কবরকে তাওয়াফ করা, কবর স্পর্শ করা বা চুমু দেওয়া :

যিয়ারতে কবর তাওয়াফ, স্পর্শ ও চুম্বন করবেন না। ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘অনুসরণীয় ইমাম ও পূর্বসুরী আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কবরে সালাম পাঠকালে তাঁর কবরের পাথর চুম্বন বা স্পর্শ করা মুস্তাহাব নয়। যেন সৃষ্টজীবের ঘর (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কবর) আর স্রষ্টার ঘর (কা‘বা) সমপর্যায়ের না হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«اللهم لا تجعل قبري وثنا يعبد».

‘হে আল্লাহ, আমার কবরকে এমন মূর্তির মতো বানিয়ো না, যার পূজা করা হয়।’ মানব জাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কবরের ক্ষেত্রে যখন এই বিধান, তাহলে অন্যদের কবর চুম্বন ও স্পর্শ না করাটা যে নিষিদ্ধ তা বলাই বাহুল্য।’[1]

তিনি আরো বলেন, ‘শরীয়তে শুধু কা‘বা শরীফের তাওয়াফ করা, রুকনে ইয়ামানীদ্বয় স্পর্শ করা এবং হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করার বিধান রয়েছে। পক্ষান্তরে মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা এবং অন্য কোন মসজিদে এমন কিছু নেই, যাকে তাওয়াফ, স্পর্শ বা চুম্বন করা যাবে। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর হুজরা শরীফ, বাইতুল মুকাদ্দাসের কোন পাথর বা অন্য বস্তুর তাওয়াফ করা বৈধ নয়। যেমন : আরাফা ও তদ্রুপ স্থানের গম্বুজ। বরং ভূপৃষ্ঠে এমন কোন স্থান নেই কা‘বা শরীফের মতো যার তাওয়াফ করা হবে। আর যে এই আকীদা পোষণ করে যে, কা‘বা শরীফ ছাড়া অন্য বস্তুর তাওয়াফ করা বৈধ, সে ঐ ব্যক্তির চেয়ে মন্দ যে কা‘বা শরীফ ছাড়াও অন্য বস্তুর দিকে নামাজ পড়াকে বৈধ মনে করে।’ তিনি এও বলেন, ‘যে হুজরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কবর বিদ্যমান ইবাদতের ক্ষেত্রে সেই হুজরার কোন ধর্মীয় বিশেষত্ব নেই।’[2]

ইবন তাইমিয়া রহ. আরো বলেন, ‘আর স্পর্শ করার ক্ষেত্রে বিধান হল, যেকোন কবর স্পর্শ করা বা চুমো দেওয়া এবং তাতে গাল ঘষা সকল মুসলমানের ঐকমত্যে নিষিদ্ধ। যদিও তা নবীগণের কবর হয়। এই উম্মতের ইমামগণ এবং পূর্বসুরী আলেমদের কেউ এসব করেননি। বরং এটা করা শিরক।’[3] তাঁর মতে, ‘তাঁর কবর এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে মানুষ সেখানে পৌঁছতে না পারে। সেখানে যিয়ারতকারীদের কবরে পৌঁছার জন্য কোন রাস্তা রাখা হয়নি। আর করবটি এমন বিশাল জায়গায় অবস্থিত নয় যে সকল যিয়ারতকারীর স্থান সংকুলান হতে পারে। আর জায়গাটিতে এমন কোন জানালাও নেই যা দিয়ে কবর দেখা যায়। বরং মানুষকে কবরে পৌঁছা ও প্রত্যক্ষভাবে তা দেখা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। উপরোক্ত প্রত্যেকটি কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কবরগৃহকে ঈদ ও মূর্তি হিসেবে গ্রহণ করা থেকে রক্ষা করা।’

তেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কবরের দেয়াল স্পর্শ ও চুম্বন করাও বৈধ নয়। ইমাম আহমদ রহ. বলেন, ‘আমি এটাকে (কবর স্পর্শ বা চুম্বন) বৈধ বলে জানি না।’ আছরাম রহ. বলেন, আমি মদীনার আলিমদের দেখেছি, তাঁরা কবরের এক পাশে দাঁড়িয়ে সালাম পেশ করেন। আবূ আবদুল্লাহ বলেন, ইবন উমর রা. এমনই করতেন। কবর স্পর্শ ও চুম্বন এ কারণে অবৈধ যে, যদি তা আল্লাহর ইবাদত বা রাসূলুল্লাহর সম্মানার্থে করা হয়, তাহলে তা হবে শিরক। মু‘আবিয়া রা. কা‘বা শরীফের রুকনে শামী ও পশ্চিমের রুকন স্পর্শ করলে ইবন আব্বাস রা. তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হন। যদিও এ ধরনের কাজ দুই রুকনে ইয়ামানীর ক্ষেত্রে করার বিধান রয়েছে। বস্তুত রাসূলুল্লাহর মৃত্যুর কয়েকশ’ বছর পর নির্মিত কোন ঘরের দেয়ালে এভাবে চুম্বন বা স্পর্শ করার মাধ্যমে নবীজীর ভালোবাসা বা সম্মান প্রকাশ পায় না। বরং তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশ পায় বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণভাবে তাঁর অনুসরণ এবং তাঁর আনীত দীনে নতুন কিছু সংযোজন তথা বিদ‘আত সৃষ্টি না করার মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١ ﴾ [ال عمران: ٣١]

‘বল, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন।’[4]

আর যদি রাসূলুল্লাহর রওযার দেয়াল স্পর্শ বা চুম্বন ইবাদতের জন্য না হয়ে কেবল আবেগের বশে হয় কিংবা এমনি এমনি করা হয়, তাহলে তা হবে এমন ভ্রান্তি যাতে কোন কল্যাণ নেই। তাছাড়া তা হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের আদর্শ ও শিক্ষা পরিপন্থী। তদ্রুপ এটি অজ্ঞ লোকদের জন্য হবে ক্ষতিকর ও প্রবঞ্চক যারা দেখলে এসবকে ইবাদত মনে করবে।

কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ দূর করার জন্য নবীজীর কাছে প্রার্থনা করা :

যিয়ারতকারী কোন কল্যাণ লাভ বা অকল্যাণ দূর করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে দো‘আ করবেন না। এটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠ ﴾ [غافر: ٦٠]

‘আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’[5]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿ وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨ ﴾ [الجن: ١٨]

‘আর নিশ্চয় মসজিদগুলো আল্লাহরই জন্য। কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।’[6]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে এ ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন যে, নবী নিজেও নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক নন। আল্লাহ বলেন,

﴿ قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ ﴾ [الاعراف: ١٨٨]

‘বল, ‘আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান।’[7]

নবী যেহেতু নিজেই নিজের লাভ-ক্ষতির ক্ষমতা রাখেন না তাই অন্যের লাভ-ক্ষতির ক্ষমতা রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে উম্মতের মধ্যে এ ঘোষণাও দিতে বলেছেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন,

﴿ قُلۡ إِنِّي لَآ أَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا رَشَدٗا ٢١ ﴾ [الجن: ٢١]

‘বল, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য না কোন অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখি এবং না কোন কল্যাণ করার।’[8]

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন

﴿ وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ٢١٤ ﴾ [الشعراء: ٢١٤]

(‘আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর।’[9]) আয়াতটি অবতীর্ণ হল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘হে মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমা, হে আবদুল মু্ত্তালিবের মেয়ে সাফিয়্যা (নবীজীর ফুফু) এবং হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর, আমি আল্লাহর হুকুম থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করার কোন ক্ষমতা রাখি না। তোমরা আমার কাছে আমার সম্পদ থেকে যা চাওয়ার চাইতে পার।’ (আমি তা দিতে পারব; কিন্তু আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে আমি তোমাদের যামিন হতে পারব না)।[10]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে দো‘আ-ইস্তিগফার করার জন্য আবেদন করা :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর কাছে কেউ আল্লাহর দরবারে নিজের জন্য দো‘আ বা ইস্তিগফার করার আবেদন করবেন না। কারণ তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ সুযোগের সমাপ্তি ঘটেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِذَا مَاتَ أَحَدُكُمْ انْقَطَعَ عَمَلُهُ».

‘তোমাদের কেউ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়।’[11]

আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ إِذ ظَّلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ جَآءُوكَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ ٱللَّهَ وَٱسۡتَغۡفَرَ لَهُمُ ٱلرَّسُولُ لَوَجَدُواْ ٱللَّهَ تَوَّابٗا رَّحِيمٗا ٦٤ ﴾ [النساء: ٦٤]

‘আর যদি তারা- যখন নিজদের প্রতি যুলম করেছিল তখন তোমার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইত তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী, দয়ালু পেত।’[12]

এটি রাসূলের জীবদ্দশার সাথে সম্পৃক্ত। তাই এ আয়াতের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে ইস্তিগফারের আবেদন করার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে অতীতবাচক ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন; ভবিষ্যতবাচক ক্রিয়া ব্যবহার করেননি। আয়াতখানি সে সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর জীবৎকালে ছিল। সুতরাং তা তাঁর পরবর্তী লোকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

নবীজী ও তাঁর সাহাবীদ্বয়ের কবর যিয়ারতের এই বিধান শুধু পুরুষদের জন্য। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে বিধান হলো, তাদের জন্য নবীজী বা অন্য যেকারো কবরই যিয়ারত না করা উত্তম। কারণ আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم زَائِرَاتِ الْقُبُورِ».

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী মহিলাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন।’[13]

[1]. ইবন তাইমিয়া, মজমূ‘ ফাতাওয়া : ২৬/৯৭।

[2]. ইবন তাইমিয়া, মজমূ‘ ফাতাওয়া : ২৭/১০; ইবন তাইমিয়া, আল-জাওয়াবুল বাহির ফী যুওয়ারিল মাকাবির : ৮২।

[3]. ইবন তাইমিয়া, মজমূ‘ ফাতাওয়া : ২৭/৯১; ইবন কুদামা, মুগনী : ৩/৫৫৯।

[4]. আলে-ইমরান : ৩১।

[5]. মু’মিন : ৬০।

[6]. জিন : ১৮।

[7]. আ‘রাফ : ১৮৮।

[8]. জিন : ২১।

[9]. শু‘আরা : ২১৪।

[10]. মুসলিম : ৫০৩।

[11]. মুসলিম : ৪৮৪৩।

[12]. নিসা : ৬৪।

[13]. তিরমিযী : ৩২০।