শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ১০ - আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য চেহারা সাব্যস্ত করণ ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী] ১ টি
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য চেহারা সাব্যস্ত করণ

১০- إثبات الوجه لله سبحانه

১০- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য চেহারা সাব্যস্ত করণ:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ﴾

‘‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র তোমার সেই রবের চেহারা অবশিষ্ট থাকবে, যিনি মহিয়ান ও দয়াবান। (সূরা আর্ রাহমানঃ ২৬-২৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃكُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّاوَجْهَهُ ‘‘তাঁর চেহারা ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংস হবে’’। (সূরা কাসাসঃ ৮৮)


ব্যাখ্যাঃ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ একমাত্র তোমার পালনকর্তার চেহারাই অবশিষ্ট থাকবে। এই আয়াতের পূর্বে রয়েছে, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ‘‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংস হবে’’। এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, যমীনের সকল প্রাণী মৃত্যু বরণ করবে এবং সকল বস্ত্তই ধ্বংস হবে। মহান প্রভুর চেহারা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কখনো মৃত্যু হবেনা। তিনি সেই চিরজীবন্ত সত্তা, যার কখেনো মৃত্যু হবেনা।

ذُي الْجَلَالِ والإكرام যিনি বড়ত্ব ও সম্মানের অধিকারীঃ ذُو الْجَلَالِ অর্থ হচ্ছে বড়ত্ব ও মর্যাদার অধিকারী এবং الإكرامঅনুগ্রহ ও সম্মানের অধিকারী। অর্থাৎ তিনি নবী-রাসূল এবং তাঁর সৎ বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করার মাধ্যমে তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেনঃ الإكرام অর্থ হলো আল্লাহ তাআলা এমন প্রত্যেক জিনিষের উর্ধ্বে, যা তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় নয়।

كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ সব জিনিষ ধ্বংস হবেঃ আসমান ও যমীনে যা আছে, তার প্রত্যেকটি ধ্বংস হবে এবং মৃত্যু বরণ করবে। إِلَّا وَجْهَهُ কেবল তাঁর চেহারা অবশিষ্ট থাকবে। وجهه শব্দটি মুস্তাছনা হিসাবে মানসুব হয়েছে।

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, সবকিছু ধ্বংস হওয়ার পর কেবল তিনি অবশিষ্ট থাকবেন। সমস্ত মাখলুক মৃত্যু বরণ করার পরও তাঁর মৃত্যু হবেনা।

উপরোক্ত দু’টি আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার চেহারা থাকার কথা প্রমাণিত হলো। আল্লাহর চেহারা আল্লাহর সত্তাগত সিফাত। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর চেহারা রয়েছে। যেরকম চেহারা আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় তাঁর চেহারা ঠিক সে রকমই। তা কোন মাখলূকের চেহারার মত নয়।[1] আল্লাহ তাআলা বলেনঃ﴾ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ﴿ অর্থাৎ তাঁর সদৃশ কোনো কিছু নেই। (সূরা শুরাঃ ১১)

আমরা আল্লাহর সিফাতকে বাতিলকারী সম্প্রদায়ের লোকদের মত কথা বলিনা। তারা বলে আল্লাহর চেহারা দ্বারা আসল অর্থ উদ্দেশ্যও নয়; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সত্তা কিংবা ছাওয়াব, অথবা দিক অথবা অন্যান্য উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যাগুলো একাধিক কারণে বাতিল।

(ক) হাদীছে আল্লাহর চেহারাকে আল্লাহর সত্তার উপর আতফ (যুক্ত) করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে আল্লাহর সত্তাকে উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর তাঁর চেহারা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর যাত (সত্তা) এবং তাঁর চেহারা ভিন্ন ভিন্ন জিনিষ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দু’আয় বলেছেনঃأَعُوذُ بِاللَّهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ‘‘আমি মহান আল্ল­াহর সত্তা, তাঁর সম্মানিত চেহারা এবং তাঁর চিরস্থায়ী ক্ষমতার উসীলায় বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় কামনা করছি’’।[2] আতফের অন্যতম দাবী হচ্ছে, তা পরস্পর ভিন্ন জিনিষ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।

(খ) উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহর চেহারাকে তাঁর সত্তার দিকে সম্বোধিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَجْهُ رَبِّكَ ‘‘তোমার পালনকর্তার চেহারা’’। আর চেহারাকে বিশেষিত করা হয়েছে ذُوالْجَلَالِ والإكرام মহিয়ান ও দয়াবান, -এই দু’টি বিশেষণের মাধ্যমে। وجه (চেহারা) দ্বারা যদি যাত বা সত্তা উদ্দেশ্য হত, তাহলে উক্ত আয়াতের মধ্যে وجه শব্দটি সিলা হিসাবে ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ তা رب এর সিফাত হিসাবে ব্যবহৃত হত; وجه -এর সিফাত হতোনা। তখন এভাবে বলা হতো, وَجْهُ رَبِّكَ ذِي الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ। তা না বলে যখন ذُوالْجَلَالِ والإكرام বলা হয়েছে, তাতে বুঝা গেল যে, উহা চেহারার সিফাত হয়েছে, সত্তার সিফাত হয়নি। ঐদিকে আবার وجه (চেহারা) আল্লাহর সত্তার সিফাত হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

(গ) কোনো জাতির ভাষাতে এটি পাওয়া যায়না যে, কোন জিনিষের চেহারা বলতে যাত (সত্তা) কিংবা ছাওয়াব বুঝায়। আরবী ভাষায় وجه বলতে প্রত্যেক বস্ত্তর অগ্রভাগ ও সামনের অংশ বুঝায়। কেননা কোন বস্ত্তর দিকে অগ্রসর হলে সর্বপ্রথম অগ্রভাগ সামনে পড়ে। যেসব বস্ত্তর দিকে চেহারাকে ইযাফত বা সম্বন্ধ করা হবে সেসব বস্ত্ত অনুযায়ী চেহারার অর্থ হবে। وجه শব্দটিকে যদি কোনা সময়ের দিকে সম্বন্ধ করা হয়, তাহলে ইহার অর্থ হবে প্রথম সময়। যেমন বলা হয়, وجه النهار তথা দিবসের প্রথমাংশ। কোন প্রাণীর দিকে ইযাফত করলে উহার অর্থ হবে সেই প্রাণীর অঙ্গ বিশেষ। যেমন বলা হয়, وجه الفرس তথা ঘোড়ার চেহারা। আর যদি কোন পাহাড় বা দেয়ালের দিকে ইযাফত করা হয়, তাহলে উহার অর্থ হবে পাহাড় বা দেয়ালের চূড়া। যেমন বলা হয়, وجه الجبل তথা পাহাড়ের উপরের অংশ, وجه الجدار দেয়ালের সামনের অংশ ইত্যাদি। আর যখন চেহারাকে আল্লাহর দিকে ইযাফত করা হবে, তখন ইহার অর্থ হবে তাঁর অন্যতম সিফাত,[3] যা কোন মাখলুকের সিফাতের অনুরূপ নয়।[4]

[1] - আল্লাহর চেহারা আল্লাহর মতই। যেমন মাখলুকের চেহারা মাখলুকের মতই। আল্লাহর জন্য চেহারা সাব্যস্ত করলে এই প্রশ্ন করা বোকামি যে, তাহলে কি আল্লাহর চেহারা মানুষের মত? আল্লাহর চেহারা কেমন? এই প্রশ্ন করা যাবেনা। যেই আয়াতে আল্লাহর চেহারা সাব্যস্ত করা হয়েছে, তা যেমন সাহাবীগণ শুনেছেন, তেমনি আমরাও শুনছি। তারা যেমন প্রশ্ন ও আপত্তি ছাড়াই মেনে নিয়েছে, আমাদেরও বিনা প্রশ্নে তাতে বিশ্বাস করা ও তা মেনে নেয়া আবশ্যক। সৃষ্টি জগতের সকল প্রাণীর চেহারা যেমন এক রকম নয়; বরং প্রত্যেক প্রাণীর জন্যই যেহেতু শোভনীয় চেহারা রয়েছে, তাই স্রষ্টার জন্যও সে রকম চেহারা রয়েছে, যা তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়। তাই দলীলের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য যেসব সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে, আমরা তা সাব্যস্ত করি। তা আমরা অস্বীকার করিনা এবং সৃষ্টির সিফাতের সাথে তাঁর সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার অযৌক্তিক ধারণার উপর নির্ভর করে তার অপব্যাখ্যাও করিনা।

[2] - সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং- ৪৬৬।

[3] - যারা বলেন এখানে চেহারা দ্বারা আল্লাহর সত্তাকে বুঝানো হয়েছে তাদের কথা ঠিক নয়। কারণ এখানে বলা হয়েছে وَجْهُ رَبِّكَ তোমার প্রভুর চেহারা। চেহারাকে সত্তার দিকে সম্বোধিত করা হয়েছে। যা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, চেহারা সত্তা থেকে ভিন্ন। মোট কথা ‘رب’ দ্বারা আল্লাহর সত্তা এবং ‘وَجْه’ দ্বারা তাঁর একটি গুণকে বুঝানো হয়েছে। হাদীছেও আল্লাহর জন্য চেহারা সাব্যস্ত করা হয়েছে। আবু মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ

«قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِخَمْسِ كَلِمَاتٍ فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَنَامُ وَلَا يَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَنَامَ يَخْفِضُ الْقِسْطَ وَيَرْفَعُهُ يُرْفَعُ إِلَيْهِ عَمَلُ اللَّيْلِ قَبْلَ عَمَلِ النَّهَارِ وَعَمَلُ النَّهَارِ قَبْلَ عَمَلِ اللَّيْلِ حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ

‘‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে পাঁচটি কথা বললেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা নিদ্রা যান না। নিদ্রামগ্ন হওয়া তাঁর জন্যে সমিচীন নয়। তিনি ন্যায় দন্ডের পাল্লা নামান এবং উঠান। দিবসের আমলের পূর্বেই তাঁর নিকট রাতের আমলসমূহ উঠানো হয় এবং রাতের আমলের পূর্বেই দিনের আমল উঠানো হয়। তাঁর পর্দা হচ্ছে নূর। তিনি যদি তা উন্মুক্ত করেন তাঁর চোখের দৃষ্টি যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত সকল মাখলুক তাঁর চেহারার আলোতে জ্বলে যাবে।

[4] - আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য যেরকম চেহারা বা মুখমণ্ডল শোভনীয়, তাঁর চেহারা সেরকমই। তা কোন মাখলুকের চেহারার মত নয়। আল্লাহর চেহারাকে তাঁর ছাওয়াবের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা অবৈধ। কেননা চেহারাকে ছাওয়াবের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হলে তাকে তার মূল অর্থ থেকে অন্য অর্থে পরিবর্তন করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে, যা অবৈধ। সালাফে সালেহীন থেকে এই ধরণের ব্যাখা পাওয়া যায়না। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে আল্লাহর যেহেতু চেহারা আছে, তাই তাঁর নাক ও কান...... আছে কি?

এর জবাবে আমরা বলবো যে, জানিনা। কেননা কুরআন ও হাদীছে নাক বা কানের কথা উল্লেখ নেই। তাই আমরা আল্লাহ তাআলার জন্য সাব্যস্ত করতে পারিনা এবং অস্বীকারও করতে পারিনা। কেননা নিজের পক্ষ হতে অনুমান করে আল্লাহর পবিত্র সত্তার জন্য কোন সিফাত সাব্যস্ত করা যাবেনা এবং আল্লাহর যেই সিফাত নেই বলে কুরআন ও হাদীছে উল্লেখ নেই, তা আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পবিত্র সত্তা হতে নফীও করিনা।