৫১. গুনাহ্’র মাধ্যমে গুনাহ্গার নিজেই নিজের ধ্বংসের জন্য সমূহ পথ খুলে দেয়। তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ, শরীর সুস্থ থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন যা তার শক্তি আনয়ন করে, শরীর থেকে ময়লা নিষ্কাশনের প্রয়োজন যা বেড়ে গেলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং সতর্কতা অবলম্বনেরও প্রয়োজন যাতে এমন কিছু শরীর গ্রহণ না করে যাতে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তেমনিভাবে অন্তরকে সুস্থ ও সজীব রাখার জন্য ঈমান ও নেক আমলের প্রয়োজন যা তার শক্তি বর্ধন করবে, তাওবার মাধ্যমে গুনাহ্’র ময়লাগুলো পরিষ্কার করা প্রয়োজন যাতে অন্তর অসুস্থ হয়ে না পড়ে এবং বিশেষ সতর্কতারও প্রয়োজন যাতে তাকে এমন কিছু আক্রমণ করতে না পারে যা তার ধ্বংসের কারণ হয়। আর গুনাহ্ তো উক্ত বস্ত্তত্রয়ের সম্পূর্ণই বিপরীত। অতএব তার ধ্বংস আসবে না কেন?
গুনাহ্’র উক্ত অপকারগুলো যদি গুনাহ্গারের জন্য গুনাহ্ ছাড়ার ব্যাপারে সহযোগী না হয় তা হলে অবশ্যই তাকে গুনাহ্’র শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত দুনিয়ার শারীরিক শাস্তিগুলোর কথা ভাবতে হবে। যদিও ইসলামী আইন অনুযায়ী অনেক দেশেই বিচার হচ্ছে না তবুও গুনাহ্গারকে এ কথা অবশ্যই ভাবতে হবে যে, আমি এ গুলো থেকে বেঁচে গেলেও সে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত তো আমি থেকেই যাচ্ছি এবং আখিরাতের শাস্তি থেকে তো কখনোই নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়।
শরীয়তের শাস্তিগুলো হচ্ছে চুরিতে হাত কাটা, ছিনতাই বা হাইজাক করলে হাত-পা উভয়টিই কেটে ফেলা, নেশাকর বস্ত্ত সেবন করলে অথবা কোন সতী মহিলাকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলে বেত্রাঘাত করা, বিবাহিত পুরুষ ও মহিলা ব্যভিচার করলে তাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করা, অবিবাহিত হলে একশ’টি বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর, কুফরি কোন কথা বা কাজ করলে, ইচ্ছাকৃত ফরয নামায ছেড়ে দিলে, সমকাম করলে এবং কোন পশুর সাথে যৌন সঙ্গম করলে হত্যা করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
গুনাহ্গারকে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, গুনাহ্’র শাস্তি কিছু রয়েছে নির্ধারিত যা উপরে বলা হয়েছে। আর কিছু রয়েছে অনির্ধারিত যা গুনাহ্গারকে এমনকি পুরো জাতিকেও কখনো কখনো ভুগতে হতে পারে এবং তা যে কোন পর্যায়েরই হতে পারে। শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, ইহলৌকিক, পারলৌকিক, ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সরাসরি অথবা পরোক্ষ। শাস্তির ব্যাপকতা গুনাহ্’র ব্যাপ্তির উপরই নির্ভরশীল। তবে কেউ শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি থেকে কোনভাবে বেঁচে গেলেও অন্য শাস্তি থেকে সে অবশ্যই বাঁচতে পারবে না।
কিছু কিছু গুনাহে শারীরিক শাস্তি না থাকলেও তাতে অর্থনৈতিক দন্ড অবশ্যই রয়েছে। যেমন: ইহ্রামরত ও রমযানের রোযা থাকাবস্থায় স্ত্রী সহবাস, ভুলবশত হত্যা, শপথভঙ্গ ইত্যাদি।
এ ছাড়া সামাজিক পর্যায়ের কোন পাপ বন্ধ করার জন্য চাই তা যতই ছোট হোক না কেন প্রশাসক বা বিচারক অপরাধীকে যে কোন শাস্তি দিতে পারেন। তবে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোন ব্যাপারে শরীয়ত নির্ধারিত কোন শারীরিক দন্ড বিধি থাকলে তা প্রয়োগ না করে অথবা তা প্রয়োগের পাশাপাশি বিচারকের খেয়ালখুশি মতো অপরাধীর উপর অন্য কোন দন্ড প্রয়োগ করা যাবে না। যা বর্তমান গ্রাম্য বিচারাচারে বিচারক কর্তৃক প্রয়োগ হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, শরীয়ত নির্ধারিত কোন দন্ড বিধি গ্রাম্য বিচারে প্রয়োগ করা যাবে না। বরং তা একমাত্র প্রশাসক বা তাঁর পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত ব্যক্তিই প্রয়োগ করার অধিকার রাখে।
গুনাহ্’র শারীরিক শাস্তি ছাড়াও যে শাস্তিগুলো রয়েছে তম্মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্যতম:
ক. গুনাহ্গারের অন্তর ও শ্রবণ শক্তির উপর মোহর মেরে দেয়া, তার অন্তরকে আল্লাহ্ তা‘আলার স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয়া, তাকে নিজ স্বার্থের কথাও ভুলিয়ে দেয়া, আল্লাহ্ তা‘আলা তার অন্তরকে পঙ্কিলতামুক্ত করতে না চাওয়া, অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেয়া, সত্য থেকে বিমুখ করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
খ. আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্য করা থেকে বিমুখ হওয়া।
গ. গুনাহ্গারের অন্তরকে মূক, বধির ও অন্ধ করে দেয়া। তখন সে সত্য বলতে পারে না এবং তা শুনতে ও দেখতে পায় না।
ঘ. গুনাহ্গারের অন্তরকে নিম্নগামী করে দেয়া। যাতে সে সর্বদা ময়লা ও পঙ্কিলতা নিয়েই ভাবতে থাকে।
ঙ. কল্যাণকর কথা, কাজ ও চরিত্র থেকে দূরে থাকা।
চ. গুনাহ্গারের অন্তরকে পশুর অন্তরে রূপান্তরিত করা। তখন কারো কারোর অন্তর রূপ নেয় শুকর, কুকুর, গাধা ও সাপ-বিচ্ছুর। আবার কারো কারোর অন্তর রূপ নেয় আক্রমণাত্মক পশু, ময়ূর, মোরগ, কবুতর, উট, নেকড়ে বাঘ ও খরগোশের।
ছ. গুনাহ্গারের অন্তরকে সম্পূর্ণরূপে উল্টো করে দেয়া। তখন সে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য, ভালোকে খারাপ এবং খারাপকে ভালো, সংশোধনকে ফাসাদ এবং ফাসাদকে সংশোধন, ভ্রষ্টতাকে হিদায়াত এবং হিদায়াতকে ভ্রষ্টতা, আনুগত্যকে অবাধ্যতা এবং অবাধ্যতাকে আনুগত্য আল্লাহ্’র রাস্তায় বাধা সৃষ্টিকে আহবান এবং আহবানকে বাধা সৃষ্টি মনে করে থাকে।
জ. বান্দাহ্ ও তার প্রভুর মাঝে দুনিয়া ও আখিরাতে আড়াল সৃষ্টি করা।
ঝ. দুনিয়া ও কবরে তার জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়া এবং আখিরাতে শাস্তি ভোগ করা।
গুনাহ্’র পর্যায় ও ফাসাদের ব্যাপকতা এবং সংকীর্ণতার তারতম্যের দরুনই শাস্তির তারতম্য হয়ে থাকে। তাই গুনাহ্’র ধরন ও প্রকারগুলো আমাদের জানা উচিৎ যা নিম্নরূপ:
প্রথমত: গুনাহ্ দু’ প্রকার: আদিষ্ট কাজ না করা এবং নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদন করা। এ গুলোর সম্পর্ক কখনো শরীরের সাথে আবার কখনো অন্তরের সাথে হয়ে থাকে। আবার কখনো আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকারের সাথে আবার কখনো বান্দাহ্’র অধিকারের সাথে।
অন্য দৃষ্টিকোনে গুনাহ্কে আবার চার ভাগেও বিভক্ত করা যায় যা নিম্নরূপ:
ক. প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব সংক্রান্ত গুনাহ্ তথা যা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য মানায় তা নিজের মধ্যে স্থান দেয়া। যেমন: মহিমা, গর্ব, পরাক্রম, কঠোরতা ও মানুষকে পদানত করা ইত্যাদি। এরই সাথে শির্ক সংশ্লিষ্ট।
খ. ইবলীসি বা শয়তানী গুনাহ্। যেমন: হিংসা, দ্রোহ, ধোঁকা, বিদ্বেষ, বৈরিতা, ষড়যন্ত্র, কূটকৌশল, অন্যকে গুনাহ্’র পরামর্শ দেয়া বা গুনাহ্’র আদেশ করা এবং গুনাহ্কে তার সম্মুখে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা, আল্লাহ্’র আনুগত্য করতে নিষেধ করা বা কোন ইবাদাত অন্যকে নিকৃষ্টভাবে দেখানো, বিদ্‘আত করা বা ইসলামে নব উদ্ভাবন এবং বিদ্‘আত ও পথভ্রষ্টতার দিকে মানুষকে আহবান করা ইত্যাদি।
গ. বাঘ ও সিংহ প্রকৃতির গুনাহ্। যেমন: অত্যাচার, রাগ, অন্যের রক্ত প্রবাহিত করা, দুর্বল ও অক্ষমের উপর চড়াও হওয়া এবং মানুষকে অযথা কষ্ট দেয়া ইত্যাদি।
ঘ. সাধারণ পশু প্রকৃতির গুনাহ্। যেমন: অত্যধিক লোভ, পেট ও লজ্জাস্থানের চাহিদা পূরণে উঠেপড়ে লাগা, ব্যভিচার, চুরি, কৃপণতা, কাপুরুষতা, অস্থিরতা, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি।
অধিকাংশ মানুষ এ জাতীয় গুনাহে বেশি লিপ্ত হয় এবং এটাই গুনাহ্’র প্রথম সোপান। কারণ, দুর্বল মানুষের সংখ্যাইতো দুনিয়াতে অনেক বেশি।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে সমূহ নেক কাজ করা ও সমূহ গুনাহ্ থেকে uঁবচে থাকার তাওফীক দান করুন।
আ-মিন ইয়া রাববাল্ আ-লামীন!