রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় - বেলায়াতের পথে যিকরের সাথে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর পথে চলতে সচেষ্ট ও ধর্ম-সচেতন অনেক মানুষ অনেক সময় এসব ইবাদত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যান। অনেক সচেতন মুসলিম ব্যভিচার, মিথ্যা, মদপান, সালাত বা সিয়াম পরিত্যাগ ইত্যাদি পাপে কখনোই লিপ্ত হন না। কখনো এরূপ কিছু করলে সকাতরে তাওবা-ইসতিগফার করতে থাকেন। কিন্তু জেনে অথবা না জেনে তাঁরা শির্ক, কুফর, বিদ‘আত, হিংসা, অহঙ্কার, লোভ, আত্মতুষ্টি, গীবত ইত্যাদি পাপের মধ্যে লিপ্ত হচ্ছেন।

এর কারণ, কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই শয়তান কখনো নিরাশ হয় না। প্রত্যেক মানুষকেই কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত করতে ও পাপে লিপ্ত করতে সে সদা সচেষ্ট। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তার নিজস্ব পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী রয়েছে। সবাইকেই সে পরিপূর্ণ ধর্মহীন অবিশ্বাসী করতে চায়। যাদের ক্ষেত্রে সে তা করতে সক্ষম না হয় তাদেরকে সে ‘ধর্মের আবরণে’ পাপের মধ্যে লিপ্ত করে। অথবা বিভিন্ন প্রকার ‘অন্তরের পাপে’ লিপ্ত করে, যেগুলি নেককার মানুষের নেক-আমল নষ্ট করে দেয়, অথচ সেগুলিকে অনুধাবন করা অনেক সময় ধার্মিক মানুষের জন্যও কষ্টকর হয়ে যায়। আমরা এখানে এ জাতীয় কিছু পাপের কথা আলোচনা করতে চাই।


(১) শিরক

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিছু কর্ম আছে যা আমাদের অর্জিত পুণ্য, সাওয়াব ও সকল নেক কর্ম ধ্বংস করে দেয়। এ ধরনের কর্ম থেকে বিরত হতে না পারলে আমাদের যিকর-আযকার সবই ব্যর্থ হবে। এ সকল পাপের অন্যতম শিরক। শিরক মানব জীবনের ভয়ঙ্করতম পাপ। শিরক অর্থ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা। আল্লাহর কর্মে বা তাঁর গুণাবলীতে বা ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার বলে মনে করাই শিরক।

শিরকের ব্যাখ্যা ও বিবরণ প্রদান এখানে সম্ভব নয়। প্রত্যেক মুমিনের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করা। এখানে সামান্য কিছু আলোচনা করা অতীব প্রয়োজনীয় মনে করছি।

কুরআন কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে: “তাদের (মানুষদের) অধিকাংশ আল্লাহে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।”[1] এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বিশ্বাসী ও ধার্মিক মানুষই শির্ক করে। আর যেনতেন কোনো সৃষ্টিকে সে আল্লাহ সাথে শরীক করে না, বরং আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক আছে মনে করেই কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সাথে সে শরীক করে। শিরকের মূল নবী, ওলী, ফিরিশতা, জিন বা প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে ‘ঐশবরিক ক্ষমতা’ বা ‘আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক’ কল্পনা করা। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তার কাছে বা তার মুর্তি, সমাধি বা স্মৃতি বিজড়িত স্থানে তার সাহায্য-সহানুভুতি কামনা করে প্রার্থনা, উৎসর্গ ইত্যাদি কর্ম সম্পাদন করা।


আল্লাহর কর্ম ও গুণাবলীতে শিরক করা

এই বিশ্বের স্রষ্টা ও পরিচালক একমাত্র আল্লাহ। অন্য কোনো সৃষ্টি, প্রাণী, মানুষ, নবী, ওলী, ফিরিশতা বা কোনো কিছু সৃষ্টি, পরিচালনা, অদৃশ্য জ্ঞান, অদৃশ্য সাহায্য, রিযিক দান, জীবন দান, সুস্থতা বা রোগব্যধি দান, বৃষ্টি দান, বরকত দান, অনাবৃষ্টি প্রদান, অমঙ্গল প্রদান ইত্যাদি কোনো প্রকার কল্যাণ বা অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা রাখেন বা আল্লাহ কাউকে অনুরূপ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে অনেক বিষয়ের দায়িত্ব প্রদান করেছেন, কিন্তু ক্ষমতা প্রদান করেন নি। ফিরিশতা ছাড়া কোনো নবী, ওলী বা কাউকে কোনোরূপ দায়িত্ব বা ক্ষমতা কিছুই প্রদান করেন নি। আল্লাহ কাউকে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করা শিরক।

এই জাতীয় একটি অতি প্রচলিত শিরক অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা। কোনো বস্ত, প্রাণী, কর্ম, বার, তিথি, মাস ইত্যাদিকে অশুভ, অমঙ্গল বা অযাত্রা বলে মনে করা স্পষ্ট শিরক। আমাদের দেশে অনেক মুসলিমও ‘কী করলে কী হয়’ জাতীয় অনেক বিষয় লিখেন বা বিশ্বাস করেন। এগুলি সবই শিরক। জন্মদিনে নখ বা চুল কাটা, ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা, রাতে নখ কাটা, পিছন থেকে ডাকা, কাক ডাকা ইত্যাদি অগণিত বিষয়কে অমঙ্গল বা অশুভ মনে করা হয়, যা নিতান্তই কুসংস্কার, মিথ্যা ও শিরকী বিশ্বাস। পাপে অমঙ্গল ও পুণ্যে কল্যাণ; এছাড়া অমঙ্গল বা অশুভ বলে কিছুই নেই।


আল্লাহর ইবাদতে শিরক করা

ইবাদত অর্থ উপাসনা, পূজা বা আরাধনা। সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর পাওনা। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই”ইসলামের ভিত্তি ও মুমিনের অন্যতম যিকর। দুঃখজনক বিষয়, প্রতিদিন কয়েক হাজার বার “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বদু নেই” যিকর করেও অনেক যাকির আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ইবাদত, পূজা, উপাসনা বা আরাধনা করে থাকেন। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট প্রার্থনা বিষয়ক আলোচনায় কিছু কথা উল্লেখ করেছি। সাজদা করা, দু‘আ করা, মানত করা, কুরবানী বা উৎসর্গ (sacrifice) করা এগুলি সবই ইবাদত। আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য জীবিত বা মৃত, বিমূর্ত, মূর্ত, প্রস্তরায়িত বা সমাধিস্থ, নবী, ওলী, ফিরিশতা বা যে কোনো নামে বা প্রকারে কারো জন্য এগুলি করা হলে তা শিরক হবে। এছাড়া মূর্তিতে ফুলদান, মূর্তির সামনে নীবরে বিনয়ে দাঁড়ানো ইত্যাদি কর্মও এই পর্যায়ের।


শিরক মানব জীবনের কঠিনতম পাপ। অন্যান্য পাপের সাথে এর মৌলিক পার্থক্য তিনটি: (১). শিরক ও কুফর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও কঠিনতম পাপ, এর উপরে কোনো পাপ নেই। (২). অন্যান্য সকল পাপ আল্লাহ বিভিন্ন নেক কর্মের কারণে বা দয়া করে তাওবাসহ বা তাওবা ছাড়া ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু শিরক-কুফরী পরিত্যাগ করে তাওবা না করলে আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করেন না। (৩). শিরক ও কুফরীর কারণে অন্য সকল নেক কর্ম বিনষ্ট হয়।

কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ কুরআন করীমে ইরশাদ করেছেনঃ “তোমার কাছে এবং তোমার পূর্বের নবী-রাসূলগণের কাছে এই মর্মে ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক কর তবে তোমার সকল কর্ম বিনষ্ট হবে এবং তুমি অবশ্যই ধ্বংসগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”[2]

[1] সূরা ইউসুফঃ ১০৬।

[2] সূরা যুমারঃ ৬৫।