ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ১. পরিচিতি ও আলোচিত কারণসমূহ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
১. ৪. আলোচিত দ্বিতীয় কারণ: ইসলামী শিক্ষা (১৫-২১ নম্বর কারন)

(১৫) জঙ্গিবাদ আমাদের দেশের একটি সমস্যা। এর পাশাপাশি আমাদের সমস্যগুলির অন্যতম হলো, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, পারিবারিক বা সামাজিক সহিংসতা, যৌতুক, এসিড, দুর্নীতি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন-খারাবি, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি ইত্যাদি। কেবলমাত্র নীতিকথা বা বদলে যাওয়ার উৎসাহ দিয়ে এ সকল অপরাধ বা অবক্ষয় কখনোই রোধ করা যায় না। বস্ত্তত মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধ ও নৈতিক অনুভূতির সাথে ‘‘ভয় ও লোভ’’-ই মানুষকে অপরাধ ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রতিশোধের স্পৃহা, সম্পদ, ক্ষমতা বা শক্তির লোভ ও অনুরূপ পশুপ্রবৃত্তি মানুষকে দ্রুত ও নগদ স্বার্থ হাসিলের জন্য দুর্নীতি ও হিংস্রতায় উদ্বুদ্ধ করে। ভয় ও লোভই তার ‘‘নগদ’’ প্রাপ্তির স্পৃহা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ভয় ও লোভের তিনটি পর্যায়: (১) নিজের বিবেকের কাছে নন্দিত বা নিন্দিত হওয়ার ভয় ও লোভ। (২) সমাজ, রাষ্ট্র বা আইনের চোখে নিন্দিত, নন্দিত, তিরস্কৃত, পুরস্কৃত বা শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার আশা ও ভয়। (৩) আল্লাহর কাছে নিন্দিত, নন্দিত, তিরস্কৃত বা পুরস্কৃত হওয়ার আশা ও ভয়। এর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়টিই প্রকৃতভাবে দুর্নীতি ও হিংস্রতা বন্ধ করতে পারে। কারণ, প্রত্যেকের পক্ষেই নিজের বিবেককে প্রবোধ দেওয়া সম্ভব। সকলেই জানে সমাজ, রাষ্ট্র বা আইনকে ফাঁকি দেওয়া যায় এবং এগুলির কাছে কোনো সঠিক মূল্যায়ন আশা করা যায় না। এজন্য প্রকৃত সততা তৈরি করতে আল্লাহর ভয় ও লোভ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ সকল কর্মের পরিপূর্ণ পুরস্কার দিবেন এবং সকল অন্যায়ের শাস্তি দিবেন বলে অবচেতনের বিশ্বাস লাভের পর মানুষ যে কর্মটি আল্লাহর কাছে অন্যায় বলে নিশ্চিত জানতে পারে সে কাজ করতে পারে না এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে ভাল বলে প্রমাণিত কাজটি কোনো জাগতিক পুরস্কার বা প্রশংসার আগ্রহ ছাড়াই, বরং সকল প্রতিকুলতা সত্ত্বেও করার চেষ্টা করে। বিশেষত আমাদের দেশে যেখানে আইনকে ফাঁকি দেওয়া অনেক বেশি সহজ সেখানে একমাত্র আল্লাহর ভয়ই দুর্নীতি, অপরাধ ও অবক্ষয় রোধের একমাত্র রক্ষাকবজ। এজন্য নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারই এ সকল অপরাধ ও অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণে সত্যিকার অবদান রাখতে পারে।

(১৬) জঙ্গিবাদ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী ও আর্ন্তজাতিক বেনিয়া বা বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদীরা কথা বলছেন। আবার দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ ও জনগণও কথা বলছেন। তবে প্রত্যেকের কথা বলার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনশক্তির উদ্ভব রোধ করা এবং তাদের আগ্রাসন, তাদের বাণিজ্য, অশ্লীলতা ভিত্তিক পণ্য, মাদক পণ্য ইত্যাদির ব্যাপক প্রসার ও জাতীয় সম্পদের ইজারা-দখলের পথ উন্মুক্ত করা। এতে সংশি­ষ্ট দেশে অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি হলেও তাদের কোনো অসুবিধা নেই। পক্ষান্তরে দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ, সমাজবিদ ও জনগণ কথা বলছেন জাতীয় প্রেক্ষপটে দেশের অন্যান্য সমস্যার সাথে এ কঠিন সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে দেশের সামগ্রিক স্থিতি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে।

(১৭) জাতীয় কল্যাণে জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলছেন যারা তাদের বুঝতে হবে যে, জঙ্গিবাদের অযুহাতে মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বা মাদ্রাসা-পড়া, স্কুল-পড়া বা কোথাও না পড়া বোরকাওয়ালী, টুপিওয়ালা, দাড়িওয়ালা, মসজিদগামী ধার্মিক কর্মকর্তা, কর্মচারী, ছাত্র, ছাত্রী বা সাধারণ নাগরিককে অপদস্ত করলে, ঘৃণা প্রকাশ করলে, তাদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করলে বা তাদেরকে হয়রানি করলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পুরোপুরি লাভবান হলেও দেশ ও জাতি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে জঙ্গিবাদ কমবে না, অন্যান্য অপরাধ ও দুর্নীতি বাড়বে এবং দেশ অভাবনীয় সংঘাত ও আল্লাহর গযবে নিপতিত হবে।

(১৮) এভাবে আমরা দেখছি যে, যারা জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামী শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা বা মাদ্রাসা শিক্ষার সংকোচন দাবি করছেন এবং যারা জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামকে সম্পৃক্ত করে ইসলামের সংকোচন বা মুসলমানদের জোরপূর্বক খৃস্টান করার দাবি করছেন তাদের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাদের কেউ না জেনে এবং কেউ জেনেশুনে বিশেষ উদ্দেশ্যে এরূপ দাবি করছেন।

(১৯) আমরা আরো দেখছি যে, মাদ্রাসা শিক্ষা বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষা সংকোচন করলে তা জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে কোনোরূপ অবদান রাখবে না, বরং তার প্রসারে অবদান রাখতে পারে। তবে এরূপ সংকোচন নিঃসন্দেহে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, পারিবারিক বা সামাজিক সহিংসতা, যৌতুক, এসিড, দুর্নীতি, ধর্ষণ, ব্যভিচার, এইডস, অপহরণ, খুন-খারাবি, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি ইত্যাদি অপরাধ ও অবক্ষয়ের প্রসারে অভাবনীয় অবদান রাখবে। আমরা জাতিগতভাবে এরূপ সংকোচনে লাভবান না হলেও আন্তর্জাতিক বেনিয়া চক্র তাদের মাদকদ্রব্য ও অশ্লীলতা-ভিত্তিক বহুমাত্রিক পণ্য বিপননের ক্ষেত্রে লাভবান হবে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের অবক্ষয় ও দুর্নীতির সুযোগে তাদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।

(২০) এখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, সমস্যার কারণ নির্ধারণে বিভ্রান্তি অনেক সময় সমস্যা উস্কে দিতে পারে। সন্ত্রাসের জন্য সন্ত্রাসীর জাতি, ধর্ম, গোত্র, দল বা শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করলে মূলত সন্ত্রাসীকে সাহায্য করা হয়। এতে একদিকে সন্ত্রাসীর স্বজাতি, স্বধর্ম, স্বদল বা স্বশিক্ষার মানুষেরা সন্ত্রাসের বিরোধিতার পরিবর্তে সন্ত্রাস বিরোধীদের সাথে বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েন, অপরদিকে পরোক্ষভাবে তাদের মধ্যে সন্ত্রাসীর প্রতি এক প্রকারের ‘সহমর্মিতা’ জন্মলাভ করে। আমরা দেখেছি যে, কোনো কোনো পাশ্চাত্য পন্ডিত সন্ত্রাসের জন্য ইসলামকে দায়ী বলে মন্তব্য করে ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘাতকেই উস্কে দিচ্ছেন। সন্ত্রাসের জন্য ইসলামী শিক্ষাকে দায়ী করলেও একইভাবে সন্ত্রাসকে উস্কে দেওয়া হবে এবং সন্ত্রাসীদের জন্য সহমর্মী সৃষ্টি করা হবে। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষেরা সন্ত্রাস বিরোধিতার বদলে অপ্রাসঙ্গিক বির্তকে জাড়িয়ে পড়বেন। সর্বোপরি এরূপ মতামতের ভিত্তিতে যদি সরকার বা প্রশাসন মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ, সংকোচন বা মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ঢালাও কোনো কর্মকান্ড হাতে নেন তবে তাতে নতুন এক প্রকারের সহিংসতায় আক্রান্ত হবে দেশ ও জাতি।

(২১) মূলত কোনো ধর্ম, মতবাদ বা আদর্শ সহিংসতা বা সন্ত্রাস শিক্ষা দেয় না। মানুষ মানবীয় লোভ, দুর্বলতা, অসহায়ত্ব, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদির কারণে সহিংসতা বা হিংস্রতায় লিপ্ত হয়। এরূপ সহিংসতায় লিপ্ত ব্যক্তি নিজের কর্মের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য, নিজের বিবেককে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করার জন্য, অন্যকে নিজের পক্ষে টানার জন্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে নিজের আদর্শকে ব্যবহার করে। হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসকারী আরবদেরকে জেরুজালেম ও অন্যান্য ফিলিস্তিনী এলাকা থেকে সন্ত্রাস ও গণহত্যার মাধ্যমে বিতাড়ন করে অন্যান্য দেশে হাজার বছর ধরে বসবাসকারী ইহূদীদেরকে সেখানে নিয়ে এসে ইস্রায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্য ইহূদী-খৃস্টানগণ পবিত্র বাইবেলের বাণীকে ব্যবহার করেছেন। অনুরূপভাবে আইরিশ ক্যাথলিক ব্রিটিশ প্রটেস্ট্যান্টের বিরুদ্ধে নিজের ধর্মমতকে ব্যবহার করেন, তিববতীয় বৌদ্ধ চীনের বিরুদ্ধে নিজের বৌদ্ধ ধর্মমতকে ব্যবহার করেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু উচ্চবর্ণের হিন্দুর বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বা ধর্মীয় মতামত ব্যবহার করেন, নিম্নরর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বর্ণপ্রথা বিষয়ে বেদ, গীতা ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের শিক্ষা ও বাণীগুলিকে ব্যবহার করেন, ফিলিস্তিনী যোদ্ধা ইহূদী দখলদারের বিরুদ্ধে নিজের ইসলাম বা খৃস্টান ধর্ম থেকে উদ্দীপনা বা প্রেরণা লাভের চেষ্টা করেন। আমাদের সমাজে ‘আওয়ামী লীগের’ কর্মী যদি কোনো কারণে উত্তেজিত হয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হন তবে তিনি ‘স্বাধীনতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ইত্যাদি মহান বিষয়কে তার কর্মের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অনুরূপভাবে ‘বিএনপি’র কর্মী এ ক্ষেত্রে ‘শহীদ জিয়া’, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা ইত্যাদি মহান বিষয়কে নিজের ‘এক্সকিউজ’ হিসেবে ব্যবহার করেন। উভয় ক্ষেত্রেই দলের অন্যান্য বিচক্ষণ কর্মী জানেন যে, নিজের সহিংসতা বৈধ করার জন্যই এগুলি বলা হচ্ছে। সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে দায়ী করে মাদ্রাসা শিক্ষা, মাদ্রাসা বা মাদ্রাসা শিক্ষিতদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলে স্বভাবতই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে সহিংসতায় লিপ্ত হবেন এবং ‘ইসলাম’ ও ‘ইসলামী শিক্ষা’-র বিপন্নতাকে অজুহাত হিসেবে পেশ করবেন। এতে একমাত্র সন্ত্রাসীরাই লাভবান হবে এবং জাতি ভয়ঙ্কর সংঘাতের মধ্যে নিপতিত হবে।