শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া আহলে সুন্নাতের লোকেরা আল্লাহর সিফাতের কোনো ধরণ বর্ণনা করেন না ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী] ১ টি
আহলে সুন্নাতের লোকেরা আল্লাহর সিফাতের কোনো ধরণ বর্ণনা করেন না

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَلَا يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَاءِ اللَّهِ وَآيَاتِهِ وَلَا يُكَيِّفُونَ وَلَا يُمَثِّلُونَ صِفَاتِهِ بِصِفَاتِ خَلْقِهِ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা আল্লাহর নাম ও আয়াতসমূহের বিকৃতি করেন না, তারা আল্লাহর সিফাত সমূহের ধরণ ও কায়া বর্ণনা করেন না এবং তাঁর সিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতের সাথে তুলনাও করেন না।


ব্যাখ্যা: وَلَا يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَاءِ اللَّهِ وَآيَاتِهِ তারা আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও আয়াতসমূহের বিকৃতি করেন নাঃ إلحاد (ইলহাদ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বাঁকা হওয়া, একদিকে ঝুকে পড়া, কোন জিনিষ থেকে সরে আসা, ইত্যাদি। এখান থেকেই কবরকে লাহাদ বলা হয়। কবরকে লাহাদ বলার কারণ হলো, উহাকে খনন করার সময় গর্ত খননের সাধারণ রীতি ও পদ্ধতির ব্যতিক্রম করে কিবলার দিকে বাঁকা করে দেয়া হয়।

আর আল্লাহর অতি সুন্দর নাম, তাঁর সুউচ্চ গুণাবলী এবং আয়াতসমূহের মধ্যে ইলহাদ হচ্ছে উহার প্রকৃত ও সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে বাতিল অর্থের দিকে নিয়ে যাওয়া। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মধ্যে ইলহাদ কয়েক প্রকার।

(১) আল্লাহর নামে দেবতার নাম রাখা: আল্লাহর অন্যতম নাম الإله থেকে মুশরেকরা তাদের এক দেবতার নাম রেখেছে اللات (লাত), আল্লাহর নাম العزيز থেকে তারা তাদের আরেক মূর্তির নাম রেখেছে العزى (উয্যা) এবং আল্লাহর নাম المنان থেকে তারা তাদের আরেক বাতিল মাবুদের নাম রেখেছে مناة (মানাত)।

(২) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার এমন নাম রাখা, যা তাঁর মর্যাদা ও বড়ত্বের শানে শোভনীয় নয়: যেমন খৃষ্টানরা আল্লাহকে أب (FATHER বা পিতা) বলে। দার্শনিকরা আল্লাহকে موجب (আসল সংঘটক) কিংবা علة فاعلة (কার্যকর কারণ) বলে থাকে।

(৩) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে এমন ত্রুটিযুক্ত বিশেষণে বিশেষিত করা, যা থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র ও মুক্ত রেখেছেন: যেমন অভিশপ্ত ইহুদীরা বলে থাকে ﴿إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ﴾ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ গরীব আর আমরা ধনী’’। তারা আরো বলেঃ

﴿يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا ۘ بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ﴾

‘‘আল্লাহর হাত বাঁধা। আসলে বাঁধা হয়েছে ওদেরই হাত এবং তারা যে কথা বলছে সে জন্য তাদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে৷ আল্লাহর দুই হাত সদা প্রসারিত। যেভাবে চান তিনি খরচ করেন’’। (সূরা মায়িদা: ৬৪)

তারা আরো বলে থাকে আল্লাহ তাআলা ছয়দিনে আসমান-যমীন এবং উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করার পর শনিবারে বিশ্রাম নিয়েছেন। মূলতঃ আল্লাহ তাদের কথার অনেক উর্ধ্বে।

(৪) আল্লাহ তাআলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ সিফাতগুলোর অর্থ ও হাকীকত অস্বীকার করা: যেমন জাহমীয়ারা বলে আল্লাহর নামগুলো শুধু শব্দের মধ্যেই সীমিত। এগুলো কোন গুণ বা অর্থকে নিজের মধ্যে শামিল করেনা। তারা বলে আল্লাহর অন্যতম নাম হচ্ছে, السميع (সর্বশো্রতা), কিন্তু এই নামটি প্রমাণ করেনা যে, তিনি শুনেন কিংবা এটি প্রমাণ করেনা যে, শ্রবণ করা তাঁর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট। আল্লাহর অন্যতম নাম হচ্ছে البصير (সর্বদ্রষ্টা), কিন্তু এই নামটি প্রমাণ করেনা যে, তিনি দেখেন কিংবা দেখা তাঁর গুণ এবং আল্লাহ তাআলার আরেকটি নাম হচ্ছে الحي (চিরজীবন্ত), কিন্তু ইহা প্রমাণ করেনা যে, তাঁর হায়াত বা জীবন আছে। আল্লাহর অন্যান্য নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রেও তারা একই রকম কথা বলে থাকে।[1]

(৫) আল্লাহর সিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতের সাথে তুলনা করা: যেমন মুশাবেবহা (আল্লাহর সিফাতকে সৃষ্টির সিফাতের সাথে তুলনাকারী) সম্প্রদায়ের লোকেরা করে থাকে। তারা বলে থাকে, আল্লাহর হাত আমার দুই হাতের মতই। অন্যান্য সিফাতের বেলাতেও তারা একই রকম কথা বলে। আল্লাহ তাদের এই ধরণের কথার অনেক উর্ধ্বে।

যারা আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও আয়াতের মধ্যে ইলহাদ করে, তাদেরকে তিনি কঠোর আযাবের ধমক দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা আরাফের ১৮০ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚسَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

‘‘আল্লাহ তাআলার অনেকগুলো সুন্দরতম নাম রয়েছে। সুতরাং তাঁকে সেই নামেই ডাকো এবং তাঁর নামসমূহের মধ্যে যারা বিকৃতি করে, তোমরা তাদেরকে বর্জন করো৷ তারা যা করে আসছে, তার ফল অবশ্যই তারা পাবে’’। আল্লাহ তাআলা সূরা ফুস্সিলাতের ৪০ নং আয়াতে আরো বলেনঃ

﴿إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَن يُلْقَىٰ فِي النَّارِ خَيْرٌ أَم مَّن يَأْتِي آمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾

‘‘যারা আমার আয়াতসমূহের বিকৃতি (উল্টা অর্থ) করে, তারা আমার অগোচরে নয়৷ যাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে সে উত্তম? না যে কিয়ামতের দিন নিরাপদ অবস্থায় হাজির হবে সে উত্তম? তোমরা যা চাও করতে থাকো, আল্লাহ তোমাদের সব কাজ দেখছেন’’।وَلَا يُكَيِّفُونَ وَلَا يُمَثِّلُونَ صِفَاتِهِ بِصِفَاتِ خَلْقِهِ তারা আল্লাহর সিফাত সমূহের ধরণ ও কায়া বর্ণনা করেনা এবং তারা তাঁর সিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতের সাথে তুলনাও করেনা: تكييف এবং تمثيل এর ব্যাখ্যা একটু পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।

[1] - আশআরী ও মাতুরীদিগণ হুবহু উক্ত আকীদাহ পোষণ করেন। আশআরীগণ মাত্র সাতটি সিফতকে এবং মাতুরীদিগণ মাত্র আটটি গুণকে স্বীকার করেন। বাকীগুলোর তাবীল করে থাকেন। আশআরীগণ যেসব সিফাতে বিশ্বাস করে, তা হলো, الحياة (জীবন) العلم (জ্ঞান), الإرادة (ইচ্ছা পোষণ করা),القدرة (ক্ষমতা), السمع (শ্রবণ করা), البصر (দেখা) এবং الكلام (কথা বলা)। মাতুরীদিগণ অষ্টম যেই সিফাতটি সাব্যস্ত করে, তা হলো, التكوين (আকৃতি দান করা বা গঠন করা)।