ক্ষতিকর ও অপছন্দনীয় জিনিস সৃষ্টি করার তাৎপর্য বা হেকমত - ১

এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে এমন জিনিসের ইচ্ছা করেন যা তিনি পছন্দ করেন না ও ভালোবাসেন না? তিনি কিভাবে এর ইচ্ছা করেন ও তৈরি করেন? কিভাবে তিনি একই সাথে তার ইচ্ছা করেন এবং ঘৃণা করেন।

এ প্রশ্ন থেকেই উম্মত বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এ থেকেই তাদের মত ও পথ বিভিন্ন হয়েছে। এ জাতিয় প্রশ্নের জবাবে ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা করেন, তা দুই প্রকার।

(১) যা মূলগত দিক থেকেই আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা করেছেন। যেমন ঈমান ও আনুগত্যের কাজগুলো তিনি মূলগত দিক থেকেই পছন্দ করে সৃষ্টি করেছেন। মুমিনদের থেকে তিনি চেয়েছেন যে, তারা এগুলো বাস্তবায়ন করুক।

(২) যা মূলগত দিক থেকে ইচ্ছা করেননি: বরং অন্য কারণে ইচ্ছা করেছেন। যেমন তিনি পাপাচারকেও সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন, কিন্তু মূলগত দিক থেকে এগুলোকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেননি। বরং অন্য একটি উদ্দেশ্যে তথা বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

যা তিনি মূলগত দিক থেকে ইচ্ছা করেছেন এবং তাতে যেই কল্যাণ রয়েছে তা মূলতই প্রিয়।[1] তাকে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি স্বীয় উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন। আর যা অন্য কারণে ইচ্ছা করেছেন, তা দ্বারা তিনি সরাসরি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন না। তার ব্যক্তিসত্তার দিকে তাকালে তাতে কোনো কল্যাণও দেখা যায়না। তবে এ কথা সঠিক যে ইবলীসকে সৃষ্টি করার পিছনে আল্লাহ তা‘আলার অন্য একটি মাকসুদ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সুতরাং ইবলীস তার নফ্স ও সত্তার দিক থেকে নিন্দিত ও ঘৃণীত। কিন্তু বিশেষ একটি হেকমত ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য ইবলীসকে সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল।

ইবলীস সৃষ্টির মধ্যে দু’টি বিষয় একসাথে মিলিত হয়েছে। তাকে ঘৃণা করা এবং তাকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা। বিষয় দু’টি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কেননা উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত ও সংশিস্নষ্ট বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। বিষয়টি ঠিক অরুচিকর ঔষধের ন্যায়। মানুষ যখন জানতে পারে যে, অরুচিকর ঔষধের মধ্যে তার আরোগ্য রয়েছে, তখন সে তিতা লাগলেও তা সেবন করে। কারণ তা পান করার মধ্যে তার স্বার্থ রয়েছে।

ঠিক এমনি মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গে যখন পচন ধরে, তখন সে যদি জানতে পারে যে, উহা কেটে ফেলে দেয়ার মধ্যেই তার কল্যাণ রয়েছে, তাহলে অপছন্দ হলেও সে শরীরের অঙ্গ কেটে ফেলে। কেননা সে বুঝতে পেরেছে যে, অঙ্গটি কেটে ফেলাই শরীরের বাকী অংশের জন্য নিরাপদ। মুসাফির যখন জানতে পারে যে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার মধ্যে তার কল্যাণ রয়েছে এবং তা অতিক্রম করার মাধ্যমে সে প্রিয় বস্তু লাভ করতে পারবে, তখন কষ্ট লাগলেও বহু দূরের পথ ভ্রমণ করে।[2] প্রতিটি বুদ্ধিমান মানুষই এ অপছন্দনীয় কাজগুলো করার ইচ্ছা করে এবং প্রবল ধারণা রাখে যে, এতে তার কল্যাণ রয়েছে। যদিও তার কাছে অনেক ক্ষেত্রে পরিণাম অস্পষ্ট থাকে।

সুতরাং যেই মহান সত্তার কাছে কোনো কিছুই অস্পষ্ট নয়, তিনি এমন অপছন্দনীয় বস্তু সৃষ্টি করবেন না কেন, যার পরিণাম ভালো হয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কোনো জিনিসকে অপছন্দ করেন। এ অপছন্দ করা উহাকে অন্য একটি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করার পরিপন্থি নয়। কেননা উহা সৃষ্টি করার মাধ্যমে এমন একটি প্রিয় জিনিস হাসিল হয়, যা উহা সৃষ্টি না হলে হত না। উদাহরণ স্বরূপ ইবলীস সৃষ্টি করার বিষয়টি পেশ করা যেতে পারে। এ ইবলীসই মানুষের দ্বীন, আমল, আক্বীদাহ এবং সৎ ইচ্ছা ধ্বংসের মূল কারণ। সে অনেক বনী আদমের দুর্ভাগ্যের কারণে পরিণত হয়েছে। এ ইবলীসের কারণেই মানুষ এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়, যাতে তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ক্রোধের শিকার হয়। ইবলীস আল্লাহর পছন্দনীয় ও প্রিয় আমলগুলোর বিপরীত কর্মকান্ড সংঘটিত হওয়ার কারণ। এত কিছু সত্ত্বেও তাকে সৃষ্টি করার কারণে আল্লাহ তা‘আলার অনেক প্রিয় জিনিস অর্জিত হয়। সুতরাং ইবলীস না থাকার চেয়ে থাকাই ভালো।

(১) পরস্পর বিপরীতমুখী জিনিস সৃষ্টি করে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের নিকট স্বীয় কুদরত প্রকাশ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এ নিকৃষ্টতম অপদার্থটি সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক পাপাচারের মূল কারণ হলো এ শয়তান। আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিবরীলের বিপরীতে সৃষ্টি করেছেন। জিবরীল হলেন সৃষ্টিকূলের সকল প্রকার কল্যাণের মাধ্যম।[3]

সকল কল্যাণের মূলেই রয়েছেন তিনি। আসমান থেকে তিনিই সমস্ত নাবী-রাসূলের নিকট অহী নিয়ে আগমন করেছেন। সুতরাং মহান আল্লাহ এটি সৃষ্টি করেছেন ঐটিও সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে তার কুদরত প্রকাশিত হয়েছে। যেমন তিনি দিন সৃষ্টি করেছেন। তার বিপরীতে রাত সৃষ্টি করেছেন। তিনি রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করেছেন, তার বিপরীতে চিকিৎসা সৃষ্টি করেছেন। জীবন ও মরণ সৃষ্টি করেছেন, ভালো ও মন্দ সৃষ্টি করেছেন এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত সৃষ্টিই যদি ভালো হতো, তাহলে বুঝা সম্ভব ছিল না যে, এগুলো ভালো। সুতরাং মন্দের মন্দত্ব অনুভব করা ব্যতীত ভালোর ভালোত্ব বুঝা সম্ভব নয়। তিনি তাওহীদ ও শির্ক সৃষ্টি করেছেন, সুন্নাত ও বিদআত সৃষ্টি করেছেন, আনুগত্য ও পাপাচার সৃষ্টি করেছেন এবং অলী-আওলীয়া ও আল্লাহর দুশমন সৃষ্টি করেছেন, মুত্তাকী ও পাপাচারী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির এ বৈপরিত্য তার পরিপূর্ণ কুদরত, শক্তি, রাজত্ব এবং ক্ষমতার উৎকৃষ্টতম দলীল। তিনি এ পরস্পর বিপরীতমুখী জিনিসগুলো সৃষ্টি করেছেন। এগুলো থেকে কতকের বিপরীত অন্য কতককে সৃষ্টি করেছেন। এগুলোকে তিনি তার পরিচালনা ও তদবীরের মহল বানিয়েছেন। সুতরাং সৃষ্টিজগত থেকে কিছু সৃষ্টি যদি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা হেকমত ও তার রাজত্বের পরিপূর্ণ পরিচালনা ও পরিচর্যার মধ্যে ত্রুটি দেখা দিবে।

(২) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্য থেকে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার প্রতাপশালীতা সংক্রান্ত নামগুলোর প্রভাব সৃষ্টির উপর পতিত হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলার নামগুলোর মধ্যে রয়েছে, القَهَّار (পরাক্রমশালী), المنتقم (প্রতিশোধ গ্রহণকারী), العدل (ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী), الضَّار (ক্ষতিকারক), شديد العقاب (কঠিন শাস্তি প্রদানকারী), سريع العقاب (দ্রুত শাস্তি প্রদানকারী, ذو البطش الشديد (কঠোরভাবে পাকড়াওকারী), الخَافِض (নিচুকারী), المذل (অপদস্তকারী) ইত্যাদি। কেননা আল্লাহ তা‘আলার এ অতি সুন্দর নাম ও কর্মগুলো তার কামালিয়াত তথা পূর্ণতার পরিচায়ক। এমন কিছু সৃষ্টি থাকা প্রয়োজন, যাদের উপর এ সিফাতগুলোর প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে যদি এমন কিছু সৃষ্টি না থাকতো, যাদেরকে পরাভুত করা হবে, যাদের হিসাব নেয়া হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে, তাহলে القهار নামের প্রভাব প্রকাশ পেতো না। অনুরূপ অপরাধী না থাকলে ذو البطش الشديد (কঠোরভাবে পাকড়াওকারী) সিফাতের প্রভাব প্রকাশ পেতো না, নীচু হওয়ার যোগ্য কেউ না থাকলেالخَافِض (নিচুকারী) নামের প্রভাব প্রকাশ পেতো না। অপমানিত হওয়ার যোগ্য কেউ না থাকলে المذل (অপদস্তকারী) নামের প্রভাব প্রকাশিত হতো না।[4] অন্যান্য নামের ক্ষেত্রে কথা একই।

(৩) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্যে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ঐ সমস্ত নামের প্রভাব বান্দাদের উপর পড়বে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে তার সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এবং তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেয়ার অর্থ। তিনি যদি এমন কোনো অপছন্দনীয় কাজ সৃষ্টি না করতেন, যা এ সমস্ত অতি সুন্দর নামগুলোর প্রভাব প্রকাশ হওয়ার কারণ হয়, তাহলে তার নামগুলোর হেকমত ও উপকারীতা অকেজো হয়ে যেত। এ দিকে ইঙ্গিত করেই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«لولم تذنبوا لذهب الله بكم ولجاء بقوم يذنبون ويستغفرون فيغفر لهم»

‘‘তোমরা যদি অপরাধ না করতে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে ধ্বংস করে তোমাদের স্থলে এমন লোক সৃষ্টি করতেন, যারা অপরাধ করার পর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন’’।[5]

(৪) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্য থেকে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কিত নামসমূহের প্রভাব প্রকাশিত হয়। কেননা তিনি হলেন প্রজ্ঞাবান ও সুবিজ্ঞ। তিনি প্রত্যেক জিনিসকে যথাস্থানে স্থাপন করেন এবং প্রত্যেক জিনিসের জন্য যেই স্থান উপযুক্ত তিনি তাকে সেখানেই রাখেন। তিনি কোনো জিনিসকে তার নির্দিষ্ট স্থানে না রেখে অন্য স্থানে রাখেন না। তার পরিপূর্ণ ইলম, হেকমত ও জ্ঞান যে জিনিস যে স্থানে রাখার দাবি করে, তাকে তিনি সেই স্থান বাদ দিয়ে অন্য স্থানে রাখেন না। তিনি কাকে রসূল বানাবেন তা তিনিই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি আরো অবগত আছেন যে, কে রেসালাত কবুল করার জন্য বেশী উপযোগী এবং কে তা পেয়ে বেশী কৃতজ্ঞ হবে। কে রেসালাতের উপযুক্ত নয়, তিনি তাও জানেন। তিনি যদি অপছন্দনীয় কাজকর্ম সৃষ্টি না করতেন, তাহলে অনেক হেকমত বাতিল হয়ে যেত এবং বহু উপকার ছুটে যেত। মন্দ জিনিসগুলোর মধ্যে যেই ক্ষতি রয়েছে, তার কারণে যদি সৃষ্টি না করা হতো, তাহলে উক্ত জিনিসগুলোর মধ্যে যে পরিমাণ ক্ষতি রয়েছে, তার তুলনায় বহুগুণ বড় উপকার হাত ছাড়া হতো। এটি ঠিক সূর্যের তাপ, বৃষ্টি এবং বাতাসের ক্ষতির মতই। তাতে যে পরিমাণ ক্ষতি রয়েছে, তার তুলনায় উপকার অনেক বেশী।

(৫) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্য থেকে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের মধ্যে ভিন্নতা আসে। ইবলীস ও তার বাহিনী সৃষ্টি না করা হলে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার ফযীলত অর্জন এবং তার রাস্তায় শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করা থেকে আল্লাহর বান্দাগণ বঞ্চিত হতো। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদ করা তার নিকট অত্যন্ত প্রিয় একটি ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলা যদি শুধু ভালো আমলই সৃষ্টি করতেন এবং সমস্ত মানুষই যদি মুমিন হতো, তাহলে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ এবং তার আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলো বাতিল হয়ে যেত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং তার জন্যই কাউকে শত্রু বানানোর ইবাদতটি অচল হয়ে যেত। সেই সঙ্গে সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজের নিষেধ করা, আল্লাহর পথে ধৈর্য ধারণ করা, কুপ্রবৃত্তির বিরোধীতা করা, আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় আমলকে প্রাধান্য দেয়া, তাওবা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, যাতে করে তিনি বান্দাকে তার শত্রু এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র ও কষ্ট থেকে নিরাপত্তা দান করেন। ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে এমনি আরো অনেক হেকমত রয়েছে, যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে অক্ষম।

[1]. উদাহরণ স্বরূপ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করার বিষয়টি পেশ করা যেতে পারে। এটি আল্লাহ তা‘আলার কর্মসমূহের অন্যতম একটি কর্ম। তিনি স্বীয় ইচ্ছায় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন। মূলতই মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করার মধ্যে বিরাট কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিগত থেকেই প্রিয়।

আর আল্লাহ যা অন্য কারণে ও বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তার ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নাও থাকতে পারে এবং তার ব্যক্তিসত্তার দিকে দৃষ্টি দিলে সেখানে কোনো মঙ্গল নাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু অন্য একটি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মাধ্যম স্বরূপ তাকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন ধরুন আল্লাহ তাআলা ইবলীসকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে সৃষ্টি করা মূলগত দিক থেকে উদ্দেশ্য নয়, তার ব্যক্তিসত্তার দিকে তাকালে দেখা যায় তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।

কিন্তু আল্লাহ তাআলার হেকমতের দাবি এই যে, তিনি মানুষকে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এক শ্রেণী হবে কাফের আরেক শ্রেণী হবে মুমিন। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً ‘‘আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। (সূরা হুদ: ১১৮) কিন্তু তিনি ইচ্ছা করেন নি। তার হেকমতের দাবি হলো মানুষ দু’টি জাতিতে বিভক্ত হবে। সুতরাং আদি থেকে এই হলো হেকমতের দাবি। এই মর্মে আল্লাহ তাআলার ফায়ছালা হয়ে গেছে যে, একদল মানুষ জান্নাতে যাবে আরেক দল যাবে জাহান্নামে। এটি একটি মীমাংসিত বিষয়।

ইবলীস নামক অকল্যাণটি মূলত উদ্দেশ্য নয়, সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রিয়ও নয়। তবে তার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার অন্য একটি উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে। তা হলো তার কারণে একদলকে জান্নাতে প্রবেশ করানো এবং আরেকদলকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ইবলীসকে পছন্দ করে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেননি; বরং অন্য কারণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ইবলীসকে সৃষ্টি করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত এভাবে পূর্ণ হয়েছে এক শ্রেণীর মানুষ ইবলীসের অবাধ্য হয়ে জান্নাতে যাবে আরেক শ্রেণীর মানুষ তার আনুগত্য করে জাহান্নামে যাবে। সুতরাং ইবলীস সৃষ্টি করার ফলে অনেক স্বার্থ অর্জিত হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার মহা হিকমত বাস্তবায়ন হয়েছে। যদিও সত্তাগত দিক থেকে ইবলীস খুবই নিকৃষ্ট, মূলগত দিক থেকেও সে অপ্রিয়। তবে তার মাধ্যমে যেহেতু আল্লাহর ফায়ছালার দিকে পৌঁছা যায় এবং হেকমত বাস্তবায়ন হয়, তাই আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

[2]. মানুষ হাজার হাজার মাইলের পথ অতিক্রম করে মক্কায় আগমণ করে। দিন-রাত অনেক কষ্ট করে আল্লাহর ঘরের নিকট উপস্থিত হয়। আল্লাহর ঘর দেখে সে আনন্দ পায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একই জিনিস একদিক থেকে কষ্টকর। কিন্তু উহাতে যেই ফলাফল ও সুখণ্ডশান্তি অর্জিত হয়, তার দিকটা বিবেচনায় খুব ভালো। সুতরাং একই জিনিস একদিক থেকে প্রিয় এবং মূলগত দিক থেকে অপ্রিয় হওয়ার কারণে উহা পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কোনো ডাক্তার যদি তার রোগীকে বলে তোমার এই অঙ্গটি কেটে ফেললে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ৮০% কিংবা ৭০%, তাহলে রোগী অঙ্গ কেটে ফেলতে রাযি হয়ে যায়। এখানে রোগী আরোগ্য লাভের ৮০% বা ৭০% সম্ভাবনা থাকার কারণেই মনের মধ্যে ভালো একটি প্রিয় আশা নিয়ে কষ্টকর এবং অপছন্দনীয় একটি কাজ করে ফেলে। সুতরাং তার প্রিয় আশাটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত নয়।

সাধারণ একটি আল্লাহর সৃষ্টি যেখানে পরিণাম সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত না হয়েই ভালো ফলাফলের আশা নিয়ে একটি ঝুকিপূর্ণ ও কষ্টকর কাজের দিকে অগ্রসর হয়, সেখানে মহান স্রষ্টা আল্লাহ সবকিছু অবগত, মন্দ বিষয় সৃষ্টি করা থেকে কল্যাণ ও ভালো ফলাফল অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে যেহেতু সম্পূর্ণ নিশ্চিত, তাই তার জন্য মন্দ জিনিস সৃষ্টি করা মোটেই দোষণীয় নয়।

[3]. এখানে লেখকের এটি উদ্দেশ্য নয় যে, জিবরীল সর্বোত্তম সৃষ্টি। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বোত্তম সৃষ্টি।

[4]. এ সমস্ত নাম তার বিপরীত অর্থবোধক নাম উল্লেখ ছাড়া আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা শোভা পায় না। এগুলো যদি এককভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে পূর্ণতার স্থলে অপূর্ণতা ও ত্রুটি বুঝায়। যেমন الضَّار النّاَفِع (ক্ষতিকারক ও কল্যাণকারী), الخَافِض الرَّافِع (নিচুকারী ও উত্তোলনকারী), الْمَانِع الْمُعْطِي (দাতা ও প্রতিরোধকারী), المُعِزُّ المُذِلُّّ (সম্মানদাতা ও অপমানকারী) ইত্যাদি। সুতরাং এককভাবে শুধু الضَّار,الخَافِض , الْمَانِع এবং المُذِلُّ ব্যবহার করা জায়েয নেই।

[5]. ছহীহ মুসলিম হা/২৭৪৯।