রাহে বেলায়াত প্রথম অধ্যায় - বেলায়াত ও যিকর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

অনেক সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত ও সাহাবীগণের সুন্নাতের উপর নির্ভর না করে শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থ বা ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা, অভিরুচি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কুরআনের আয়াত বা হাদীসের অর্থ বা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে আমরা বিভিন্ন প্রকারের বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হই। এধরনের অজ্ঞতা বা মনগড়া ব্যাখ্যার কারণে আমরা যিকরের ক্ষেত্রে তিন প্রকার বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হই :

প্রথমত, অনেক সময় অনেক আবেগী ধার্মিক মানুষ তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি শাব্দিক যিকরের প্রতি অবজ্ঞা করে বলেন

যে, ‘আল্লাহর হুকুম মানাই তো বড় যিকর ... ’ ইত্যাদি।


দ্বিতীয়ত, অনেক সময় অনেক ধার্মিক মানুষ যিকর বলতে শুধুমাত্র তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি শাব্দিক যিকরই বুঝেন। তিনি মনে করেন এ সকল যিকর না করে যিনি আল্লাহর বিধানাবলী সাধ্যমত পালন করেন তিনি কখনই যাকির নন। উপরন্তু অনেকে আল্লাহর ফরয বিধানাবলী - সালাত, সিয়াম, যাকাত, ইত্যাদি যথাযথ পালন না করে শুধুমাত্র কিছু সুন্নাত-সম্মত অথবা বিদ’আত পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ‘যিকর’ নামক কর্ম করে নিজেকে যাকির বলে দাবি করেন বা মনে করেন।


তৃতীয়ত, অনেক ধার্মিক ও যাকির মানুষ ‘আল্লাহর যিকর’ বা ‘আল্লাহর নামের যিকর’ বলতে সুন্নাত সম্মত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের আচরিত যিকর না বুঝে সমাজে প্রচিলত বিভিন্ন বানোয়াট পদ্ধতির বানোয়াট যিকর বুঝেন। তাঁরা আল্লাহর যিকরের ফযীলতের আয়াত ও হাদীসগুলি গ্রহণ করেন। কিন্তু এগুলির পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের সুন্নাত নিয়ে মাথা ঘামান না।


এসকল বিভ্রান্তির মূল কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের শিক্ষা, কর্ম ও ব্যবহার না জেনে, দুই একটি আয়াত বা হাদীস পড়ে মনোমতো ব্যাখ্যা করা। ইসলামের অন্যতম রুকন ‘সালাত’। ‘সালাত’ অর্থ প্রার্থনা। আমরা বাংলা ভাষায় ফারসি ‘নামায’ শব্দ ব্যবহার করি। কিন্তু ইংরেজিতে সালাতকে প্রার্থনা বা prayer-ই বলা হয়। এখন কল্পনা করুন, একজন নতুন ইংরেজি ভাষাভাষী মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে prayer বা প্রার্থনা কায়েম করতে চায়। এজন্য সে দাঁড়িয়ে বা বসে আবেগের সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে। তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সে বলে যে, আল্লাহর নির্দেশমতো সে prayer বা প্রার্থনা প্রতিষ্ঠা করছে বা সালাত কায়েম করছে। আপনি তাকে এভাবে প্রার্থনা বা সালাত কায়েম করতে নিষেধ করলে বিরক্ত হয়ে আপনাকে ইসলাম বিরোধী ও সালাত বা প্রার্থনা বিরোধী বলে আখ্যায়িত করল।

জাপানি ও অন্যান্য বিদেশী সাক্ষাৎ হলে তাদের ‘সালাম’ হিসাবে Bow (বাউ) করে বা মাথা নিচু করে সম্ভাষণ জানায়। এখন একজন জাপানি ইসলাম গ্রহণ করে ‘ইসলামী সালাম’ শিখেছেন। তিনি অনুরূপ Bow (বাউ) করে বা মাথা ঝুঁকিয়ে আপনাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললেন। আপনি তাকে Bow (বাউ) করতে নিষেধ করলে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি আমাকে সালাম করতে নিষেধ করছেন? সালাম সুন্নাত, সালামে এত ফযীলত, ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি কী করবেন? আপনি কি তাকে বুঝাতে পারবেন যে, আপনি সালাম করতে নিষেধ করছেন না, আপনি শুধুমাত্র Bow (বাউ) করে সালাম করতে নিষেধ করছেন। আপনি কি তাকে বুঝাতে পারবেন যে, আপনি তাকে সুন্নাত শব্দে ও সুন্নাত পদ্ধতিতে সালাম করতে বলছেন?


আমাদের দেশের যাকিরগণ অবিকল একই সমস্যায় নিপতিত। আল্লাহর যিকর, যিকর, আল্লাহর নামের যিকর ইত্যাদি শব্দ বিকৃত ও সুন্নাত বিরোধী অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। আপনি যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের পদ্ধতিতে যিকর করতে অনুরোধ করেন তাহলে তারা আপনার কথাকে ভুল অর্থ করে আপনি যিকর করতে নিষেধ করছেন বলে আপনার বিরোধিতা করবেন।


এজন্য আমরা শুরুতে দুটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। প্রথমত, কুরআন ও হাদীসের আলোকে যিকর শব্দের অর্থ ও ব্যবহার জানতে চাই। দ্বিতীয়ত, কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফে আল্লাহর যিকরের যে অগণিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে এবং যিকরের যে অতুলনীয় পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে সেই নির্দেশনা পালনের জন্য পুরস্কার অর্জনের জন্য আমরা কি মনগড়াভাবে প্রয়োজন, ইচ্ছা বা রুচি অভিরুচিমতো যিকর বানিয়ে নিতে পারব? নাকি আমাদের এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের অনুসরণ করতে হবে? যিকর মানেই তো স্মরণ। আমরা কি তাহলে দেশ, যুগ, ভাষা, রুচি, প্রয়োজন ও সুবিধা অনুসারে ইচ্ছামতো শব্দে ও ইচ্ছামতো পদ্ধতিতে যিকর বা স্মরণ করতে পারব? না শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ যখন, যেভাবে, যে শব্দে ও যে পদ্ধতিতে যিকর করেছেন অবিকল সেভাবেই আমাদের যিকর করতে হবে?