আল্লাহর সাক্ষাৎ অস্বীকারকারীদের দলীল ও তার জবাব - ১

মুতাযেলা এবং আল্লাহর দিদার অস্বীকারকারী অন্যান্য সম্প্রদায় দলীল হিসাবে আল্লাহর বাণী: لَنْ تَرَانِي ‘‘তুমি আমাকে কখনই দেখতে পাবে না’’ (সূরা আরাফ : ১৪৩)- এবং আল্লাহর বাণী, لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ ‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। কিন্তু তিনি দৃষ্টিকে আয়ত্ত করে নেন’’ (সূরা আন‘আম : ১০৩)-এ আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছে। অথচ আয়াত দু’টি তাদের কথার পক্ষের দলীল নয়; বরং তাদের কথার বিপক্ষের দলীল।

প্রথম আয়াত দ্বারা একাধিক পদ্ধতিতেই আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত করা যায়।

(১) আল্লাহর সম্মানিত রসূল মুসা কালীমুল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা করা অসম্ভব যে, তিনি আল্লাহর কাছে এমন জিনিস প্রার্থনা করবেন, যা তার জন্য অবৈধ। কেননা তিনি ছিলেন আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সে যামানার সর্বাধিক জ্ঞানী। মুতাযেলাদের নিকট এ ধরনের প্রশ্ন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।

(২) আল্লাহ তা‘আলা তার সাক্ষাৎ প্রার্থনার ক্ষেত্রে মুসা আলাইহিস সালামের প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু নূহ আলাইহিস সাল্লাম যখন আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার পুত্রের মুক্তির-নাজাতের ব্যাপারে প্রার্থনা করলেন, তখন তিনি নূহ আলাইহিস সালামের প্রতিবাদ করেছেন এবং বলেছেন,

إِنِّي أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ

‘‘আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, নিজেকে অজ্ঞদের মতো বানিয়ে ফেলো না’’। (সূরা হুদ: ৪৬)

(৩) আল্লাহ বলেছেন, لَنْ تَرَانِي ‘‘তুমি আমাকে কখনই দেখতে পাবে না’’। তিনি এ কথা বলেননি যে, আমাকে দেখা সম্ভব নয় অথবা এটি বলেননি যে, আমাকে দেখা বৈধ নয় কিংবা বলেননি যে, আমাকে দেখা যায় না। উভয় প্রকার জবাবের মধ্যে পার্থক্য অতি সুস্পষ্ট। আপনি কি লক্ষ্য করেন না, কারো জামার আস্তিনে পাথর থাকলে কেউ যদি তাকে খাবার মনে করে এবং বলে আমাকে তা থেকে খাবার দাও, তখন সঠিক জবাব হলো এগুলো খাওয়া যায় না। কিন্তু যদি সেগুলো আসলেই খাদ্য-দ্রব্য হয়ে থাকে তাহলে এ কথা বলা জায়েয আছে যে, إنك لن تأكله ‘‘তুমি তা খেতে পারবে না’’। এতে প্রমাণ মিলে যে, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে মুসার শক্তি তার দিদার বরদাশত করতে সক্ষম নয়। কেননা দুনিয়ার জীবনে মানুষের শক্তি কম থাকার কারণে আল্লাহর দিদার বরদাশত করতে অক্ষম।[1]

(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَٰكِنِ انظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقًا

‘‘তবে পাহাড়ের দিকে তাকাও। পাহাড়টি যদি নিজের জায়গায় স্থির থাকতে পারে তাহলে অবশ্যই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। (সূরা আরাফ: ১৪৩)

আল্লাহ তা‘আলা মুসাকে জানিয়ে দিলেন যে, পাহাড় অত্যন্ত মজবুত ও শক্ত হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াতে আল্লাহর জ্যোতি বরদাশত করতে পারে না। তাহলে যে মানুষকে অত্যন্ত দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে সে ইহ জগতে আল্লাহর দিদার বরদাশত করবে কিভাবে?

(৫) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পাহাড়কে ঠিক রাখতে সক্ষম। তার জন্য এটি মোটেই অসম্ভব নয়। আল্লাহর দিদারকে পাহাড় স্থির থাকার সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, পাহাড় যদি স্বীয় স্থানে স্থির থাকে, তাহলে তুমি অবশ্যই আমাকে দেখতে পাবে।

আল্লাহকে দেখা যদি অসম্ভব হতো, তাহলে আল্লাহর কথাটি এরূপ হতো, إِنِ اسْتَقَرَّ الْجَبَلُ فَسَوْفَ آكُلُ وَأَشْرَبُ وَأَنَامُ ‘‘অর্থাৎ পাহাড় স্থির থাকে, তাহলে অচিরেই আমি খাবো, পান করবো এবং ঘুমাবো। সুতরাং আমার জন্য যেমন খাওয়া, পান করা ও ঘুমানো সম্ভব নয়, তাই পাহাড় স্থির থাকাও অসম্ভব। এক কথায় পাহাড় স্থির থাকা সম্ভব এবং আল্লাহ তা‘আলাকে দেখাও সম্ভব। মুতাযেলাদের মতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা বৈধ হওয়া তার জন্য পানাহার গ্রহণকরা বৈধ হওয়ার মতই।

(৬) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا ‘‘তার রব যখন পাহাড়ে জ্যোতি প্রকাশ করলেন তখন তা তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল’’ (সূরা আরাফ :১৪৩)।

পাহাড়ের জন্য যখন আল্লাহর নূর ছাড়া বৈধ হলো, অথচ পাহাড় হলো জড়বস্তু, তার কোনো শাস্তি বা পুরস্কার নেই, তখন সম্মানের ঘর জান্নাতে তার রসূল ও অলীদের জন্য কিভাবে তা অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুসাকে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, ইহ জগতে পাহাড় যেহেতু আল্লাহর দিদারের জন্য টিকে থাকতে পারেনি, তাই মানুষ পাহাড়ের চেয়ে অধিক দুর্বল বিধায় তার পক্ষে টিকে থাকা মোটেও সম্ভব নয়।

(৭) আল্লাহ তা‘আলা মুসার সাথে কথা বলেছেন, তাকে ডাক দিয়েছেন এবং চুপিসারে বাক্যালাপ করেছেন। যার জন্য বিনা মাধ্যমে কথা বলা জায়েয এবং যার সম্বোধন অন্যকে শুনানো বৈধ তাকে দেখা আরো উত্তমভাবেই বৈধ হবে। এ জন্যই আল্লাহর কথা বলা বিশেষণকে অস্বীকার না করলে, তার দিদার অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আর তারা উভয়টিকেই অস্বীকার করেছে।

তারা দাবি করে থাকে যে, لن تراني এর মধ্যকার لن অব্যয়টি تأبيد النفي অর্থাৎ চিরস্থায়ী নাকোচ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আখেরাতেও আল্লাহর দিদারকে নফী বা নাকোচ করা হয়েছে। তাদের এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা যদি ধরেও নেয়া হয় যে, لن অব্যয়টি চিরস্থায়ী নফী বা নাকোচ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তথাপিও যেহেতু এটি দ্বারা আখেরাতে আল্লাহর দিদারের নফী বা নাকোচ বুঝা যায় না, তাহলে তাবীদসহ নফী না করা হলে তো আরো উত্তমভাবেই চিরস্থায়ী নফী করা হবে না।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ৯৫ নং আয়াতে বলেন, وَلَن يَتَمَنَّوْهُ أَبَدًا ‘‘তারা কখনোই মৃত্যু কামনা করবে না’’। অথচ জাহান্নামীরা যে আখেরাতে মৃত্যু কামনা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তা উল্লেখ করে বলেন,

وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ إِنَّكُم مَّاكِثُونَ

‘‘তারা চিৎকার করে বলবে হে মালেক! তোমার রব যেন আমাদেরকে একেবারে ধ্বংস করে দেন। তিনি জবাবে বলবেন, তোমাদের এভাবেই থাকতে হবে’’। (সূরা যুখরুফ: ৭৭)

সুতরাং لن যদি চিরস্থায়ী নফী অর্থে ব্যবহৃত হতো, তাহলে তার পরে এমন ফেল বা ক্রিয়া আসতো না, যা দ্বারা ব্যতিক্রম বুঝা যায়। অথচ কুরআনে لَنْ দ্বারা চিরস্থায়ী নফীর ব্যতিক্রম অর্থও বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউসুফের ৮০ নং আয়াতে বলেন,

فَلَنْ أَبْرَحَ الْأَرْضَ حَتَّىٰ يَأْذَنَ لِي أَبِي

‘‘আমি তো এখান থেকে কখনোই যাবো না যে পর্যন্ত না আমার বাপ আমাকে অনুমতি দেন’’। এতে প্রমাণিত হলো যে, لن দ্বারা চিরস্থায়ী নাকচ করা হয় না। নাহুশাস্ত্রের অন্যতম ইমাম ইবনে মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَمَنْ رَأَى النَّفْيَ بِلَنْ مُؤَبَّدًا ... فَقَوْلُهُ ارْدُدْ وَسِوَاهُ فَاعْضُدَا

‘‘যে ব্যক্তি মনে করবে, لن দ্বারা চিরস্থায়ী নফী করা হয়, তার কথা প্রত্যাখ্যান করো এবং তার কথার বিপরীত অর্থকেই শক্তিশালী করো’’। আল্লাহর বাণী:

لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ

‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না। কিন্তু তিনি দৃষ্টিকে আয়ত্ত করে নেন’’ (সূরা আনআম:১০৩)

এ আয়াত দ্বারাও অতি সুক্ষ্ণ ও সুন্দরভাবে আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলার প্রংশসা প্রসঙ্গে উপরোক্ত কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি জানা কথা যে, প্রংশসা কেবল উত্তম গুণাবলী সাব্যস্ত করার মাধ্যমে হয়ে থাকে। কারো মধ্যে কোনো নিকৃষ্ট স্বভাব না থাকা তার পূর্ণতা বুঝায় না। সুতরাং কোনো সিফাত নাকোচ করার মাধ্যমে প্রশংসা হয় না।[2]

আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা হয়ে থাকে এমন নাকচ করার মাধ্যমে, যাতে উত্তম গুণাবলীও সাব্যস্ত হয়। যেমন তন্দ্রা ও নিদ্রা নফী করার মাধ্যমে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা তা নাকচ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ চিরন্তনতা ও অবিনশ্বরতা সাব্যস্ত হয়। আর তার থেকে মৃত্যু নফী বা নাকোচ করার মাধ্যমে তার পরিপূর্ণ হায়াত বা জীবন সাব্যস্ত হয়। ক্লান্তি-ক্লেশ দূর করার মাধ্যমে তার জন্য পূর্ণ ক্ষমতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা থেকে শরীক, সঙ্গিনী, সন্তান ও সাহায্যকারী নাকোচ করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ রুবুবীয়াত, উলুহীয়াত ও পরাক্রমশালীতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার থেকে পানাহার নফী করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ অমূখাপেক্ষীতা ও ধনাঢ্যতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিনা অনুমতিতে কেউ তার নিকট সুপারিশ করতে পারবে না, -এ কথা বলার মাধ্যমে তার পরিপূর্ণ তাওহীদ এবং সৃষ্টি থেকে তার পরিপূর্ণ অমূখাপেক্ষীতা বুঝানো হয়েছে। তার থেকে যুলুম নফী করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার সাব্যস্ত করা হয়েছে, ভুলে যাওয়া, গাফেল হওয়া ইত্যাদি নাকোচ করার মাধ্যমে তার জন্য পরিপূর্ণ ইলম ও সকল জিনিসকে জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে রাখার বিষয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তার সদৃশ নাকোচ করার মাধ্যমে তার সত্তা ও সিফাতের কামালিয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ জন্যই শুধু এমন নাকোচের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা নিজের প্রশংসা করেননি, যা পূর্ণতার গুণাবলীকে আবশ্যক করে না। কেননা অস্তিত্বহীন সিফাতের মাধ্যমে কোনো জিনিসকে বিশেষিত করা যায়না।

সুতরাং যার অস্তিত্ব পরিপূর্ণ তাকে কিভাবে অস্তিত্বহীন বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করা যেতে পারে? অস্তিত্বহীন বিশেষণ কেবল অস্তিত্বহীন জিনিসের জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্বই নেই। কোনো কামেল বা পূর্ণ জিনিসকে এমন বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত করা যাবে না, যাতে করে তা এবং অস্তিত্বহীন জিনিস একই রকম হয়ে যায়।

আসল অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে, তবে তাকে পরিপূর্ণ রূপে আয়ত্ত ও বেষ্টন করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

لَّا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ ‘‘দৃষ্টিশক্তি তাকে আয়ত্ত করতে পারে না’’ (সূরা আনআম:১০৩), এটি আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ বড়ত্বের প্রমাণ। তিনি সবকিছু থেকে বড় ও মহান। তার পরিপূর্ণ বড়ত্বের কারণেই কেউ তাকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত করতে পারে না। কেননা الإدراك অর্থ হলো কোনো জিনিসকে সকল দিক থেকে পূর্ণরূপে আয়ত্ত ও পরিবেষ্টন করা। এটি শুধু দেখা নয়; বরং তার চেয়েও বেশী অর্থ বহন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلَمَّا تَرَاءَى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَىٰ إِنَّا لَمُدْرَكُونَ قَالَ كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ

‘‘দু’দল যখন পরস্পরকে দেখতে পেলো তখন মূসার সাথীরা চিৎকার করে উঠলো, আমরা তো পাকড়াও হয়ে গেলাম। মূসা বললেন, কখনো না, আমার সাথে আছেন আমার রব, তিনি নিশ্চয়ই আমাকে পথ দেখাবেন’’। (সূরা শুআরা: ৬২)।

এখানে মুসা আলাইহিস সালাম দেখা নাকোচ করেননি। পরিপূর্ণরূপে তাদেরকে আক্রমণ, ঘেরাও এবং পাকড়াওকে নফী বা নাকোচ করেছেন। দেখা ও বেষ্টন করা উভয়টিই একসঙ্গে অর্জিত হয়। পরিবেষ্টন করা ব্যতীতও দেখা সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলাকে দেখা যাবে, কিন্তু পরিবেষ্টন করা অসম্ভব। যেমন আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু ইলমের মাধ্যমে তাকে পরিবেষ্টন করা সম্ভব নয়। ছাহাবী এবং ইমামগণ আয়াত থেকে এ অর্থই বুঝেছেন। যেমন তাদের কথাগুলো এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টি এ সূর্যকে মানুষ দেখে, কিন্তু এটি যে অবস্থায় রয়েছে হুবহু সে অবস্থায় দর্শকের পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার ছাহাবীদের থেকে আল্লাহর দিদার সম্পর্কিত হাদীছগুলো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ছহীহ, মুসনাদ এবং সুনান গ্রন্থকারগণ এ হাদীছগুলো বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

أَنَّ ناسا قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَلْ تُضَارُّونَ فِي الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ قَالُوا لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَهَلْ تُضَارُّونَ فِي الشَّمْسِ لَيْسَ دُونَهَا سَحَابٌ قَالُوا لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَإِنَّكُمْ تَرَوْنَهُ كَذَلِكَ

‘‘একদল লোক বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের প্রভুকে দেখতে পাবো? নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পূর্ণিমার রাত্রিতে চন্দ্রকে দেখতে কি তোমাদের কোন অসুবিধা হয়? তারা বলল, না কোন অসুবিধা হয় না। তিনি আবার বললেন, আকাশে মেঘ না থাকলে সূর্য দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয় কি? তারা বলল, না কোন অসুবিধা হয় না। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কিয়ামতের দিন এরকম পরিষ্কারভাবেই আল্লাহকে দেখতে পাবে’’।[3] হাদীছটি ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ মর্মে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছটিও ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। জারীর বিন আব্দুল্লাহ আলবাজালী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছটিও অনুরূপ। তিনি বলেন,

«كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ اأربع عشرة فَقَالَ أَمَا إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عيانا كَمَا تَرَوْنَ هَذَا لَا تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ»

‘‘একদা পুর্ণিমার রাত্রিতে আমরা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে বসা ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা অচিরেই স্বচক্ষে তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। যেমন কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই এ চন্দ্রটিকে দেখতে পাচ্ছ’’।[4] ইতিপূর্বে সুহাইবের হাদীছটিও অতিক্রান্ত হয়েছে। ইমাম মুসলিম এবং অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«جَنَّتَانِ مِنْ فِضَّةٍ آنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا، وَجَنَّتَانِ مِنْ ذَهَبٍ آنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا، وَمَا بَيْنَ الْقَوْمِ وَبَيْنَ أَنْ يَنْظُرُوا إِلَى رَبِّهِمْ إِلاَّ رِدَاءُ الْكِبْرِ عَلَى وَجْهِهِ فِي جَنَّةِ عَدْنٍ»

‘‘দু’টি জান্নাত হবে রৌপ্যের তৈরী। তার সমস্ত থালা-বাসন এবং অন্যান্য বস্তুও হবে রৌপ্যের। আর দু’টি জান্নাত হবে স্বর্ণের। তার সমস্ত থালা-বাসন এবং অন্যান্য বস্তু হবে স্বর্ণের। জান্নাতে আদনের মধ্যে তাদের এবং তাদের প্রভুর মাঝে গৌরব ও অহঙ্কারের একটি চাদর ব্যতীত অন্য কোন ব্যবধান থাকবে না, যা আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র চেহারার উপর থাকবে।[5] ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

আদী বিন হাতিমের হাদীছে এসেছে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«وَلَيَلْقَيَنَّ اللَّهَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ يَلْقَاهُ، وَلَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُ حِجَابٌ وَلَا تَرْجُمَانٌ يُتَرْجِمُ لَهُ، فَلَيَقُولَنَّ: أَلَمْ أَبْعَثْ إِلَيْكَ رَسُولًا فَيُبَلِّغَكَ؟ فَيَقُولُ: بَلَى يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: أَلَمْ أُعْطِكَ مَالًا وَأُفْضِلْ عَلَيْكَ؟ فَيَقُولُ، بَلَى يَا رَبِّ»

‘‘কিয়ামতের দিন তোমাদের কেউ যখন আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন আল্লাহর মাঝে এবং তার মাঝে কোনো পর্দা থাকবেনা এবং বান্দার কথা আল্লাহকে অনুবাদ করে বুঝানোর জন্য কোনো দোভাষীরও প্রয়োজন পড়বেনা। আল্লাহ তা‘আলা তখন বলবেন, আমি কি তোমার কাছে রসূল পাঠাইনি, যিনি তোমার কাছে আমার দ্বীন পৌঁছিয়ে দিয়েছেন? বান্দা তখন বলবে, হ্যাঁ, হে আমার রব! আল্লাহ তা‘আলা আবারো বলবেন, আমি কি তোমাকে সম্পদ দান করিনি এবং তোমার উপর অনুগ্রহ করিনি? বান্দা বলবে, হ্যাঁ, হে আমার রব! ইমাম বুখারী (৩৫৯৫) তার ছহীতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

প্রায় ত্রিশজন ছাহাবী আল্লাহর দিদার সম্পর্কিত হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। যে ব্যক্তি ভালোভাবে হাদীছগুলো বুঝতে সক্ষম হবে, সে জোর দিয়েই বলবে যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহা বলেছেন।[6] আমি যদি কিতাবটি সংক্ষিপ্ত আকারে লিখার ইচ্ছা না করতাম, তাহলে এ ব্যাপারে সকল হাদীছই উল্লেখ করতাম।

যে ব্যক্তি হাদীছগুলো সম্পর্কে অবগত হতে চায়, সে যেন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছগুলো পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়। কেননা সেখানে আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে আরো সাব্যস্ত হয় যে, তিনি যখন ইচ্ছা, যার সাথে ইচ্ছা কথা বলবেন। আর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে বিচার-ফায়ছালা করার জন্য আগমন করবেন। একই সঙ্গে হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা রয়েছেন সকল সৃষ্টির উপরে। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন এমন আওয়াজের মাধ্যমে সৃষ্টিকে ডাক দিবেন, যা নিকটের ও দূরের সকলেই শ্রবণ করবে, তিনি সৃষ্টির সামনে প্রকাশিত হবেন এবং তিনি হাসবেন। এমনি আরো যেসব সিফাত রয়েছে, যা জাহমিয়াদের জন্য বজ্রপাতের মত।

[1]. দুনিয়াতে মানুষের চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে দুনিয়ায় তৈরী করা হয়নি। পাহাড়ের গঠন মানুষ গঠনের চেয়ে অধিক মজবুত ও শক্ত হওয়ার পরও যেহেতু পাহাড় আল্লাহর নূরের সামনে টিকে থাকতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলা যখন পাহাড়ের উপর স্বীয় জ্যোতি প্রকাশ করলেন, তখন পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, তাই বুঝা গেল যে মানুষ চর্ম চক্ষু দিয়ে দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখতে সক্ষম নয়। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[2]. অর্থাৎ আপনি যদি কারো প্রশংসা করতে গিয়ে তার থেকে নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো নাকোচ করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, আপনি চোর নন, ডাকাত নন, মিথ্যাবাদী নন, কৃপণ নন....তাহলে কখনোই সে আপনার উপর সন্তুষ্ট হবে না; বরং আপনার উপর ক্রোধান্বিত হবে ও প্রতিবাদ করবে। প্রশংসা কেবল সুকুমার বৃত্তিগুলো বর্ণনা করার মাধ্যমেই হতে পারে। তবে যে নাকোচের সাথে ইছবাত-সাব্যস্তও অন্তর্ভুক্ত থাকে, তার কথা ভিন্ন।

[3]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৪৮৫১, ছহীহ মুসলিম ১৮২।

[4]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৮০৬, ছহীহ মুসলিম ৬৩৩।

[5]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৪৮৭৮, ছহীহ মুসলিম ১৮০।

[6]. মুমিনগণ আল্লাহকে দেখবে, এ মর্মে আলেমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে।