হারাম ও কবিরা গুনাহ হারাম ও কবীরা গুনাহ্ পরিচিতি মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি

সুদ খাওয়া মারাত্মক অপরাধ। এ জন্যই তো আল্লাহ্ তা‘আলা সুদখোরের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। যা অন্য কোন পাপীর সাথে দেননি।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَذَرُوْا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوْا فَأْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللهِ وَرَسُوْلِهِ»

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভয় করো এবং সুদের যা অবশিষ্ট রয়েছে তা বর্জন করো যদি তোমরা মু’মিন হওয়ার দাবি করে থাকো। আর যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৮-২৭৯)

অর্থনৈতিক মন্দাভাব, ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা, অকর্মের সংখ্যাবৃদ্ধি, কোম্পানীগুলোর অধ:পতন, নিজের সকল উপার্জন ঋণ পরিশোধেই নি:শেষ হয়ে যাওয়া, দেশের বেশির ভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে সীমাবদ্ধ হওয়া তথা সমাজে উচ্চস্তরের আবির্ভাব সে যুদ্ধেরই অন্তর্গত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদের সাথে সম্পৃক্ত চার প্রকারের লোককে সমভাবে দোষী সাব্যস্ত করেন।

জাবির ও আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন:

لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ  آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ: هُمْ سَوَاءٌ.

‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নত (অভিসম্পাত) করেন সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট চার ব্যক্তিকে। তারা হচ্ছে: সুদখোর, সুদদাতা, সুদের লেখক ও সুদের সাক্ষীদ্বয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: তারা সবাই সমপর্যায়ের দোষী’’।

(মুসলিম ১৫৯৮; তিরমিযী ১২০৬; আবূ দাউদ ৩৩৩৩; ইব্নু মাজাহ্ ২৩০৭; ইব্নু হিববান ৫০২৫; আহমাদ ৬৩৫, ৬৬০, ৮৪৪, ১১২০, ১২৮৮, ১৩৬৪, ৩৭২৫, ৩৭৩৭, ৩৮০৯, ৪৩২৭, ১৪৩০২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:

الرِّبَا ثَلَاثَةٌ وَّسَبْعُوْنَ بَابًا، وَفِيْ رِوَايَةٍ: حُوْبًا، أَيْسَرُهَا مِثْلُ أَنْ يَنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ، وَإِنَّ أَرْبَى الرِّبَا عِرْضُ الرَّجُلِ الْـمُسْلِمِ.

‘‘সুদের তিয়াত্তরটি গুনাহ্ রয়েছে। তার মধ্যে সর্বনিম্ন গুনাহ্ হচ্ছে, কোন ব্যক্তির নিজ মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য গুনাহ্। আর সবচেয়ে বড় সুদ হলো, কোন মুসলিম ব্যক্তির ইয্যত হনন’’।

(ইব্নু মাজাহ্ ২৩০৪, ২৩০৫; হা’কিম : ২/৩৭ সাহীহুল্ জা’মি’, হাদীস ৩৫৩৩)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:

دِرْهَمُ رِبَا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَّثَلَاثِيْنَ زَنْيَةً.

‘‘সুদের একটি টাকা জেনেশুনে খাওয়া ছত্রিশবার ব্যভিচার চাইতেও মারাত্মক’’। (আহমাদ : ৫/২২৫ সাহীহুল্ জা’মি’, হাদীস ৩৩৭৫)

সুদের সম্পদ যত বেশিই হোক না কেন তাতে কোন বরকত নেই।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِيْ الصَّدَقَاتِ، وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ»

’’আল্লাহ্ তা‘আলা সুদে কোন বরকত দেন না। তবে তিনি দানকে অবশ্যই বাড়িয়ে দেন। বস্ত্তত: আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক কৃতঘ্ন পাপীকে ভালোবাসেন না’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৬)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيْرُ إِلَى قُلٍّ.

‘‘সুদ যদিও দেখতে বেশি দেখা যায় তার পরিণতি কিন্তু ঘাটতির দিকেই’’। (হা’কিম : ২/৩৭ সাহীহুল্ জা’মি’, হাদীস ৩৫৪২; ইব্নু মাজাহ্ ২৩০৯)

আল্লাহ্ তা‘আলা সুদখোরকে শয়তানে ধরা ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছেন। আর তা এ কারণেই যে, তারা সুদকে লাভ বলে জ্ঞান করে; অথচ ব্যাপারটি একেবারেই তার উল্টো।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لَا يَقُوْمُـوْنَ إِلاَّ كَمَا يَقُوْمُ الَّذِيْ يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْـمَسِّ، ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوْا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا، وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا»

‘‘সুদখোররা (কিয়ামতের দিন) শয়তানে ধরা ব্যক্তির ন্যায় মোহাবিষ্ট হয়ে দাঁড়াবে। আর তা এ কারণেই যে, তারা বলে: ব্যবসা তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৫)

যারা সুদখোর তারা পারতপক্ষে কখনো সুদ কম খেতে চায় না। বরং বেশি খেতে চাওয়াই তাদের সাধারণ অভ্যাস। এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের মধ্যে তাদেরকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَأْكُلُوْا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً وَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ»

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সুদ বেশি বেশি খেয়ো না। বরং তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভয় করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’’।

(আ’লি ’ইমরান : ১৩০)

তবে গুনাহ্টি যত বড়ই হোক না কেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাহ্কে নিজ দয়ায় তা থেকে তাওবা করার পদ্ধতিও শিক্ষা দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«فَمَنْ جَآءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ، وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ، وَمَنْ عَادَ فَأُوْلَآئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ، هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ»

‘‘অতঃপর যার নিকট নিজ প্রভুর পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে। ফলে সে তা ছেড়ে দিয়েছে। তা হলে যা ইতিপূর্বে হয়ে গেছে তাতে কোন অসুবিধে নেই এবং তার ব্যাপারটি একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার নিকটেই সোপর্দ। (যদি সে নিজ তাওবার উপর অটল ও অবিচল থাকে তা হলে আল্লাহ্ তা‘আলা অবশ্যই তার পুণ্যকে বিনষ্ট করবেন না)। আর যারা আবারো সুদ খেতে শুরু করলো তারা হচ্ছে জাহান্নামী। যেখানে তারা সদা সর্বদা থাকবে’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৫)

আল্লাহ্ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন:

«وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوْسُ أَمْوَالِكُمْ، لَا تَظْلِمُوْنَ وَلَا تُظْلَمُوْنَ، وَإِنْ كَانَ ذُوْ عُسْرَةٍ فَنَظِرَةٌ إِلَى مَيْسَرَةٍ، وَأَنْ تَصَدَّقُوْا خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ»

‘‘আর যদি তোমরা সুদ খাওয়া থেকে তাওবা করে নাও তা হলে তোমাদের জন্য রয়েছে শুধু তোমাদের মূলধনটুকু। তোমরা কারোর উপর অত্যাচার করবে না এবং তেমনিভাবে তোমাদের উপরও কোন অত্যাচার করা হবে না। আর যদি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি খুব অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে তার স্বচ্ছলতার প্রতীক্ষা করো। আর যদি তোমরা তোমাদের মূলধনটুকুও দরিদ্র ঋণগ্রস্তদেরকে দান করে দাও তা হলে তা হবে তোমাদের জন্য আরো কল্যাণকর। যদি তোমরা তা জানো বা বুঝে থাকো তা হলে তা অতিসত্বর বাস্তবায়ন করো’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৯-২৮০)

সুদ খাওয়া, খাওয়ানো, লেখা ও সে ব্যাপারে সাক্ষী দেয়া যেমন হারাম অথবা কবীরা গুনাহ্ তেমনিভাবে সুদী ব্যাংকে টাকা রাখা, পাহারাদারি করা অথবা সুদী ব্যাংকের সাথে যে কোন ধরনের লেনদেন করাও শরীয়ত বিরোধী কাজ তথা অবৈধ।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«تَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى، وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ، وَاتَّقُوْا اللهَ، إِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ»

‘‘তোমরা নেক কাজ ও আল্লাহ্ভীরুতায় পরস্পরকে সহযোগিতা করো। তবে পাপাচার ও অত্যাচার করতে কাউকে সহযোগিতা করো না। আল্লাহ্কে ভয় করো। নিশ্চয়ই তিনি কঠিন শাস্তিদাতা’’। (মা’য়িদাহ্ : ২)

তবে যারা নিতান্ত অসুবিধায় পড়ে (চুরি অথবা আত্মসাৎ ইত্যাদির ভয়ে) মন্দের ভালো ইসলামী ব্যাংক কাছে না পেয়ে সুদী ব্যাংকে টাকা রেখেছেন তাদেরকে সদা সর্বদা নিজ অপারগতার কথা মনে রাখতে হবে। ভাবতে হবে, আমি যেন অপারগতার কারণে মৃত পশু খাচ্ছি। আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট এ জন্য সদা সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বিকল্প ব্যবস্থার জন্য অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। ব্যাংক থেকে সুদ উঠিয়ে তা জনকল্যাণমূলক জায়িয কাজে খরচ করে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তা ব্যয় করার সময় কখনো সাদাকার নিয়্যাত করবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র এবং তিনি একমাত্র পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করে থাকেন। আর সুদ হচ্ছে অপবিত্র। সুতরাং তিনি তা কখনোই গ্রহণ করবেন না। সুদের টাকা খাদ্য, পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদির খাতে অথবা স্ত্রী-পুত্র এবং মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ তথা ওয়াজিব খরচায় ব্যয় করা যাবে না। তেমনিভাবে যাকাত আদায়, ট্যাক্স পরিশোধ, নিজকে যালিমের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও ব্যয় করা যাবে না। কারণ, এ সবগুলো প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সুদ খাওয়ারই শামিল।