ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ৩. বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ১০. ১. মুসলিম সমাজে রাষ্ট্র সংস্কারে হাদীসের নির্দেশনা

আমরা দেখেছি যে, সমকালীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলি উমাইয়া, আববাসী, ফাতিমী, বাতিনী ইত্যাদি মুসলিম রাষ্ট্রের মতই পাপে লিপ্ত মুসলিম রাষ্ট্র। এ সকল রাষ্ট্রে দীনের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় রাষ্ট্রীয় পাপ, অনাচার, অবিচার ও ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আপত্তি ও প্রতিবাদ করা এবং এগুলো দূর করার দাওয়াত দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাশাপাশি এ সকল রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখাও দীন প্রতিষ্ঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। ইতোপূর্বে আনুগত্য, জামা‘আত, বাই‘আত ইত্যাদি প্রসঙ্গে এ বিষয়ক কয়েকটি হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

(১) ‘‘কেউ তার শাসক বা প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামা‘আত (মুসলিম সমাজ বা রাষ্টের ঐক্য)-এর বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’

(২) ‘‘যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে বের হয়ে এবং ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’

(৩) ‘‘যে ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থেকে নিজেকে বের করে নিল কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হলে সে নিজের জন্য কোন ওজর পেশ করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল যে, তার গলায় কোন ‘বাই‘আত’ বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অঙ্গীকার নেই সে ব্যক্তি জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’

(৪) ‘‘অচিরেই তোমাদের উপর অনেক শাসক-প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় ও অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে এ সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না।)’’ সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বলেন, ‘‘না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।’’

(৫) ‘‘হুশিয়ার থাকবে! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক-প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছেন, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে না নেয়।’’

(৬) ‘‘যখন তোমরা তোমাদের শাসক-প্রশাসকগণ থেকে এমন কিছু দেখবে যা তোমরা অপছন্দ কর, তখন তোমরা তার কর্মকে অপছন্দ করবে, কিন্তু তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিবে না।’’

(৭) ‘‘ভবিষ্যতে অনেক বিচ্যুতি-অন্যায় সংঘটিত হবে। যদি এমন ঘটে যে, এ উম্মাতের ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কেউ এসে সে ঐক্য বিনষ্ট করে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায় তবে সে যেই হোক না কেন তোমরা তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে। অন্য বর্ণনায়: তোমাদের বিষয়টি একব্যক্তির বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় (একজন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে থাকা অবস্থায়) কোনো একব্যক্তি যদি এসে তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে বা ‘জামাআত’ বিভক্ত করতে চায় তবে তাকে হত্যা করবে।’’

(৮) ‘‘যদি দুজন খলীফার বাইয়াত করা হয় তবে যে পরে বাইয়াত নিয়েছে তাকে হত্যা করবে।’’

(৯) আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


على المرءِ المسلمِ السمْعُ والطاعةُ . فيما أحبّ وكَرِهَ . إلا أن يُؤْمَرَ بمعصيةٍ . فإن أُمِرَ بمعصيةٍ ، فلا سَمْع ولا طاعَةَ

‘‘মুসলিমের দায়িত্ব রাষ্ট্রের আনুগত্য করা, তার পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় সকল বিষয়ে, যতক্ষণ না কোনো পাপের নির্দেশ দেওয়া হয়। যদি কোনো পাপের নির্দেশ দেওয়া হয় তবে সে বিষয়ে কোনো আনুগত্য নেই।’’[1]

(১০) অন্য হাদীসে উবাদা ইবনুস সামিত বলেন:


على المرء المسلم

بايعْنا رسولَ اللهِ صلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ على السمعِ والطاعةِ . في العُسرِ واليُسرِ . والمَنشطِ والمَكرهِ . وعلى أَثَرةٍ علينا . وعلى أن لا ننازعَ الأمرَ أهلَه . وعلى أن نقولَ بالحقِّ أينما كنّا . لا نخافُ في اللهِ لومةَ لائمٍ (في لفظ: وأن لا تنازع الأمر أهله قال الا أن تروا كفراً بواحاً عندكم من الله برهان)


‘‘আমরা রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর বাইয়াত করলাম যে, আমরা কষ্টে ও আরামে, উদ্দীপনায় ও আপত্তিতে এবং আমাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হলেও রাষ্ট্রের আনুগত্য করব, রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্তদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব না এবং আল্লাহর বিষয়ে কারো নিন্দা-আপত্তির ভয়-তোয়াক্কা না করে যেখানেই থাকি না কেন হক্ক কথা বলব। অন্য বর্ণনায়: আমরা ক্ষমতাপ্রাপ্তদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করব না, তবে তিনি বলেন: তোমরা যদি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাতীত কুফর দেখতে পাও, যে বিষয়ে তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে (তবে সেক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্তরা তাদের এ অধিকার হারাবে)।’’[2]

(১১) হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান বলেন,

قلتُ : يا رسولَ اللهِ ! إنا كنا بشرٌ . فجاء اللهُ بخيرٍ . فنحن فيه . فهل من وراءِ هذا الخيرِ شرٌّ ؟ قال ( نعم ) قلتُ : هل من وراءِ ذلك الشرِّ خيرٌ ؟ قال ( نعم ) قلتُ : فهل من وراءِ ذلك الخيرِ شرٌّ ؟ قال ( نعم ) قلتُ : كيف ؟ قال ( يكون بعدي أئمةٌ لا يهتدون بهدايَ ، ولا يستنُّون بسُنَّتي . وسيقوم فيهم رجالٌ قلوبُهم قلوبُ الشياطينِ في جُثمانِ إنسٍ ) قال قلتُ : كيف أصنعُ ؟ يا رسولَ اللهِ ! إن أدركت ُذلك ؟ قال تسمعُ وتطيع للأميرِ . وإن ضَرَب ظهرَك . وأخذ مالَك . فاسمعْ وأطعْ

‘‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা মন্দ অবস্থায় ছিলাম, এরপর আল্লাহ ভাল অবস্থা প্রদান করলেন, যার মধ্যে আমরা এখন রয়েছি। এরপর কি আবার মন্দ রয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, সে মন্দের পরে কি আবার ভাল রয়েছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমি বললাম, সে ভালর পরে কি আবার মন্দ রয়েছে? তিনি বলেন: হ্যাঁ। আমি বললাম, তা কেমন? তিনি বলেন, আমার পরে এমন অনেক শাসক হবে যারা আমার আদর্শ গ্রহণ করবে না এবং আমার রীতি পালন করবে না। তাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ থাকবে যাদের অন্তর হলো মানব দেহের মধ্যে শয়তানের অন্তর। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি এরূপ অবস্থায় পড়ি তাহলে কী করব? তিনি বলেন: তুমি শাসকের কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে, যদিও তোমার পৃষ্ঠদেশে আঘাত করা হয় এবং তোমার সম্পদ কেড়ে নেয়া হয় তবুও তুমি কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।’’[3]

(১২) আবূ যার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বলেন:


كيف أنت إذا كانت عليك أمراءُ يُؤخِّرونَ الصلاةَ عن وقتِها ، أو يُميتونَ الصلاةَ عن وقتِها ؟ قال قلتُ : فما تأمرني ؟ قال صَلِّ الصلاةَ لوقتِها . فإن أدركتَها معهم فصلِّ . فإنها لكَ نافلةً

‘‘যখন তোমার উপর এমন শাসক-প্রশাসকগণ থাকবে যারা সালাতকে তার সময়ের পরে আদায় করবে বা সালাতকে তার সময়ের পরে নিয়ে হত্যা করবে তখন তোমার কী অবস্থা হবে? আমি বললাম, আপনি আমাকে এমতাবস্থায় কী করতে নির্দেশ দেন? তিনি বলেন: তুমি ওয়াক্ত অনুসারে সালাত আদায় করবে। এরপর যদি তাদের সাথে সালাত পাও তাহলে তাদের সাথে তা আদায় করবে; আর তা তোমার জন্য নফল বলে গণ্য হবে।’’[4]

এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শাসক-প্রশাসকগণ যদি জাগতিক বা ধর্মীয় অপছন্দনীয় ও অন্যায় কর্মকান্ডে লিপ্ত হন তবে তাদের অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, আপত্তি ও প্রতিবাদ সহ তাদের আনুগত্য ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস হাদীসগ্রন্থগুলি সংকলিত রয়েছে। সহীহ মুসলিমের ‘‘কিতাবুল ইমারাত’’ পাঠ করলে পাঠক এ বিষয়ক আরো অনেক হাদীস জানতে পারবেন। মূলত এ সকল হাদীস এ বিষয়ক কুরআনী নির্দেশনার ব্যাখ্যা। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا

‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, এবং আনুগত্য করা রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও; যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের উপর ঈমান রেখে থাক। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’’[5] এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ‘‘উলিল আমর’’-এর আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। আরবীতে ‘‘উলূ’’ বা ‘‘উলী’’ শব্দের অর্থ মালিকগণ বা অধিকারিগণ। আর ‘‘আমর’’ অর্থ আদেশ। ‘‘উলুল আমর’’ অর্থ আদেশের মালিকগণ।
‘‘উলূল আমর’’ বা আদেশের মালিকগণ বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে তিনটি মত রয়েছে: (১) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিকগণ, (২) আলিম ও ফকীহগণ ও (৩) সাহাবীগণ। নিঃসন্দেহে আলিমগণ ও সাহাবীগণের অনুসরণ ও আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে ‘‘আদেশের মালিকানা’’ মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারীদের; কারণ তারাই মূলত আদেশের মালিক, যাদের আদেশ পালন করতে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয় এবং যাদের আদেশ পালন না করলে অশান্তির সৃষ্টি হয়। এজন্য ইমাম তাবারী বলেন:


وأولى الأقوال في ذالك بالصواب، قول من قال: هم الأمراء والولاة، لصحة الأخبار عن رسول الله صلى الله عليه وسلم بالأمر بطاعة الأئمة والولاة فيما كان [الله] طاعة، وللمسلمين مصلحة

‘‘সঠিক মত হলো, যে ‘‘উলুল আমর’’ বা আদেশের মালিকগণ বলতে রাষ্ট্রীয় শাসক-প্রশাসকগণকে বুঝানো হয়েছে। কারণ বিভিন্ন সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে এবং মুসলিম সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্রপ্রধান, ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের আনুগত্য করতে নির্দেশ দিয়েছেন।’’[6] অর্থাৎ যারা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী বা মালিক তাদের নির্দেশ মান্য করা ও আনুগত্য করা মুমিনের দীনী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন দিক উপরের হাদীসগুলিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইমাম তাবারী ও অন্যান্য মুফাস্সির, মুহাদ্দিস ও ফকীহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ও এ প্রসঙ্গে উপরের হাদীসগুলি ও সমার্থক অন্যান্য হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমাদের সমাজে অনেকে মনে করেন, খিলাফতে রাশেদার মত ‘‘ইসলামী রাষ্ট্রের’’ ক্ষেত্রেই এ আয়াত ও এ সকল হাদীস প্রযোজ্য, আমাদের মত রাষ্ট্রে সেগুলি প্রযোজ্য নয়। ধারণাটি সঠিক নয়; কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ কোনো শর্ত আরোপ করেন নি।

বস্ত্তত এ হাদীসগুলি খিলাফাতে রাশেদার মত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বলা হয় নি। কারণ তাদের সময়ে শাসকগণ পাপ, অন্যায় বা ইসলাম বিরোধিতায় লিপ্ত হন নি। তাদের যুগে সালাত হত্যা করা হয় নি এবং মানুষের খোলসে শয়তানের অন্তর বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের আবির্ভাব হয় নি। এগুলি সবই পরবর্তী যুগের জন্য বলা হয়েছে। সাহাবীগণ ও পরবর্তী আলিমগণ উমাইয়া, আববাসী, ফাতিমী, বাতিনী, শিয়া, রাফিযী, মোগল, তাতার ও অন্যান্য সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই এ সকল নির্দেশ প্রযোজ্য বলে গণ্য করেছেন। আর সমকালীন মুসলিম দেশগুলি এ সকল রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছুই নয়। এ সকল রাষ্ট্রেও উপরের হাদীসগুলি ও সমার্থক হাদীসগুলির সামগ্রিক শিক্ষার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এ সকল হাদীসের আলোকে আমরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা রাষ্ট্র-সংস্কারের বিষয়ে কয়েকটি মূলনীতি লাভ করি:


(১) রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা
উপর্যুক্ত সকল হাদীসের নির্দেশনা যে, মুসলিম সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখতে হবে এবং মুমিনকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। এ সকল হাদীসের আলোকে আলিমগণ বলেছেন যে, মুসলিম সমাজে ‘ইমাম নিয়োগ’ বা ‘খলীফা নিয়োগ’ ‘‘ফরয কিফায়া’’। এখানে ইমাম বা খলীফা বলতে রাষ্ট্রপ্রধান বুঝানো হয়েছে। এ রাষ্ট্রপ্রধানকে ইমাম, খলীফা, রাজা, সম্রাট, আমীরুল মুমিনীন, প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন, রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা মুসলিম সমাজের উপর ফরয কিফায়া এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের আনুগত্য করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয আইন।[7]


(২) বাইয়াত, জামাআত ও তাআত
রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক। তার আনুগত্যের প্রতীক ‘‘বাইয়াত’’। মুমিনকে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অঙ্গীকার বহন করতে হবে। সকল পরিস্থিতিতে ‘‘জামাআত’’ বা রাষ্ট্রীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ বা সংখ্যগারিষ্ট নাগরিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বা মেনে নিলে নিজের ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগত মতামত বর্জন করে রাষ্ট্র ও সমাজের ঐক্য বজায় রাখতে হবে। বাইয়াত ও জামাআতের পাশাপাশি ‘তা‘আত’ বা আনুগত্য বজায় রাখতে হবে। শাসক-প্রশাসকদের আনুগত্য ইসলাম নির্দেশিত দায়িত্ব। সরকারের জুলুম, অন্যায় বা পাপের কারণে আনুগত্যের এ দায়িত্ব রহিত হয় না। যে নির্দেশ বা আইন পাপ নয় তা মান্য করা মুমিনের দীনী দায়িত্ব।


(৩) পাপে ঐক্য বা আনুগত্য নেই
যে বিষয় কুরআন-হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ নয় এরূপ বিষয়েই ঐক্য ও আনুগত্যের বিধান। রাষ্ট্র যদি কোনো পাপের নির্দেশ দেয় তাহলে সে নির্দেশ মান্য করা বা সে বিষয়ে আনুগত্য করা মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ। পাপের নির্দেশ মুমিন পালন করেন না। আবার পাপের নির্দেশের কারণে অন্যান্য সাধারণ বিধান ও আইন অমান্য করেন না।


(৪) ঘৃণা, আপত্তি বনাম স্বীকৃতি
রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার বা শাসক-প্রশাসকের পাপের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব ঘৃণা ও আপত্তি। শাসক-প্রশাসকদের পাপ দুপ্রকারের: তাদের জীবনের ব্যক্তিগত পাপ এবং পাপের নির্দেশনা বা পাপনির্ভর আইন, নীতি বা বিধান প্রণয়ন। সকল ক্ষেত্রে মুমিনের ন্যূনতম দায়িত্ব পাপকে ঘৃণা করা। এরপর মুমিন সাধ্যমত আপত্তি ও প্রতিবাদ করবেন। এরূপ পাপ মেনে নেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়া, পাপের বিষয়ে তাদের অনুসরণ করা বা এর পক্ষে অবস্থান নেওয়া মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ।
পাপের ঘৃণা, আপত্তি বা প্রতিবাদের অর্থ অন্যান্য বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার মধ্যে ঘৃণা, আপত্তি ও প্রতিবাদ জানানো। অনেক সময় আবেগী মুমিন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আইন অমান্য, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বা অনুরূপ অন্যায় ও পাপে লিপ্ত হয়। খারিজীগণ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের নামে এরূপ অন্যায়ে লিপ্ত হতো। সাহাবীগণ তাদেরকে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও আইন পালনের কথা বললে আপত্তি করত। এক ঘটনায় কতিপয় খারিজী হুযাইফা (রা)-কে বলে, আমরা কি ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে পারব না?! আপনি কি তা করবেন না?! তিনি বলেন:


ألا إن الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر لحسن ولكن ليس من السنة أن ترفع السلاح على إمامك


‘‘ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। তবে তোমার রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে বা তার নির্দেশের বাইরে অস্ত্রধারণ, বলপ্রয়োগ বা বিদ্রোহ করা সুন্নাত সম্মত নয়।’’[8] উপরের মূলনীতিগুলির আলোকে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়টি ভালভাবে উপলব্ধি করতে আমাদেরকে এ বিষয়ে সাহাবী-তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগগুলির প্রসিদ্ধ আলিম, ইমাম, পীর-মাশাইখ ও সংস্কারকগণের কর্মধারা পর্যালোচনা করতে হবে। সেজন্য মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রাথনা করছি।

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৬৯।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৮৮, ২৬৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭০।

[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭৬।

[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৪৮।

[5] সূরা (৪) নিসা: আয়াত ৫৯।

[6] তাবারী, তাফসীর (শামিলা) ৮/৫০২।

[7] বিস্তারিত দেখুন: আবদুল্লাহ ইবনু উমার দুমাইজী, আল-ইমামাতুল উযমা, পৃ. ৪৫-৭৫।

[8] ইবনু আবী শায়বা (২৩৫ হি.), আল-মুসান্নাফ ৭/৫০৮; বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি.), শু’আবুল ঈমান, ৬/৬৩; দানী, আস-সুনানুল ওয়ারিদাতুল ফিল ফিতান, ২/৩৯১।