কোন বিপদ আসলে তা সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে না নিয়ে বরং আল্লাহ্ তা‘আলার উপর অসন্তুষ্ট হওয়া আরেকটি কবীরা গুনাহ্ এবং হারাম।
মু’মিন বলতেই তাকে এ কথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, তার জীবনে যে কোন অঘটন ঘটুক না কেন তা একমাত্র তারই কিঞ্চিৎ কর্মফল। এর চাইতে আর বেশি কিছু নয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَآ أَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِيْبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْكُمْ وَيَعْفُوْ عَنْ كَثِيْرٍ»
‘‘তোমাদের যে কোন বিপদাপদ ঘটুক না কেন তা তো একমাত্র তোমাদেরই কর্মফল। তবুও আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের অনেক অপরাধই ক্ষমা করে দেন’’। (শূরা : ৩০)
বিপদ যতো বড়োই হোক প্রতিদানও ততো বড়ো। তবে বিপদের সময় আল্লাহ্ তা‘আলার উপর অবশ্যই সন্তুষ্ট থাকা চাই। বরং বিপদাপদ আসা তো আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসার পরিচায়কও বটে।
আনাস্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلَاءِ، وَإِنَّ اللهَ تَعَالَى إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلَاهُمْ، فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السُّخْطُ.
‘‘নিশ্চয়ই বিপদ যতো বড়ো প্রতিদানও ততোই বড়ো। আর আল্লাহ্ তা‘আলা কোন সম্প্রদায়কে ভালোবাসলেই তো তাদেরকে বিপদের সম্মুখীন করেন। অতঃপর যে ব্যক্তি এতে সন্তুষ্ট থাকলো তার জন্যই তো আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি আর যে ব্যক্তি এতে অসন্তুষ্ট হলো তার জন্যই তো আল্লাহ্ তা‘আলার অসন্তুষ্টি’’। (তিরমিযী ২৩৯৬; ইব্নু মাজাহ্ ৪১০৩ সা’হীহুল্ জা’মি’, হাদীস ২১১০)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ.
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা কারোর সাথে ভালোর ইচ্ছে করলে তাকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন’’। (বুখারী ৫৬৪৫)
মু’মিনের উপর যে কোন বিপদই আসুক না কেন সে জন্য তাকে একটি করে সাওয়াব এবং একটি করে তার গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَا مِنْ شَيْءٍ يُصِيْبُ الْـمُؤْمِنَ حَتَّى الشَّوْكَةِ تُصِيْبُهُ إِلاَّ كَتَبَ اللهُ لَهُ بِهَا حَسَنَةً، أَوْ حُطَّتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيْئَةٌ.
‘‘মু’মিনের উপর যে কোন বিপদই আসুক না কেন এমনকি তার পায়ে একটি কাঁটা বিঁধলেও আল্লাহ্ তা‘আলা এর পরিবর্তে তার জন্য একটি সাওয়াব লিখে রাখবেন এবং তার একটি গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন’’। (মুসলিম ২৫৭২)
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيْبُهُ أَذًى مِنْ مَرَضٍ فَمَا سِوَاهُ إِلاَّ حَطَّ اللهُ بِهِ سَيِّئَاتِهِ كَمَا تَحُطُّ الشَّجَرَةُ وَرَقَهَا.
‘‘মুসলিমের কোন কষ্ট হলে চাই তা অসুখের কারণেই হোক অথবা অন্য যে কোন কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা সে জন্য তার গুনাহ্গুলো ক্ষমা করে দেন যেমনিভাবে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে পড়ে’’। (মুসলিম ২৫৭১)
যে ব্যক্তি দীনের উপর যত বেশি অটল তার বিপদও ততো বেশি। এ কারণেই নবীরা বেশি বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। এরপর যে যতটুকু নবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে সে ততো বেশি বিপদের সম্মুখীন হবে।
সা’দ্ বিন্ আবী ওয়াক্কাস্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلَاءً ؟ قَالَ: الْأَنْبِيَاءُ، ثُمَّ الْأَمْثَلُ، فَالْأَمْثَلُ، فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِيْنِهِ، فَإِنْ كَانَ دِيْنُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلَاؤُهُ، وَإِنْ كَانَ فِيْ دِيْنِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِيْنِهِ، فَمَا يَبْرَحُ الْبَلَاءُ بِالْعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِيْ عَلَى الْأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيْئَةٌ.
‘‘আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মানুষের মধ্যে কারা বেশিরভাগ কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয় ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: নবীগণ অতঃপর যারা তাদের আদর্শে বেশি অনুপ্রাণিত অতঃপর যারা এর পরের অবস্থানে। সুতরাং যে কোন ব্যক্তিকে তার ধার্মিকতার ভিত্তিতেই বিপদের সম্মুখীন করা হয়। অতএব তার ধার্মিকতা যদি শক্ত হয় তার বিপদও ততো শক্ত হবে। আর যার ধার্মিকতায় দুর্বলতা রয়েছে তাকে তার ধার্মিকতা অনুযায়ীই বিপদের সম্মুখীন করা হবে। সুতরাং বিপদ বান্দাহ্’র সাথে লেগেই থাকবে। এমনকি পরিশেষে তার অবস্থা এমন হবে যে, সে দুনিয়ার বুকে বিচরণ করছে ঠিকই অথচ তার কোন গুনাহ্ই নেই’’। (তিরমিযী ২৩৯৮; ইব্নু মাজাহ্ ৪০৯৫)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَا يَزَالُ الْبَلَاءُ بِالْـمُؤْمِنِ وَالْـمُؤْمِنَةِ فِيْ نَفْسِهِ وَوَلَدِهِ وَمَالِهِ حَتَّى يَلْقَى اللهَ، وَمَا عَلَيْهِ خَطِيْئَةٌ.
‘‘মু’মিন পুরুষ ও মহিলার সাথে বিপদ লেগেই থাকবে চাই তা তার ব্যক্তি সংক্রান্ত হোক অথবা সন্তান ও সম্পদ সংক্রান্ত। এমনকি পরিশেষে অবস্থা এমন হবে যে, সে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করছে ঠিকই অথচ তার কোন গুনাহ্ই নেই’’। (তিরমিযী ২৩৯৯)
ফুযাইল্ বিন্ ’ইয়ায্ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
لَا يَبْلُغُ الْعَبْدُ حَقِيْقَةَ الْإِيَمَانِ حَتَّى يَعُدَّ الْبَلَاءَ نِعْمَةً، وَالرَّخَاءَ مُصِيْبَةً، وَحَتَّى لَا يُحِبَّ أَنْ يُحْمَدَ عَلَى عِبَادَةِ اللهِ تَعَالَى.
‘‘বান্দাহ্ কখনো ঈমানের মূলে পৌঁছুতে পারবে না যতক্ষণ না সে বিপদকে নিয়ামত এবং সচ্ছলতাকে বিপদ মনে করবে এবং যতক্ষণ না সে আল্লাহ্’র ইবাদতের উপর মানুষের প্রশংসা অপছন্দ করবে’’।
ধৈর্য যে কোন মুসলিমের স্বাভাবিক ভূষণ হওয়া উচিৎ। বিপদের সময় যেমন সে ধৈর্য ধারণ করবে তেমনিভাবে সুখের সময়ও তাকে আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের উপর ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বরং এ সময়ের ধৈর্য প্রথমোক্ত ধৈর্যের চাইতে আরো গুরুত্বপূর্ণ।
শাইখুল ইসলাম ইব্নু তাইমিয়্যাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
أَمَّا نِعْمَةُ الضَّرَّاءِ فَاحْتِيَاجُهَا إِلَى الصَّبْرِ ظَاهِرٌ، وَأَمَّا نِعْمَةُ السَّرَّاءِ فَتَحْتَاجُ إِلَى الصَّبْرِ عَلَى الطَّاعَةِ فِيْهَا، فَإِنَّ فِتْنَةَ السَّرَّاءِ أَعْظَمُ مِنْ فِتْنَةِ الضَّرَّاءِ، الْفَقْرُ يَصْلُحُ عَلَيْهِ خَلْقٌ كَثِيْرٌ، وَالْغِنَى لَا يَصْلُحُ عَلَيْهِ إِلاَّ أَقَلُّ مِنْهُمْ، وَلِـهَذَا كَانَ أَكْثَرَ مَنْ يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ الْـمَسَاكِيْنُ، لِأَنَّ فِتْنَةَ الْفَقْرِ أَهْوَنُ، وَكِلَاهُمَا يَحْتَاجُ إِلَى الصَّبْرِ وَالشُّكْرِ، لَكِنْ لَمَّا كَانَ فِيْ السَّرَّاءِ اللَّذَّةُ، وَفِيْ الضَّرَّاءِ الْأَلَمُ اشْتَهَرَ ذِكْرُ الشُّكْرِ فِيْ السَّرَّاءِ، وَالصَّبْرِ فِيْ الضَّرَّاءِ.
‘‘বিপদের সময় ধৈর্য ধরার ব্যাপারটি একেবারেই সুস্পষ্ট যা আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটি নিয়ামতও বটে। তেমনিভাবে সুখের সময়ও আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের উপর ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তাও আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটি নিয়ামত। তবে সুখের পরীক্ষা বেশি কঠিন দু:খের পরীক্ষার চাইতেও। দরিদ্রতা বেশি সংখ্যক মানুষকেই মানায় কিন্তু ধন-সম্পদ খুব অল্প সংখ্যক লোককেই মানায়। এ কারণে দরিদ্ররাই বেশির ভাগ জান্নাতী। কারণ, দরিদ্রতার পরীক্ষা অনেকটাই সহজ। তবে উভয় অবস্থায়ই ধৈর্য ও আল্লাহ্’র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু সুখে বেশির ভাগ মজা এবং দু:খে বেশির ভাগ কষ্ট থাকার দরুনই সুখের ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতার ব্যবহার বেশি এবং দু:খের ক্ষেত্রে ধৈর্য’’।
আপনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। অতএব এমনও তো হতে পারে যে, আপনি যে বস্ত্তটিকে আপনার জন্য কল্যাণকর ভাবছেন তা সত্যিই আপনার জন্য অকল্যাণকর আর আপনি যে বস্ত্তটিকে আপনার জন্য অকল্যাণকর ভাবছেন তা সত্যিই আপনার জন্য কল্যাণকর।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئًا وَّهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ، وَعَسَى أَنْ تُحِبُّـوْا شَيْئًا وَّهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ، وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ»
‘‘এমনও তো হতে পারে যে, তোমরা কোন বস্ত্তকে নিজের জন্য অপছন্দ করছো অথচ তাই হচ্ছে তোমাদের জন্য কল্যাণকর তেমনিভাবে তোমরা কোন বস্ত্তকে নিজের জন্য পছন্দ করছো; অথচ তাই হচ্ছে তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্ত্তত: আল্লাহ্ তা‘আলাই এ ব্যাপারে সঠিক জানেন আর তোমরা তা জানো না’’। (বাক্বারাহ্ : ২১৬)
বস্ত্তত: মু’মিনের জন্য সবই কল্যাণকর। তার জীবনে কোন খুশির ব্যাপার ঘটলে সে আল্লাহ্ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা আদায় করবে তখন তা তার জন্য অবশ্যই কল্যাণকর হবে। তেমনিভাবে তার জীবনে কোন দু:খের ব্যাপার ঘটলে সে তা ধৈর্যের সাথে মেনে নিবে তখনও তা তার জন্য অবশ্যই কল্যাণকর হবে।
স্বুহাইব্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
عَجَبًا لِأَمْرِ الْـمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ.
‘‘মু’মিনের ব্যাপারটি খুবই আশ্চর্যজনক। কারণ, তার সকল অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর। আর এ ব্যাপারটি একমাত্র মু’মিনের জন্য। অন্য কারোর জন্য নয়। কারণ, তার জীবনে যখন কোন খুশির সংবাদ আসে তখন সে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অতএব তা তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। তেমনিভাবে তার জীবনে যখন কোন দু:খের সংবাদ আসে তখন সে ধৈর্যের সাথে তা মেনে নেয় অতএব তাও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়’’। (মুসলিম ২৯৯৯)