ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ৩. বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৬. ৪. কাফির যোদ্ধা হত্যা বনাম কাফির হত্যা

কুরআনে যেমন কোথাও কোথাও কাফিরদের বা মুশরিকদের হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি অন্যত্র শুধু যুদ্ধরতদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে এবং সীমালঙ্ঘন করো না।’’ অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন:

بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ وَأَذَانٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ فَإِنْ تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنْقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَىٰ مُدَّتِهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّىٰ يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ كَيْفَ يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِنْدَ اللَّهِ وَعِنْدَ رَسُولِهِ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ

‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে তাদের প্রতি। সুতরাং তোমরা যমীনে বিচরণ কর চার মাস, আর জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না, আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের অপদস্থকারী। আর মহান হজ্জের দিন মানুষের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষণা, নিশ্চয় আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও। অতএব যদি তোমরা তাওবা কর, তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি তোমরা ফিরে যাও, তাহলে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না। আর যারা কুফরী করেছে তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। তবে মুশরিকদের মধ্য থেকে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছ, অতঃপর তারা তোমাদের সাথে কোনো ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তোমরা তাদেরকে দেওয়া চুক্তি তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পূর্ণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন। অতঃপর যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো (ঘোষিত ৪ মাস) অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর, তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাটিতে বসে থাক। তবে যদি তারা তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম করুণাম। আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দাও। তা এজন্য যে তারা অজ্ঞ সম্প্রদায়। কীভাবে মুশরিকদের জন্য চুক্তি-অঙ্গীকার থাকবে আল্লাহর কাছে ও তাঁর রাসূলের কাছে? অবশ্য মসজিদে হারামের কাছে যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের কথা আলাদা। যতক্ষণ তারা তোমাদের জন্য ঠিক থাকে, ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য ঠিক থাক। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালবাসেন।’’[1]

এখানে আল্লাহ বলেছেন: ‘‘যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো (ঘোষিত ৪ মাস) অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর ...’’ অনেক সময় অমুসলিম লেখকগণ এবং কখনো আবেগী মুজাহিদগণ কুরআনের অন্যান্য আয়াত বাদ দিয়ে এবং এ আয়াতগুলি আগের ও পরের বক্তব্য বাদ দিয়ে শুধু এ কথাগুলি উদ্ধৃত করে দাবি করেন যে, ইসলামে সকল কাফির বা অমুসলিমকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ অন্যান্য আয়াত বাদ দিলেও এখানের আয়াতগুলি খুবই স্পষ্ট। এখানে সুস্পষ্টতই বলা হয়েছে, যে সকল কাফির জনগোষ্ঠীর সাথে- তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যে সকল কবীলা বা গ্রাম রাষ্টের সাথে- তোমাদের চুক্তি রয়েছে তাদের মধ্যে যারা চুক্তি ভঙ্গ করে নি তাদের চুক্তি বহাল থাকবে। আর যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদেরকে তোমাদের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিল ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়ে চার মাসের সময় দাও। এ সময়ের মধ্যে তার যদি দীন গ্রহণ করে বা বশ্যতা গ্রহণ করে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে তবে তাদেরকে নিরাপত্তা দিবে। অন্যান্যদের ক্ষেত্রে ঘোষিত চারমাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করবে। তাদের বাহিনীকে যেখানে পাওয়া যাবে আক্রমন করা হবে এবং হত্যা বা বন্দী করা হবে।

এখানে অযোদ্ধা মুশরিকদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয় নি। এ আয়াতের নির্দেশ পালনে কখনোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অযোদ্ধা মুশরিকদেরকে পথে প্রান্তরে ধরে হত্যা করতে নির্দেশ দেন নি। এখানে মুশরিকগণ বলতে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া হলো সে সকল চুক্তিভঙ্গকারী মুশরিক জনগোষ্ঠী বা কবীরা রাষ্ট্রের যোদ্ধাদেরকে বুঝানো হয়েছে। এখানে প্রথমে, শেষে ও মাঝে বারংবার চুক্তিরক্ষাকারীদের চুক্তি রক্ষা করতে ও নিরাপত্তাপ্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাকি সকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতর্কিত বা গোপন আক্রমন না করে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে চার মাসের সময় দেওয়া হয়েছে।

এ ঘোষণার উদ্দেশ্য যথাসম্ভব বেশি জিহাদ করে বেশি মুশরিক হত্যা করা নয়, বরং এ ঘোষণার উদ্দেশ্য জিহাদের প্রয়োজনীয়তা সীমিত করা এবং যত বেশি সম্ভব মানুষকে বাঁচানো। আধুনিক যুগেও আগ্রহী অযোদ্ধাদের সুযোগ দেওয়ার জন্য বা যুদ্ধরত রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর মনোবল দুর্বল করে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য এরূপ ঘোষণা দেওয়া হয়। যে কোনো আন্তর্জাতিক ও মানবিক বিচারে যুদ্ধের জন্য এর চেয়ে মানবিক ও যৌক্তিক ঘোষনা হতে পারে না। আমরা পরে দেখব যে, বাইবেলীয় জিহাদের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো নৈতিকতা রক্ষা করা হয় নি; বরং যে কোনোভাবে প্রতারণার মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব শত্রু হত্যাই সেখানে মূল লক্ষ্য বলে গণ্য করা হয়েছে।

এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের প্রায়োগিক সুন্নাত থেকে আমরা নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারি যে, কাফির-মুশরিককে হত্যার নির্দেশের অর্থ যুদ্ধের ময়দানে কাফির যোদ্ধা হত্যা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই বিচারে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বা যুদ্ধরত ‘কাফির’ ছাড়া অন্যদেরকে হত্যা করেন নি। তার রাষ্ট্রে অগণিত কাফির সকল নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করেছেন। তিনি কখনোই তাদের হত্যা করেন নি বা হত্যার অনুমতি দেন নি। ঈমানের দাবিদার মুনাফিকগণকে তিনি চিনতেন। তাদেরকেও হত্যার অনুমতি তিনি দেন নি। উপরন্তু তিনি অযোদ্ধা সাধারণ অমুসলিম নাগরিককে হত্যা কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক বা অমুসলিম দেশের অমুসলিম
নাগরিককে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও লাভ করতে পারবেন না, যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বৎসরের দুরত্ব থেকে লাভ করা যায়।’’

আমরা পূর্ববর্তী হাদীসে দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খারিজীদেরকে যখন যেখানে পাওয়া যায় হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে সাহাবীগণ কখনোই ঢালাওভাবে ‘‘খারিজী’’ মতাবলম্বীদের যেখানে পাওয়া যায় হত্যা করার অনুমতি বুঝেন নি। বরং এ থেকে তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে খারিজী যোদ্ধাদেরকে হত্যার নির্দেশনা বুঝেছেন। খারিজীগণ অযোদ্ধা সাহাবী-তাবিয়ীগণ বা সাধারণ মুসলিমদের হত্যা করলেও সাহাবীগণ কখনোই যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোনোভাবে খারিজীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন নি বা তাদেরকে হত্যা করেন নি। সমাজে তারা খারিজীদের সাথেএকত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছেন।[2]

[1] সূরা (৯) তাওবা: ১-৭ আয়াত।

[2] বিস্তারিত দেখুন, আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৫৮২।