পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকার করা ব্যতীত কারও পা ইসলামের উপর দৃঢ় থাকতে পারে না।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (وَلَا تَثْبُتُ قَدَمُ الْإِسْلَامِ إِلَّا عَلَى ظَهْرِالتَّسْلِيمِ وَالِاسْتِسْلَامِ) পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকার করা ব্যতীত কারও পা ইসলামের উপর দৃঢ় থাকতে পারে না।

.............................................................................

ব্যাখ্যা: এখানে শাইখ ইঙ্গিতসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন। কেননা মানুষের পা সাধারণত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিসের উপরই পতিত হয়। অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের সামনে যে ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করবে না এবং তার সামনে মস্তক অবনত করবে না, সে ইসলামের উপর টিকে থাকতে পারবে না। মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো, সে স্বীয় রায়, মতামত, বিবেক-বুদ্ধি এবং কিয়াসের আশ্রয় নিয়ে কুরআন-হাদীছের দলীলের বিরোধিতা করবে না ও উহার ফায়ছালার উপর আপত্তি উত্থাপন করবে না।

ইমাম বুখারী মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, ইসলামের বাণী এসেছে আল্লাহর পক্ষ হতে, রাসূলের দায়িত্ব হলো পৌঁছিয়ে দেয়া এবং আমাদের উপর আবশ্যক হলো তা সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেয়া। ইমাম ইবনে শিহাব যুহরীর এ কথাটি খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক এবং উপকারী। শরীয়াতের দলীলের সাথে বোধশক্তির দলীলের দৃষ্টান্ত হলো মুর্খ মুকাল্লিদ লোকের সাথে মুজতাহিদ আলেমের দৃষ্টামেত্মর অনুরূপ। শুধু তাই নয়; মুজতাহিদ আলেমের তুলনায় একজন সাধারণ মুসলিমের মর্যাদার চেয়ে শরীয়তের দলীলের তুলনায় বিবেক-বুদ্ধির দলীলের মর্যাদা আরো নগণ্য। কেননা মুর্খ লোকের পক্ষে আলেম হওয়া সম্ভব, কিন্তু আলেমের পক্ষে নাবী কিংবা রসূল হওয়া অসম্ভব।

কোনো মুর্খ মুকাল্লিদ (দলিলবিহীন অনুসরণকারী) যখন কোনো আলেম সম্পর্কে জানতে পেরে অন্য একজন মূর্খ লোককে সে আলেমের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জিজ্ঞাসিত মাস‘আলায় মুফতী এবং পথ প্রদর্শনকারী যদি পরস্পর মতভেদ করে তখন মুফতীর কথাই কবুল করে নেয়া আবশ্যক; পথ প্রদর্শকের কথা নয়। এ ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক যদি বলে, আমার কথাই ঠিক; মুফতীর কথা নয়। কেননা আমি তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি যে, সে মুফতী। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমি মূল। তুমি যদি আমার কথার উপর তার কথাকে প্রাধান্য দাও, তাহলে তুমি সে মূলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিবে, যার মাধ্যমে তুমি জানতে পেরেছো যে, সে মুফতী। এতে করে মূল বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে শাখাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাওয়া আবশ্যক হবে। এখন মুফতীকে ফতোয়া জিজ্ঞেসকারী যদি পথ প্রদর্শনকারীকে বলে, তুমি যখন সাক্ষী দিয়েছো যে, সে মুফতী এবং তাকে দেখিয়ে দিয়েছো, তখন তোমাকে বাদ দিয়ে তার তাকলীদ করাই আবশ্যক হওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছো। সুতরাং তোমার কথা মেনে নিয়ে মুফতীর কাছে ফতোয়া নিতে আসার অর্থ এ নয় যে, প্রত্যেক মাস‘আলাতেই আমার উপর তোমার কথা সমর্থন করা আবশ্যক হবে। যে মুফতী তোমার চেয়ে বেশী জ্ঞানী তার সাথে মতভেদ করার সময় তোমার ভুল সিদ্বান্ত আবশ্যক করে না যে, তুমি মুফতীকে দেখিয়ে দিতেও ভুল করেছো। যদিও সে জানে যে উক্ত মুফতী কখনো কখনো ভুল ফতোয়া দিয়ে থাকে।

প্রত্যেক বিবেকবান মুসলিএ জানে যে, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে খবর দিয়েছেন, তাতে তিনি ভুলের সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। তার পক্ষে ভুল করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিবেকবান প্রত্যেক মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো সে রাসূলের কথার সামনে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পন করবে এবং তার সামনে নত হবে। দ্বীন ইসলামের একটি জানা বিষয় হলো, কোনো মানুষ যদি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, আপনি আমাদের জন্য যে কুরআন পাঠ করছেন এবং যে হিকমত আমাদের জন্য বর্ণনা করছেন, সেগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যে এমন কিছু জিনিস রয়েছে, যার অনেকাংশই আমাদের বোধশক্তির বিরোধী। অথচ আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে আপনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। সুতরাং আমাদের বিবেক-বুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও যদি আপনার সমস্ত কথা মেনে নেই, তাহলে যার মাধ্যমে আমরা আপনার সত্যতা জানতে পেরেছি, তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আপনার বাহ্যিক কথা থেকে যা আমাদের বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা বিবেক-বুদ্ধির দলীলকেই প্রাধান্য দিবো। আপনার সেই কথা মেনে নেয়া থেকে বিরত থাকবো, তা থেকে আমরা ইলম ও হেদায়াত গ্রহণ করবো না। যে ব্যক্তি এ ধরণের কথা বলবে, তার ব্যাপারে কথা হলো, সে রাসূলের নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবেন না।

শুধু তাই নয়; প্রত্যেক বিবেকবান মুসলিম অবশ্যই অবগত রয়েছে যে, এটি যদি জায়েয হয় তাহলে প্রত্যেক লোকই রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যেক আদেশ ও খবরের ক্ষেত্রেই একই কথা বলার সুযোগ পেয়ে যাবে। কেননা বিভিন্ন মানুষের বিবেক-বুদ্ধি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তাদের সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের শেষ নেই। ঐদিকে শয়তান তো মানুষের অন্তরে সবসময় কুমন্ত্রনা দিয়েই চলছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ

‘‘পরিষ্কার ভাষায় শুনিয়ে দেয়া ছাড়া রাসূলের আর কোন দায়িত্ব নেই’’। (সূরা আন নূর: ৫৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ

‘‘তাহলে কি রসূলদের উপর সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব আছে?’’ (সূরা আন নাহল: ৩৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আমি প্রত্যেক রসূলকেই তার জাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের নিকট পরিস্কারভাবে বর্ণনা করবার জন্য। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা ইবরাহীম: ৪) আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

قَدْ جَاءكُم مِّنَ اللّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ

‘‘তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এসেছে এবং এসেছে একটি সমুজ্জ্বল কিতাব’’। (সূরা মায়েদা: ১৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ

‘‘হা-মীম, সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ’’। (সূরা দুখান: ১-২, যুখরুফ:১-২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ

‘‘এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত’’। (সূরা ইউসুফ:১)

আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউসুফের ১১১ নং আয়াতে আরো বলেন,

لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

‘‘তাদের কাহিনীতে জ্ঞানী লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। কুরআন মিথ্যা বাণী নয়; বরং এটি পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী, সমস্ত বিষয়ের বিশদ ব্বিরণ এবং বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথ-নির্দেশ ও করুণা’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাহালের ৮৯ নং আয়াতে বলেন,

وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ

‘‘আমি তোমাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্বিরণ স্বরূপ এবং মুসলিমদের পথ নির্দেশ, রহমত ও সুসংবাদ স্বরূপ’’। কুরআনে এ রকম আয়াত আরো অনেক রয়েছে।

সুতরাং আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান সম্পর্কিত বিষয়ে কথা হলো, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এ ব্যাপারে এমন দলীল-প্রমাণসহ কথা বলেছেন, যা প্রমাণ করে যে, তা সত্য? না এ বিষয়ে দলীল-প্রমাণসহ কথা বলেননি? দ্বিতীয় কথাটি সম্পূর্ণ বাতিল। তিনি যদি এমন সংক্ষিপ্ত শব্দমালা দ্বারা কথা বলতেন, যা সম্ভাব্য সত্যের প্রমাণ করে, তাহলে এ কথা বলা আবশ্যক হয় যে, তিনি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেননি। অথচ সর্বোত্তম যুগের মর্যাদাবান মুসলিমগণ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের নিকট দ্বীনের সমস্ত হুকুম-আহকাম সুস্পষ্ট করেই বর্ণনা করেছেন। তাদের এ সাক্ষ্যের উপর বিদায় হজ্জের বছর আরাফা দিবসে আল্লাহ তা‘আলাকে সাক্ষ্য রেখেছেন। সুতরাং যারা বলবে, তিনি দ্বীনের মূলনীতিগুলো স্পষ্ট করে বর্ণনা করেননি, সে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মিথ্যারোপ করল।