তাকদীর বিষয়ে যা জানা ও যার উপর ঈমান আনয়ন করা প্রয়োজন উপরোক্ত আলোচনায় সংক্ষিপ্তভাবে তা বিধৃত হয়েছে। আল্লাহর অলীদের মধ্যে যার অন্তর জ্যোতিদীপ্ত তার জন্য এতটুকু জানাই প্রয়োজন। আর এটিই হচ্ছে জ্ঞানে সুগভীর প্রজ্ঞাবানদের স্তর। ইলম দু’প্রকার। (১) যে জ্ঞান সৃষ্ট জীবের নিকট বিদ্যমান। (২) যে জ্ঞান সৃষ্ট জীবের নিকট বিদ্যমান নয়। বিদ্যমান ইলমকে অস্বীকার করা যেমন কুফুরী, অবিদ্যমান জ্ঞানের দাবী করাও তেমনি কুফুরী। বিদ্যমান ইলম কবুল করা, আর অবিদ্যমান জ্ঞানের অন্বেষন করা হতে বিরত থাকা ব্যতীত কারো ঈমান সুদৃঢ় বিশুদ্ধ হবে না।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

فَهَذَا جُمْلَةُ مَا يَحْتَاجُ إِلَيْهِ مَنْ هُوَ مُنَوَّرٌ قَلْبُهُ مِنْ أَوْلِيَاءِ اللَّهِ تَعَالَى، وَهِيَ دَرَجَةُ الرَّاسِخِينَ فِي الْعِلْمِ، لِأَنَّ الْعِلْمَ عِلْمَانِ: عِلْمٌ فِي الْخَلْقِ مَوْجُودٌ، وَعِلْمٌ فِي الْخَلْقِ مَفْقُودٌ، فَإِنْكَارُ الْعِلْمِ الْمَوْجُودِ كُفْرٌ، وَادِّعَاءُ الْعِلْمِ الْمَفْقُودِ كُفْرٌ، وَلَا يَثْبُتُ الْإِيمَانُ إِلَّا بِقَبُولِ الْعِلْمِ الْمَوْجُودِ، وَتَرْكِ طَلَبِ الْعِلْمِ الْمَفْقُودِ

‘‘তাকদীর বিষয়ে যা জানা ও যার উপর ঈমান আনয়ন করা প্রয়োজন উপরোক্ত আলোচনায় সংক্ষিপ্তভাবে তা বিধৃত হয়েছে। আল্লাহর অলীদের মধ্যে যার অন্তর জ্যোতিদীপ্ত তার জন্য এতটুকু জানাই প্রয়োজন। আর এটিই হচ্ছে জ্ঞানে সুগভীর প্রজ্ঞাবানদের স্তর। ইলম দু’প্রকার। (১) যে জ্ঞান সৃষ্ট জীবের নিকট বিদ্যমান।[1] (২) যে জ্ঞান সৃষ্ট জীবের নিকট বিদ্যমান নয়।[2] বিদ্যমান ইলমকে অস্বীকার করা যেমন কুফুরী, অবিদ্যমান জ্ঞানের দাবী করাও তেমনি কুফুরী। বিদ্যমান ইলম কবুল করা, আর অবিদ্যমান জ্ঞানের অন্বেষন করা হতে বিরত থাকা ব্যতীত কারো ঈমান সুদৃঢ় বিশুদ্ধ হবে না।

......................................................................

ব্যাখ্যা: ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ এখানে فهذا দ্বারা পূর্বোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। ইসলামী শরীয়াত আক্বীদাহ ও আমল সংক্রান্ত যেসব বিষয় নিয়ে এসেছে এখানে তা উদ্দেশ্য। পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীদের স্তর বলতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে জানা উদ্দেশ্য। সৃষ্টির নিকট অবিদ্যমান ইলম বলতে তাকদীরের ইলম উদ্দেশ্য। আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি থেকে আড়াল করে ইহাকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। তিনি সৃষ্টিকে এর পিছনে ছুটতে নিষেধ করেছেন।

সৃষ্টির নিকট বিদ্যমান ইলম বলতে শরীয়তের أصول وفروع তথা মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত ইলম উদ্দেশ্য। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতদসংক্রান্ত যেসব ইলম নিয়ে এসেছেন, তা থেকে যে ব্যক্তি কোনো কিছু অস্বীকার করবে সে কাফের হয়ে যাবে এবং ইলমে গায়েব থেকে যে ব্যক্তি কোনো কিছু দাবী করবে সেও কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ

‘‘তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। তিনি অদৃশ্য বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তার মনোনীত কোনো রসূল ব্যতীত। (সূরা জিন: ২৬-২৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ

‘‘কিয়ামতের জ্ঞান শুধু আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। গর্ভাশয়ে যা থাকে, তা তিনিই জানেন।[3] কেউ জানে না, সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না, সে কোন্ যমীনে মৃত্যু বরণ করবে’’। (সূরা লুকমান: ৩৪)তাকদীর ও কিয়ামতের জ্ঞান আমাদের নিকট থেকে গোপন রাখার অর্থ এ নয় যে, তাতে কোনো হেকমত নেই। আমরা উহা জানি না, -এর অর্থও এটি নয় যে, তাতে কোনো হেকমত থাকা অনাবশ্যক। আপনি কি দেখেন না যে, সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, কীট-পতঙ্গ সৃষ্টি করার পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত আমাদের নিকট অস্পষ্ট। আমরা কেবল এগুলো ক্ষতিকর বলেই জানি। এগুলো ক্ষতিকর বলেই এ কথা বলা যাবে না যে, আল্লাহ তা‘আলা এগুলো সৃষ্টি করেন নি। এটি বলাও ঠিক নয় যে, এগুলো সৃষ্টির পিছনে এমন কোনো হেকমত নেই, যা আমাদের নিকট অস্পষ্ট রয়েছে। কেননা কোনো জিনিস সম্পর্কে ইলম না থাকা উহার অস্তিত্ব না থাকার প্রমাণ নয়।

[1]. আর তা হচ্ছে শরীয়াতের মৌলিক ও শাখা-প্রশাখা জনিত জ্ঞান।

[2]. গ্রন্থকার এখানে অবিদ্যমান ইলম বলতে গায়েবী জ্ঞান বুঝিয়েছেন। যা একমাত্র আল্লাহর সাথেই সংশিস্নষ্ট। কোনো মানুষ সেটার দাবী করলে কাফের হয়ে যাবে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ

‘‘আর তার কাছেই রয়েছে গায়েবের জ্ঞান, যা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না’’। (সূরা আল-আনআম: ৫৯) অনুরূপ মহান আল্লাহ বলেন,

قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ

‘‘বলো, আল্লাহ ব্যতীত আসমান ও যমীনের কেউই গায়েব জানে না’’। (সূরা আন-নামল: ৬৫) অনুরূপ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, গায়েবের চাবিকাঠি পাঁচটি। আল্লাহ ছাড়া আর তা কেউ জানে না। তারপর তিনি তেলাওয়াত করলেন,

إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান আর তিনিই বৃষ্টি বর্ষন করেন’’। (সূরা লুকমান: ৩৪)

অনুরূপভাবে এতদসংক্রান্ত আরও বহু হাদীছ রয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েব জানতেন না; যদিও তিনি সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ এবং রসূলদের নেতা। সুতরাং তিনি ব্যতীত অন্যরা তো মোটেই জানার কথা নয়। বস্তুত রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ জ্ঞানের কিছুই জানতেন না, যতক্ষণ না আল্লাহ তাআলা তাকে তা হতে কিছু জানাতেন। এ জন্যই আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার উপর অপবাদ দেওয়ার বিষয় নিয়ে লোকেরা যখন বলাবলি করছিল তখন তিনি অহী নাযিল হওয়ার মাধ্যমে আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার পবিত্রতার ঘোষণা না আসা পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেননি। অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো এক সফরে আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার হার হারিয়ে গেলে তিনি বেশ কয়েকজনকে সেটার খোঁজে পাঠিয়েছিলেন। সেটা কোথায় আছে সেটা জানতে পারেননি, অবশেষে যখন উট দাঁড় করানো হলো তখন তারা হারটিকে উটের নিচে দেখতে পেল। আর কুরআন ও সুন্নায় এ বিষয়ে বহু দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আর গায়েবী জ্ঞানের অন্যতম হচ্ছে, তাকদীরের জ্ঞান, যা আল্লাহ তার সৃষ্টির কাছে পর্দাবৃত রেখেছেন। সেটাও কোনো সৃষ্টিই তা জানতে পারে না।

[3]. যদি প্রশ্ন করা হয় আজকাল ডাক্তারগণও তো বলে দিতে পারে মাতৃগর্ভে ছেলে সন্তান আছে? না মেয়ে সন্তান? উত্তর হল সন্তানের গঠন পূর্ণ হওয়ার পরই ডাক্তারগণ যন্ত্রের সাহায্যে তা বলতে পারে। গঠন পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তা বলতে পারে না। তাছাড়া ডাক্তারগণ শুধু ছেলে না মেয়ে এটি বলতে পারে। সন্তান সৌভাগ্যবান হবে না হতভাগ্য হবে? তার স্বভাব-চরিত্র ভাল হবে না মন্দ হবে? সে কি ধনী হবে না ফকীর হবে? এ সমস্ত বিষয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মেঘ দেখে আমরা বলতে পারি বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বৃষ্টি হবেই, নিশ্চিতরূপে এ কথা কেউ বলতে পারে না।