‘জিহাদ’ অর্থ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, পরিশ্রম বা কষ্ট। নিয়মিত পরিপূর্ণ ওযূ, জামাতে সালাত, হজ্জ, আল্লাহর আনুগত্য-মূলক বা আত্মশুদ্ধি-মূলক কর্ম, হক্কের দাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতকে হাদীস শরীফে ‘‘জিহাদ’’ বা ‘‘শ্রেষ্ঠতম জিহাদ’’ বলা হয়েছে। তবে ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘‘মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ।’’ এ যুদ্ধেরই নাম কিতাল। পারিভাষিক ভাবে জিহাদ ও কিতাল একই বিষয়।[1]

জিহাদের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদ কুরবানি দেওয়া অত্যন্ত বড় ত্যাগ। এজন্য এ ইবাদতের পুরস্কারও অভাবনীয়। কুরআন ও হাদীসে জিহাদের অফুরন্ত পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে এবং এ ইবাদত পালনের জন্য বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের অর্থ জিহাদ যখন বৈধ বা জরুরী হবে তখন যে ব্যক্তি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে জিহাদের দায়িত্ব পালন করবে তখন সে এ পুরস্কার লাভ করবে।

জিহাদের আগ্রহ মুমিনের হৃদয়ে থাকবে। জিহাদের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদের কুরবানীর প্রতি অনীহা ঈমানী দুর্বলতার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ ، وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ


‘‘যদি কেউ এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে যyুদ্ধ অংশগ্রহণ করে নি এবং যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণের কোনো কথাও নিজের মনকে কখনো বলে নি, তবে সে ব্যক্তি মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করবে।’’[2]

আমরা দেখব যে, সাধারণভাবে জিহাদ ফরয কিফায়া এবং কখনো কখনো ফরয আইন। ফরয কিফায়া অবস্থায় যদি সকল মুসলিম তা পরিত্যাগ করে এবং ফরয আইন অবস্থায় যদি মুসলিমগণ তা পরিত্যাগ করে তবে তা তাদের জাগতিক লাঞ্ছনা বয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ، وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ، وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ، وَتَرَكْتُمْ الْجِهَادَ، سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ذُلا لا يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ


‘‘যখন তোমরা অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত হবে, গবাদিপশুর লেজ ধারণ করবে, চাষাবাদেই তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন, দীনে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যা তিনি অপসারণ করবেন না।’’[3]

এ সকল ফযীলত ও নির্দেশনা বিষয়ক আয়াত ও হাদীসকে নিজেদের আবেগ অনুসারে ব্যাখ্যা করে খারিজীগণ জিহাদকে ফরয আইন বলে দাবি করেন। তারা ন্যায়ের আদেশ-অন্যায়ের নিষেধ এবং জিহাদের মধ্যে পার্থক্য করেন না। এমনকি তারা জিহাদকে ইসলামের ষষ্ঠ রুকন বা বড় ফরয বলে গণ্য করেন। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ, দীন প্রতিষ্ঠা বা জিহাদের নামে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে আইন হাতে তুলে নিয়েছেন বা সশস্ত্র প্রতিরোধ, আক্রমণ, হত্যা ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হয়েছেন।[4]

তাদের বিপরীতে শীয়াগণ ‘‘মাসূম (নিষ্পাপ) ইমাম-এর নেতৃত্ব ছাড়া জিহাদ হবে না’’ বলে দাবি করেন। তাদের বিশ্বাসে দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মাদ আল-মাহদী (২৫৬-২৭৫ হি) ২৭৫ হিজরী সাল থেকে অদৃশ্য জগতে লুকিয়ে রয়েছেন। তিনিই ইমাম মাহদী হিসেবে আবির্ভূত হবেন। তাঁর আবির্ভাবের পরে তাঁর নেতৃত্বে জিহাদ করতে হবে।[5]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত জিহাদকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সামষ্টিক ফরয বা ফরয কিফায়া বলে গণ্য করেছেন। ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে আদায় করতে পারেন। কিন্তু জিহাদ অবশ্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে হবে। খারিজী ও শীয়া মতের সাথে তাদের মৌলিক তিনটি পার্থক্য রয়েছে: (১) জিহাদ ফরয কিফায়া ইবাদত, (২) জিহাদের জন্য রাষ্টপ্রধানের নেতৃত্ব জরুরী এবং (৩) রাষ্ট্রপ্রধানের মুত্তাকী বা নেককার হওয়া জরুরী নয়। আমরা তৃতীয় বিষয়টি ইতোপূর্বে জেনেছি। এখানে অন্য দুটি বিষয় পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ,পৃ. ১০৫-১০৬।

[2] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫১৭।

[3] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৩/২৭৪; আলবানী, সাহীহাহ ১/১৫। হাদীসটি সহীহ।

[4] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ,পৃ. ৬১-৮৪।

[5] ইবন আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৫৮; আব্দুল আযীয রাজিহী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৯০।