তাদেরকে আলেম হিসাবে গ্রহণ করে। তারা তাওরাত পড়ে কিন্তু তার অর্থ বুঝে না। এ সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা তাদেরকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে অথচ তারা মূর্খ। তাই আমলকারী আলেম ব্যতীত কারো অনুসরণ করা বৈধ নয়। অথচ তারাই ধার্মিক বলে গণ্য। অনুরূপভাবে মূর্খ ইবাদতকারীরা তপস্যা ও ইবাদত করলেও তাদের অনুসরণ করা বৈধ নয়। কেননা, তারা সঠিক পদ্ধতি ও হেদায়াতের উপর বহাল নেই।

>
[1]. ছ্বহীহ বুখারী, হা/৩৬৩৫, ৪৫৫৬, ৬৮১৯, ৭৫৪৩, ছ্বহীহ মুসলিম, হা/১৬৯৯-১৭০০।