তিনি চিরঞ্জীব, কখনো মারা যাবেন না, চির জাগ্রত, কখনো নিদ্রা যান না।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (حَيٌّ لَا يَمُوتُ قَيُّومٌ لَا يَنَامُ) তিনি চিরঞ্জীব, কখনো মারা যাবেন না, চির জাগ্রত, কখনো নিদ্রা যান না।

............................

ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ

‘‘তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারে না’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৫)

আল্লাহ তা‘আলা থেকে তন্দ্রা ও নিদ্রাকে নাকচ করা তার পরিপূর্ণ জীবন ও চিরজাগ্রত থাকার কথা প্রমাণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

الم (1) اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ (2) نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ

‘‘আলিম, লাম, মিম। আল্লাহ এক চিরঞ্জীব ও শাশ্বত সত্তা, যিনি সৃষ্টিজগতের ব্যবস্থাপনাকে ধারণ করে আছেন, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি তোমার উপর এ কিতাব নাযিল করেছেন, যা সত্যের বাণী বহন করে এনেছে’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১-৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَعَنَتِ الْوُجُوهُ لِلْحَيِّ الْقَيُّومِ وَقَدْ خَابَ مَنْ حَمَلَ ظُلْمًا

‘‘লোকদের মাথা চিরঞ্জীব ও চির প্রতিষ্ঠিত সত্তার সামনে ঝুঁকে পড়বে, সে সময় যে যুলুমের গুনাহ্র ভার বহন করবে সে ব্যর্থ হবে’’। (সূরা ত্বহা: ১১১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ

‘‘তুমি সেই চিরজীবন্ত সত্তার উপর ভরসা করো, যিনি কখনোই মৃত্যু বরণ করবেন না’’। (সূরা আল ফুরকান: ৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুমিনের ৬৫ নং আয়াতে আরো বলেন,

هُوَ الْحَيُّ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তোমাদের দ্বীনকে তার জন্য নিবেদিত করে তাকেই ডাকো। গোটা সৃষ্টি জগতের রব আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা’’।


রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ اللَّهَ لَا يَنَامُ وَلَا يَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَنَامَ»

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা ঘুমান না, ঘুমানো তার জন্য শোভনীয় নয়’’।[1]

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ আল্লাহ তা‘আলার সদৃশ হওয়া নাকচ করার পর এমন বিষয়াদির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা তার মাঝে এবং তার সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য করে। সে সঙ্গে তিনি এমনসব সিফাতের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন, যা দ্বারা কেবল তিনিই বিশেষিত হয়েছেন। তার সৃষ্টির কেউ তা দ্বারা বিশেষিত নয়। এসব সিফাতের মধ্যে রয়েছে যে, তিনি চিরজীবন্ত, তার কোনো মৃত্যু নেই। চিরস্থায়ী জীবন কেবল তার জন্যই নির্দিষ্ট। কোনো মাখলুকের-ই চিরস্থায়ী হায়াত নেই। সকল সৃষ্টিই মৃত্যু বরণ করবে। এ অর্থেই শাইখ বলেছেন, قَيُّومٌ لَا يَنَامُ ‘‘তিনি চিরজীবন্ত, কখনো ঘুমান না’’।

নিদ্রা ও তন্দ্রা দ্বারা বিশেষিত না হওয়া আল্লাহ তা‘আলার খাস বিশেষণ। সৃষ্টির কেউ এর দ্বারা বিশেষিত নয়। তারা সকলেই ঘুমায়। এখানে আরো ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর সদৃশ হওয়া নাকচ করা দ্বারা তার সুউচ্চ সিফাতের নাকচ করা উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সুমহান ও পূর্ণতার গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত। তার সত্তা যেহেতু সকল দিক থেকেই পরিপূর্ণ, তাই তার সিফাতও পরিপূর্ণ। চিরন্তন জীবনের মাধ্যমে যিনি চিরঞ্জীব, তিনি কখনো ক্ষণস্থায়ী জীবন দ্বারা জীবিতদের সদৃশ হতে পারেন না। এ জন্যই দুনিয়ার জীবন শুধু সাময়িক ভোগ-বিলাস ও খেল-তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নের মত। আর আখেরাতের জীবন জাগ্রতকালীন জীবনের মত।

এ কথা বলা যাবে না যে, আখেরাতে মাখলুকের হায়াত আল্লাহ তা‘আলার হায়াতের মতই অবিনশ্বর-চিরন্তন হবে। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, চিরন্তন সত্তার অন্যতম বিশেষণ হলো চিরস্থায়ী ও পূর্ণতম হায়াত। আর তিনিই সৃষ্টিকে আখেরাতে চিরস্থায়ী হায়াত দান করবেন। সুতরাং তিনি সৃষ্টিকে প্রদত্ত চিরস্থায়ী হায়াত যতদিন স্থায়ী রাখবেন, ততদিন তা স্থায়ী থাকবে। এটি নয় যে, সৃষ্টির চিরস্থায়ী হায়াত সৃষ্টির নিজস্ব কোনো আবশ্যকীয় সিফাত। কিন্তু স্রষ্টার হায়াত সৃষ্টির হায়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত। তার অন্যান্য সিফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা। স্রষ্টার সিফাত তার জন্যই শোভনীয় এবং সৃষ্টির সিফাত সৃষ্টির জন্যই শোভনীয়।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, এ দু’টি নাম অর্থাৎ الحي এবং القيوم কুরআনের তিনটি সূরাতে একসাথে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। এ দু’টি আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম সর্ববৃহৎ অতি সুন্দর নাম। এমনকি আরো বলা হয়েছে যে, এ দু’টি নাম ইসমে আ’যম। কেননা এ নাম দু’টিই আল্লাহ তা‘আলার জন্য উত্তমভাবে অন্যান্য পূর্ণ গুণাবলী সাব্যস্ত করাকে আবশ্যক করে।[2]

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার القيوم নামটি তার এমন অনাদিত্ব-সূচনাহীনতা এবং অবিনশ্বরতা-চিরন্তনতার প্রমাণ বহন করে, যা القديم শব্দটি বহন করে না। একই সঙ্গে কাইয়্যুম নামটি প্রমাণ করে যে, তিনি নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল। তিনি ওয়াজিবুল উজুদ হওয়ার অর্থ এটিই।

القيوم শব্দটি القيام এর চেয়ে অধিক পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে। কেননা واو অক্ষরটি الف অক্ষরের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। মুফাস্সিরে কুরআন ও ভাষাবিদদের ঐকমত্যে আলিফের বদলে واو দ্বারা গঠিত القيوم শব্দটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজে নিজেই প্রতিষ্ঠিত। সর্বসাধারণের নিকট এটি একটি জ্ঞাত বিষয়। তবে القيام শব্দটি থেকে কি এটি বুঝা যায় যে, তিনি অন্যকে প্রতিষ্ঠাকারী এবং অন্যকে পরিচালনাকারী?

এতে দু’টি মত রয়েছে। সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হলো, القيام শব্দটিও উপরোক্ত অর্থ প্রদান করে। এটি আল্লাহ তা‘আলার সর্বদা বিদ্যমান থাকা এবং পরিপূর্ণ অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত থাকার কথা প্রমাণ করে। তিনি কখনো বিলীন হবেন না, অদৃশ্যও হবেন না। সে বিলীন হয়ে যায়, সে আসলে নিঃশেষই হয়ে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা অদৃশ্য হন না, তার কোনো ঘাটতিও হয় না, তিনি কখনো নিঃশেষ হবেন না এবং অস্তিত্বহীনও হবেন না। বরং তিনি চির বিদ্যমান। তিনি সর্বদাই পূর্ণতার বিশেষণে বিশেষিত আছেন, সবসময় এ রকম থাকবেন। তার الحي (চিরঞ্জীব) নামটি সমস্ত সিফাতে কামালিয়ার (পূর্ণতার) জন্য আবশ্যক। এটি তার চিরস্থায়িত্ব, অবিনশ্বরতার প্রমাণ বহন করার সাথে সাথে তার ত্রুটিমুক্ততা এবং কখনো অস্তিত্বহীন না হওয়ার দাবি করেন।

এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলার বাণী: اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ‘‘আল্লাহ একক সত্তা, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব এবং সৃষ্টিজগতের সবকিছুর ব্যবস্থাপক ও ধারক’’ (সূরা আল বাকারা:২৫৫) এ আয়াতটি কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদাবান বলে গণ্য হয়েছে।

যেমন ছহীহ বুখারীতে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং الحي এবং القيوم নামের উপরই আল্লাহ তা‘আলার আসমায়ে হুসনা ভিত্তিশীল। এ দু’টি নাম সমস্ত নামের অর্থের কেন্দ্রস্থল। কেননা সমস্ত সিফাতে কামালিয়ার জন্য হায়াত আবশ্যক। হায়াতের মধ্যে দুর্বলতা থাকার কারণেই বাকী সিফাতগুলোর কোনোটি অনুপস্থিত থাকতে পারে।

আল্লাহ তা‘আলার হায়াত যেহেতু পরিপূর্ণ, তাই তার বাকী সিফাতগুলো তার জন্য পরিপূর্ণ অবস্থায় সাব্যস্ত। কোনো সিফাতকে নাকচ করা আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ সিফাতের পরিপন্থী। আল্লাহ তা‘আলার القيوم নামটি প্রমাণ করে যে, তিনি পরিপূর্ণ ধনী এবং পূর্ণ ক্ষমতাবান। তিনি নিজে নিজেই প্রতিষ্ঠিত। কোনোভাবেই তিনি অন্যের প্রতি মুখাপেÿী নন। একই সঙ্গে তিনি অন্যকে প্রতিষ্ঠাকারী। তিনি যাকে প্রতিষ্ঠিত রাখেন সে ব্যতীত অন্য কেউ প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। সুতরাং আল্লাহর এ দু’টি নামের সাথে পূর্ণতার সিফাতগুলোকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।

[1]. ছহীহ মুসলিম হা/১৭৯, ইবনে মাজাহ হা/১৯৫।

[2]. কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্য হায়াত বা জীবন সাব্যস্ত করা ব্যতীত ইলম, কুদরত এবং অন্যান্য সিফাত সাব্যস্ত করা সম্ভব নয়। হায়াত ব্যতীত বাকী সিফাতগুলো কায়েম হওয়াও সম্ভব নয়।