রমযান মাসের ৩০ আসর তৃতীয় আসর শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি
দু’টি বিষয়ের কোনো একটি ঘটলে রমযানের আগমন বুঝা যাবে

প্রথম বিষয়: নতুন চাঁদ দেখা গেলে।

যেমন আল্লাহর বাণী:

﴿ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

হাদীসে রয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا»

‘যখন তোমরা রমযানের চাঁদ দেখবে, তখন সিয়াম পালন করবে।’[1]

তবে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য চাঁদ দেখা শর্ত নয়; বরং একজন নির্ভরযোগ্য পুরুষ সাক্ষ্য দিলে সকলের ওপর সিয়াম পালন জরুরী হবে।
চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত হলো:

সাক্ষ্যদাতা ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক, বুদ্ধিমান, মুসলিম, দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন এবং তার আমানতদারীতার কারণে বিশ্বস্ত হতে হবে তথা তার সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে।

- অতএব, নাবালেগের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ সে বিশ্বস্ত নয়।

- আর পাগলের সাক্ষ্যও নাবালেগের মত গ্রহণযোগ্য নয়।

- কাফিরের সাক্ষ্য দ্বারাও মাহে রমযান সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হবে না।

- কারণ আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: جَاءَ أَعْرَابِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: إِنِّي رَأَيْتُ الْهِلَالَ، قَالَ الْحَسَنُ فِي حَدِيثِهِ يَعْنِي رَمَضَانَ، فَقَالَ: «أَتَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ» ، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: «أَتَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ؟» ، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: «يَا بِلَالُ، أَذِّنْ فِي النَّاسِ فَلْيَصُومُوا غَدًا»

‘ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এসে বলল, নিশ্চয়ই আমি (রমযানের) চাঁদ দেখেছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই? সে উত্তরে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল? সে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে বেলাল! তুমি ঘোষণা দিয়ে দাও, লোকেরা যেন আগামীকাল সিয়াম পালন করে।’[2]

- আর যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রসিদ্ধ কিংবা অধিক তাড়াহুড়া করে এমন কিংবা দৃষ্টিশক্তি এমন দুর্বল ও ক্ষীণ যে তার দ্বারা চাঁদ দেখা অসম্ভব, এ ধরনের ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের দ্বারা মাহে রমযানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাবে না। কারণ তাদের সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে অথবা মিথ্যার দিকটাই অধিক প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক।


বিশ্বস্ত একজনের সাক্ষ্য দ্বারাই রমযান মাস প্রবেশ করা সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হবে। যেমন আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

تَرَاءَى النَّاسُ الْهِلَالَ، فَأَخْبَرْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنِّي رَأَيْتُهُ «فَصَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَمَرَ النَّاسَ بِصِيَامِهِ»

“লোকেরা চাঁদ দেখল, পরক্ষণে আমি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চাঁদ দেখার সংবাদ দিলে তিনি সিয়াম পালন করলেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন।’[3]

আর যে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে চাঁদ দেখে, তার উচিৎ প্রশাসনকে অবহিত করা।
এমনিভাবে যে শাওয়াল ও জিলহজের চাঁদ দেখবে, তারও উচিৎ প্রশাসনকে অবহিত করা। কারণ এর সাথে সাওম, ফিতর ও হজ এর ফরয আদায় হওয়া নির্ভরশীল। আর “যা না হলে ফরয আদায় করা সম্ভব হয় না তাও ফরয হিসেবে বিবেচিত”।
কোনো ব্যক্তি যদি একা এত দূরে চাঁদ দেখে যে, দূরত্বের কারণে তার পক্ষে প্রশাসনের কাছে সংবাদ পৌঁছানো সম্ভ্রম না হয়। তাহলে সে নিজে সিয়াম পালন করবে এবং প্রশাসনের কাছে সংবাদ পৌঁছানোর সাধ্যমত চেষ্টা করবে।
যখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেডিও বা এ জাতীয় কিছুর মাধ্যমে চাঁদ দেখার ঘোষণা প্রদান করা হয়, রামযান মাস আগমনের জন্য বা রমযান মাস শেষ হওয়ার ব্যাপারে সেটা অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসা শরীয়তের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে যার উপর আমল করা ফরয।

এ জন্যই যখন রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে রমযান মাস প্রবেশ করার বিষয়টি সাব্যস্ত হলো তখন তিনি বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে মাস সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন; যাতে তারা সাওম পালন করে। আর তিনি সে ঘোষণাকে তাদের জন্য সাওম পালনের বাধ্যকারী বিধান হিসেবে গণ্য করলেন।

* তাই শরয়ী পদ্ধতি অনুযায়ী চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সেটাই ধর্তব্য হবে, চন্দ্রের বিবিধ উদয়াস্থলের বিষয়টি ধর্তব্য হবে না, কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম রাখার বিধানটি চাঁদ দেখার সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন, চাঁদের বিবিধ উদয়াস্থলের সাথে সম্পৃক্ত করেন নি। তিনি বলেন:

«إِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا »

‘যখন তোমরা (রামযানের) চাঁদ দেখ, তখন সিয়াম পালন কর এবং যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখ, তখন সিয়াম ভঙ্গ কর।’[4]

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« وَإِنْ شَهِدَ شَاهِدَانِ مُسْلِمَانِ، فَصُومُوا وَأَفْطِرُوا»

‘যদি দু‘জন মুসলিম (চাঁদ দেখে) সাক্ষ্য দেয়, তখন সিয়াম পালন কর এবং ভঙ্গ কর।’[5]

দ্বিতীয় বিষয়: রমযান তথা নতুন মাস সাব্যস্ত হওয়ার জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে, আগের মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করা।

কেননা চান্দ্র মাস কখনো ত্রিশদিনের বেশি বা ২৯ দিনের কম হতে পারে না। আরবী মাস কখনো কখনো ধারাবাহিকভাবে দু’মাস, তিনমাস অথবা চারমাস পর্যন্ত ত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। আবার কখনো দু’মাস, তিনমাস অথবা চারমাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ঊনত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণত এক মাস, দু মাস পূর্ণ ত্রিশ দিন হলেও তৃতীয় মাস কম অর্থাৎ ঊনত্রিশ দিনের হয়ে থাকে।

সুতরাং কোনো মাসের ত্রিশদিন পূর্ণ হলে, শরীয়তের হুকুম অনুযায়ী পরবর্তী মাসটি এসে গেছে বলে গণ্য হবে। যদিও চাঁদ দেখা না যায়।

* কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি বলেন:

«صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُمِّيَ عَلَيْكُمُ الشَّهْرُ فَعُدُّوا ثَلَاثِينَ»

‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করা এবং চাঁদ দেখে সিয়াম ভঙ্গ কর। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তখন ওই মাস ত্রিশ দিন হিসাবে গণনা কর।’[6]

* ইমাম বুখারীর শব্দ হচ্ছে,

« فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاَثِينَ»

‘চাঁদ যদি অজ্ঞাত থাকে, তাহলে শাবান মাসটি ত্রিশদিন পূর্ণ কর।’[7]

* সহীহ ইবনে খুযাইমা গ্রন্থে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَفَّظُ مِنْ شَعْبَانَ مَا لَا يَتَحَفَّظُ مِنْ غَيْرِهِ، ثُمَّ يَصُومُ لِرُؤْيَةِ رَمَضَانَ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْهِ عَدَّ ثَلَاثِينَ يَوْمًا ثُمَّ صَامَ»

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসকে যত বেশি হিসাব করতেন, অন্য মাসকে তত বেশি হিসাব করতেন না। এরপর তিনি চাঁদ দেখে রমযানের সিয়াম পালন করতেন। আর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন হিসাব করে সিয়াম পালন করতেন।’[8]

এসব হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নতুন চাঁদ দেখার পূর্বে সিয়াম পালন শুরু করা যাবে না, অতঃপর যদি চাঁদ দেখা না যায় তবে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন পূর্ণ করতে হবে। অবশ্য শাবানের সে ত্রিশতম দিনটিতে কোনোভাবেই সাওম রাখা যাবে না, চাই রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকুক বা মেঘাচ্ছন্ন। কারণ:

* আম্মার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

«مَنْ صَامَ اليَوْمَ الَّذِي يَشُكُّ فِيهِ النَّاسُ فَقَدْ عَصَى أَبَا القَاسِمِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ»

‘যে ব্যক্তি সন্দেহের দিন সিয়াম পালন করল, সে আবূল কাসেম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করল।’[9]

হে আল্লাহ! আমাদেরকে হেদায়াত অনুসরণের তাওফীক দান করুন এবং ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের উপকরণ-উপায়াদি থেকে দূরে রাখুন। আমাদের এ রমযান মাসকে আমাদের জন্য কল্যাণ ও বরকতময় করুন। আর এ মাসে আমাদের আপনার আনুগত্য করার তাওফীক দিন এবং আপনার অবাধ্যতার পথ থেকে দূরে রাখুন। হে রাহমানুর রাহীম! অনুগ্রহ করে আমাদের, আমাদের মাতা-পিতা ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন।হে আল্লাহ! সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদের ওপর, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কেরাম ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁদের সুন্দরভাবে অনুসরণকারীদের ওপর।

[1] বুখারী: ১৯০৫; মুসলিম: ১০৮১।

[2] তিরমিযী: ৬১৯; আবূ দাউদ: ২৩৪০; ইবন মাজাহ: ১৬৫২। তবে শায়খ আলবানী হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। দেখুন: ইরওয়াউল গালীল: ৯০৭।

[3] দারেমী: ১৭৩৩; হাকিম: ১৫৪১। মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ।

[4] বুখারী: ১৯০০; মুসলিম: ১০৮০।

[5] আহমদ ৪/৩২১, নং ১৮৮৯৫; নাসাঈ ১/৩০০-৩০১।

[6] মুসলিম: ১০৮১।

[7] বুখারী: ১৯০৯।

[8] ইবন খুযাইমা: ১/২০৩; আবূ দাউদ: ২৩২৫; দারা কুতনী ২/১৫৬।

[9] আবূদাউদ: ২৩৩৪; তিরমিযী: ৬৮৬; নাসায়ী: ২১৮৮; আর বুখারী মু‘আল্লাকসূত্রে বর্ণনা করেছেন ৪/১১৯ ফাতহুল বারীসহ।