রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় - বেলায়াত ও যিকর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
ঙ. কুরআন-হাদীসের আলোকে যিকরের পরিচয় - (১) আল্লাহর আনুগত্যমূলক সকল কর্ম ও বর্জনই যিকর

মহান আল্লাহ বলেন: (فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ) “তোমরা আমার যিকর (স্মরণ) কর, আমি তোমাদের যিকর (স্মরণ) করব”।[1]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবী-তাবেয়ীগণ বলেছেনঃ এখানে যিকর বলতে সকল প্রকার ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজকে বুঝান হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য করাই বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর যিকর করা। আর বান্দাকে প্রতিদানে পুরস্কার, করুণা, শান্তি ও বরকত প্রদানই আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাকে যিকর করা।[2]

ইমাম তাবারী এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে যে সকল আদেশ প্রদান করেছি তা পালন করে এবং যা নিষেধ করেছি তা বর্জন করে তোমরা আমার আনুগত্যের মাধ্যমে আমার যিকর কর, তাহলে আমি তোমাদেরকে আমার রহমত, দয়া ও ক্ষমা প্রদানের মাধ্যমে তোমাদের যিকর করব।”[3]


তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু রাবীয়াহ সাহাবী ইবনু আব্বাসকে (রাঃ) বলেন: “আল্লাহর যিকর তাঁর তাসবীহ, তাহলীল, প্রশংসা জ্ঞাপন, কুরআন তিলাওয়াত, তিনি যা নিষেধ করেছেন তাঁর কথা স্মরণ করে তা থেকে বিরত থাকা - এ সবই আল্লাহর যিকর।” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “সালাত, সিয়াম ইত্যাদি সবই আল্লাহর যিকর।”[4]

প্রখ্যাত মহিলা সাহাবী উম্মে দারদা (রাঃ) বলেনঃ

فإن صليت فهو من ذكر الله وإن صمت فهو من ذكر الله وكلّ خير تعمله فهو من ذكر الله وكل شرّ تجتنبه فهو من ذكر الله وأفضل ذلك تسبيحُ الله


“তুমি যদি সলাত আদায় কর তাও আল্লাহর যিকর, তুমি যদি সিয়াম পালন কর তবে তাও আল্লাহর যিকর। তুমি যা কিছু ভালো কাজ

কর সবই আল্লাহর যিকর। যত প্রকার মন্দ কাজ তুমি পরিত্যাগ করবে সবই আল্লাহর যিকরের অন্তর্ভুক্ত। তবে সবচেয়ে উত্তম যিকর আল্লাহর তাসবীহ (‘সুবহানাল্লাহ’ বলা)।”[5]


কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

رِجَالٌ لَّا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَن ذِكْرِ


“(আল্লার ঘরে আল্লাহর যিকরকারী মানুষগণকে) কোনো ব্যবসা বা কেনাবেচা আল্লাহর যিকর থেকে অমনোযোগী করতে পারে না।”[6]

এই আয়াতে ‘আল্লাহর যিকরের’ ব্যাখ্যায় তাবেয়ী কাতাদা বলেনঃ “এ সকল যাকির বান্দাগণ বেচাকেনা ও ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকতেন। কিন্তু যখনই আল্লাহর কোনো পাওনা বা তাঁর প্রদত্ত কোনো দায়িত্ব এসে যেত তাঁরা তৎক্ষণাৎ তা আদায় করতেন। কোনো ব্যবসা বা বেচাকেনা তাঁদেরকে আল্লাহর যিকর থেকে বিরত রাখত না।”[7]


তাবেয়ীগণ মুখের যিকরের গুরুত্ব দিতেন। তাসবীহ, তাহলীল, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিকে তাঁরা মুখের যিকর হিসাবে পালন করতেন। তবে এগুলি নফল যিকর। যদি কেউ কর্মে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে না চলে তাহলে তার এসকল যিকরের

কোনো মূল্য নেই বলে তাঁরা বলতেন। তাবেয়ী সাঈদ বিন জুবাঈর (৯৫ হি) বলেনঃ

والذكر طاعة الله فمن أطاع الله فقد ذكره ومن لم يطعه فليس بذاكر له وإن كثر منه التسبيح وتلاوة القرآن


“আল্লাহর আনুগত্যই আল্লাহর যিকর। যে তাঁর আনুগত্য করল সে তাঁর যিকর করল। আর যে আল্লাহর আনুগত্য করল না বা তাঁর বিধিনিষেধ পালন করল না, সে যত বেশিই তাসবীহ পাঠ করুক আর কুরআন তিলাওয়াত করুক সে ‘যাকির’ হিসাবে গণ্য হবে না।”[8]


এই অর্থে মুরাসাল সনদে একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ী খালিদ ইবনু আবী ঈমরান (১২৫ হি) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)

বলেছেনঃ

مَنْ أَطَاعَ اللَّهَ فَقَدْ ذَكَرَ اللَّهَ وَإِنْ قَلَّتْ صَلاتُهُ وَصِيَامُهُ وَتِلاوَةُ الْقُرْآنِ وَمَنْ عَصَى اللَّهَ فَقَدْ نَسِيَ اللَّهَ وَإِنْ كَثُرَتْ صَلاتُهُ وَصِيَامُهُ وَتِلاوَةُ الْقُرْآنِ


“যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল সেই আল্লাহর যিকর করল, যদিও তার সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলওয়াত কম হয়। আর যে আল্লাহর অবাধ্যতা করল সেই আল্লাহকে ভুলে গেল, যদিও তার সালাত, সিয়াম ও কুরআন তিলাওয়াত বেশি হয়।”[9]

তাবেয়ী খালিদ পর্যন্ত সনদ সহীহ। কিন্তু তিনি কার নিকট থেকে হাদীসটি শুনলেন তা বলেননি। বিশেষত তিনি শেষ যুগের তাবেয়ী। তিনি সাধারণত তাবেয়ীগণের থেকে হাদীস শুনে বর্ণনা করেছেন। এতে মনে হয় অন্তত দুইজন রাবী তার পরে বাদ পড়েছেন, একজন সাহাবী ও একজন তাবেয়ী। যেহেতু তাবেয়ীর পরিচয় জানা যাচ্ছে না, সেহেতু হাদীসটি বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল বলে গণ্য হয়। তবে ঠিক এই শব্দে ও অর্থে অন্য সনদে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খাদেম ওয়াকিদ থেকে একটি হাদীস ইমাম তাবারানী বর্ণনা করেছেন। এই সনদটিতে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই, কিন্তু সনদটি দুর্বল। তবে দুটি পৃথক সনদে একই অর্থের হাদীস বর্ণিত হওয়াতে হাদীসটির নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত এ কারণে ইমাম সুয়ূতী হাদীসটিকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে যয়ীফ বা দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।[10]

আল্লামা আব্দুর রাঊফ মুনাবী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ ‘এ থেকে বুঝা যায় যে, যিকরের হাকীকত আল্লাহর আনুগত্য করা, তাঁর আদেশ পালন করা ও নিষেধ বর্জন করা।’ এজন্য কোনো কোনো ওলী বলেছেনঃ ‘যিকরের মূল আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া। যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপের মধ্যে লিপ্ত থেকেও মুখে আল্লাহর যিকর করে সে মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে মসকরায় লিপ্ত এবং আল্লাহর আয়াত ও বিধানকে তামাশার বস্তু হিসাবে গ্রহণ করেছে।’[11]

তাবেয়ী হাসান বসরী বলেনঃ ‘আল্লাহর যিকর দুই প্রকার। প্রথম প্রকার যিকর- তোমার নিজের ও তোমার প্রভুর মাঝে মুখে জপের মাধ্যমে তাঁর যিকর করবে। এই যিকর খুবই ভালো এবং এর সাওয়াবও সীমাহীন। দ্বিতীয় প্রকার যিকর আরো উত্তম; আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তার কাছে তাঁর যিকর করা। অর্থাৎ, আল্লাহর কথা স্মরণ করে তাঁর নিষেধ করা কর্ম থেকে বিরত থাকা।’[12]

তাবেয়ী বিলাল ইবনু সা’দ বলেন : ‘যিকর দুই প্রকার। প্রথম প্রকার জিহ্বার যিকর - এই যিকর ভালো। দ্বিতীয় প্রকার যিকর - হালাল-হারাম ও বিধিনিষেধের যিকর। সকল কর্মের সময় আল্লাহর আদেশ নিষেধ মনে রাখা। এই যিকর সর্বোত্তম।’[13]

তাবেয়ী মাসরূক বলেনঃ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির কলব আল্লাহর স্মরণে রত আছে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যে রয়েছে, যদিওসে বাজারের মধ্যে থাকে।’[14] অন্য তাবেয়ী আবু উবাইদাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেনঃ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির অন্তর আল্লাহর স্মরণে রত থাকে, ততক্ষণ সে মূলত সালাতের মধ্যেই রয়েছে। যদি এর সাথে তার জিহ্বা ও দুই ঠোঁট নড়াচড়া করে (অর্থাৎ, মনের স্মরণের সাথে সাথে যদি মুখেও উচ্চারণ করে) তাহলে তা হবে খুবই ভালো, বেশি কল্যাণময়।’[15]

[1] সূরা বাকারাঃ ১৫২।

[2] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২/৩৭।

[3] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২/৩৭।

[4] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২০/১৫৬।

[5] তাবারী, তাফসীরে তাবারী ২০/১৫৭।

[6] সূরা নূরঃ ৩৭।

[7] বুখারী, আস-সহীহ ২/৭২৬, ২৭৮।

[8] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৩২৬।

[9] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫২, ইবনুল মুবারাক, কিতাবুয যুহদ ১/১৭, আব্দুর রাউফ মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৬/৭০, আলবানী যয়ীফুল জামিয়িস সগীর, পৃঃ ৭৮৫।

[10] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ২২/১৫৪, মাযমাউয যাওয়াইদ ২/২৫৮, মানাবী, ফাইযুল কাদীর ৬/৭০।

[11] মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৬/৭০।

[12] গাযালী, এহইয়াউ উলুমুদ্দীন ১/৩৫১।

[13] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫২।

[14] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫৩।

[15] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ১/৪৫৩।