আল-ফিকহুল আকবর মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
১৪. আল্লাহর সৃষ্টি, ইলম, তাকদীর ও পাপ-পুণ্য

আল্লাহর বিশেষণের বিষয়ে বৈপরীত্য কল্পনার একটি দিক তাকদীর। কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা আল্লাহর অনাদি-অনন্ত, সর্বব্যাপী জ্ঞানের কথা, তাঁর ক্ষমতা ও ইচ্ছার কথা জানতে পারি এবং পাশাপাশি আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার ও করুণার কথা জানতে পারি। অনেকে এ দু বিশেষণের মধ্যে বৈপরীত্য কল্পনা করেছেন।

প্রথম বিশেষণের মাধ্যমে আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ অনাদিকাল থেকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কে, কখন, কিভাবে কি কর্ম করবে তা সবই জানেন। আমরা কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে জানি যে, মহান আল্লাহ তাঁর এ জ্ঞান লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। আমরা আরো জানি যে, মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ন্যূনতম দাবি যে, তাঁর জ্ঞানের অগোচরে ও ইচ্ছার বাইরে পৃথিবীতে কিছুই ঘটতে পারবে না। এ থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তাহলে মানুষ যা কিছু করে তা আল্লাহর নির্দেশেই করে, কাজেই মানুষের কর্মের জন্য তাকে অপরাধী বলে গণ্য করা যায় না। এরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা ও কর্মফল বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বাতিল করেন। অপরদিকে কেউ কেউ মনে করেন যে, আল্লাহর জ্ঞান, লিখন ও ইচ্ছার এ সকল বিষয় তাঁর ন্যায়পরায়ণতার বিশেষণের সাথে সাংঘর্ষিক। কাজেই ন্যায়পরায়ণতার বিশেষণ গ্রহণ করে অন্যান্য বিশেষণ ব্যাখ্যা করে বাতিল করতে হবে।

আসলে এ সবই আল্লাহর বিশেষণকে মানুষের বিশেষণের সাথে তুলনা করার ফল। আল্লাহর ক্ষেত্রে তাঁর সর্বব্যাপী জ্ঞান, লিখনি ও ইচ্ছার সাথে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, ও ন্যায়বিচারের কোনোরূপ বৈপরীত্য নেই। মুমিন সরল ও সহজ অর্থে উভয় প্রকারের বিশেষণ বিশ্বাস করবেন। সমন্বয়ের জন্য এ বিষয়ক মূলনীতি অনুসরণ করবেন। কোনোভাবেই একটি প্রমাণ করার জন্য অন্যটি ব্যাখ্যা করে বাতিল করবেন না।

তাকদীরে বিশ্বাস ইতোপূর্বে আরকানুল ঈমানের ব্যাখ্যার সময় আলোচনা করেছি। ইমাম আবূ হানীফার সময়ে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত দলগুলো ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়াতো। কাদারিয়াগণ ও মুতাযিলাগণ তাকদীর সম্পূর্ণ অস্বীকার করত। অপরদিকে জাবারিয়াগণ মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা সম্পূর্ণ অস্বীকার করত। এজন্য ইমাম এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ পরিচ্ছেদের শুরুতে উদ্ধৃত বক্তব্যে তিনি বলেছেন:

‘‘মহান আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন। সকল কিছু সৃষ্টির আগেই অনাদিকাল থেকে তিনি এগুলোর বিষয়ে অবগত ছিলেন। সকল কিছুই তিনি নির্ধারণ করেছেন এবং বিধান দিয়েছেন। দুনিয়ায় ও আখিরাতে কোনো কিছুই তাঁর ইচ্ছা, জ্ঞান, বিধান, নির্ধারণ ও লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ-করণ ছাড়া ঘটে না। তাঁর লিখনি বর্ণনামূলক, নির্দেশমূলক নয়। বিধান প্রদান, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি বিশেষণ, কোনো স্বরূপ, কিরূপ বা কিভাবে অনুসন্ধান ছাড়া। সিদ্ধান্ত, নির্ধারণ ও ইচ্ছা তাঁর অনাদি-অনন্ত বিশেষণ কোনো স্বরূপ জিজ্ঞাসা ছাড়া। মহান আল্লাহ অস্তিত্বহীন বিষয়কে অস্তিত্বহীন অবস্থায় অস্তিত্বহীন হিসেবে জানেন, এবং তিনি জানেন যে, তিনি তাকে অস্তিত্ব দিলে তা কিরূপ হবে। আল্লাহ অস্তিত্বশীল বিষয়কে তার অস্তিত্বশীল অবস্থায় জানেন এবং তিনি জানেন যে, তা কিভাবে বিলোপ লাভ করবে। আল্লাহ দন্ডায়মানকে দন্ডায়মান অবস্থায় দন্ডায়মান রূপে জানেন। এবং যখন সে উপবিষ্ট হয় তখন তিনি তাঁকে উপবিষ্ট অবস্থায় উপবিষ্ট জানেন। এরূপ জানায় তাঁর জ্ঞানের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না বা তাঁর জ্ঞানভান্ডারে কোনো নতুনত্ব সংযোজিত হয় না। পরিবর্তন ও নতুনত্ব সবই সৃষ্টজীবদের অবস্থার মধ্যে।

মহান আল্লাহ সৃষ্টজগত সৃষ্টি করেছেন ঈমান ও কুফর থেকে বিমুক্ত অবস্থায়। অতঃপর তিনি তাদেরকে সম্বোধন করেছেন এবং আদেশ ও নিষেধ প্রদান করেছেন। যে ব্যক্তি কুফরী করেছে সে নিজের কর্ম দ্বারা, অস্বীকার করে, সত্যকে অমান্য করে এবং আল্লাহর সাহায্য, রহমত ও তাওফীক থেকে বঞ্চিত হয়ে কুফরী করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে সে তার কর্ম দ্বারা, স্বীকৃতি দ্বারা, সত্য বলে ঘোষণা করে এবং আল্লাহর তাওফীক ও সাহায্য লাভের মাধ্যমে ঈমান এনেছে। তিনি আদমের পিঠ থেকে তাঁর বংশধরদেরকে পরমাণুর আকৃতিতে বের করে তাদেরকে বোধশক্তি প্রদান করেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করেন ‘‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলে: হ্যাঁ’’। তিনি তাদেরকে ঈমানের নির্দেশ দেন এবং কুফর থেকে নিষেধ করেন। তারা তাঁর রুবূবিয়্যাতের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছিল তাদের পক্ষ থেকে ঈমান। আদম সন্তানগণ এই ফিতরাতের উপরেই জন্মলাভ করে। এরপর যে কুফরী করে সে নিজেকে পরিবর্তন ও বিকৃত করে। আর যে ঈমান আনে এবং সত্যতার ঘোষণা দেয় সে তার সহজাত ঈমানের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকে।

তিনি তাঁর সৃষ্টির কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করেন নি এবং ঈমান আনতেও বাধ্য করেন নি। তিনি কাউকে মুমিন রূপে বা কাফির রূপে সৃষ্টি করেন নি। তিনি তাদেরকে ব্যক্তি রূপে সৃষ্টি করেছেন। ঈমান ও কুফর বান্দাদের কর্ম। কাফিরকে আল্লাহ তার কুফরী অবস্থায় কাফির হিসেবেই জানেন। যখন সে এরপর ঈমান আনয়ন করে তখন আল্লাহ তাকে তার ঈমানের অবস্থায় মুমিন হিসেবে জানেন এবং ভালবাসেন। আর এতে আল্লাহর জ্ঞান ও বিশেষণে কোনো পরিবর্তন হয় না।

বান্দাদের সকল কর্ম ও নিষ্কর্মতা- অবস্থান ও সঞ্চলন সবই প্রকৃত অর্থেই তাদের উপার্জন, আল্লাহ তা‘আলা সে সবের স্রষ্টা। এ সবই তাঁর ইচ্ছায়, জ্ঞানে, ফয়সালায় ও নির্ধারণে। আল্লাহর আনুগত্যের সকল কর্ম আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জরুরী এবং তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি, জ্ঞান, ইচ্ছা, ফয়সালা ও নির্ধারণ অনুসারে। সকল পাপকর্ম আল্লাহর জ্ঞান, ফয়সালা, নির্ধারণ ও ইচ্ছার মধ্যে সংঘটিত, তবে তা আল্লাহর মহববত, সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে সংঘটিত নয়।’’

এখানে মূল বিষয় বান্দার নিজের দায়িত্ব অনুভব করা। মহান আল্লাহ বলেছেন, বান্দা তুমি কর্ম কর, আমি কখনোই কারো কর্মফল নষ্ট করব না বা কারো উপর জুলুম করব না। আবার তিনি বলেছেন, বান্দা আমি জানি তুমি কি করবে, আমি ইচ্ছা করলে তোমার কর্ম পরিবর্তন করতে পারি এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুমি যেতে পার না। এখন বান্দার সামনে দুটি বিকল্প: একজন বান্দা জানে যে আল্লাহ সবই জানেন এবং তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না, সে এও জানে যে আল্লাহ তাকে কর্ম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন তার মনে নানান প্রশ্ন। আল্লাহর ইলমে কী আছে আমার বিষয়ে? আল্লাহ যখন সবই জানেন তাহলে আর কষ্ট করে কী লাভ? আল্লাহ কাজ করতে বলেছেন বটে, তবে তাতে কী লাভ হবে? এভাবে বান্দা আল্লাহর জ্ঞান ও কর্মের হিসাব গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে। এ বান্দা মূলত আল্লাহর নিদের্শেও বিশ্বাস করে নি এবং আল্লাহর ওয়াদাতেও বিশ্বাস করে নি। সে নিজেকে আল্লাহর কাজের হিসাব গ্রহণকারী বলে মনে করেছে। নিঃসন্দেহে সে ধ্বংসগ্রস্ত।

অন্য একজন বান্দা জানে যে, আল্লাহ সবই জানেন এবং তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না, সে এও জানে যে আল্লাহ তাকে কর্ম করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে জানে আল্লাহর মহান জ্ঞান ও ইচ্ছার প্রকৃতি অনুধাবন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমার দায়িত্বও নয়। আমি আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছায় বিশ্বাস করি এবং আল্লাহর ওয়াদা ও দয়ায় বিশ্বাস করি। আমি আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি এবং আল্লাহর সাহায্য ও দয়া চাইতে থাকি। নিঃসন্দেহে এ বান্দা সফলতার পথ পেয়েছে।

এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:


وَأَصْلُ الْقَدَرِ سِرُّ اللَّهِ تَعَالَى فِي خَلْقِهِ، لَمْ يَطَّلِعْ عَلَى ذَلِكَ مَلَكٌ مُقَرَّبٌ، وَلا نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، وَالتَّعَمُّقُ وَالنَّظَرُ فِي ذَلِكَ ذَرِيعَةُ الْخِذْلانِ، وَسُلَّمُ الْحِرْمَانِ، وَدَرَجَةُ الطُّغْيَانِ، فَالْحَذَرَ كُلَّ الْحَذَرِ مِنْ ذَلِكَ نَظَرًا وَفِكْرًا وَوَسْوَسَةً، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى طَوَى عِلْمَ الْقَدَرِ عَنْ أَنَامِهِ، وَنَهَاهُمْ عَنْ مَرَامِهِ، كَمَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى فِي كِتَابِهِ (لاَ يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ)، فَمَنْ سَأَلَ: لِمَ فَعَلَ؟ فَقَدْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ، وَمَنْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ كَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ.


‘‘মূল তাকদীর সৃষ্টিজগতে আল্লাহ্ তা’আলার এক রহস্য। এ সম্পর্কে আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত কোনো ফিরিশতাও অবগত নন, কোনো নবী রাসূলও অবগত নন। এ বিষয়ে গভীরভাবে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করা বা চিন্তা ভাবনা করার পরিণতি ব্যর্থতা, বঞ্চনা ও সীমালংঘন ব্যতীত আর কিছুই নয়। কাজেই, এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা ও কুমন্ত্রণা হতে পূর্ণ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ স্বয়ং তাকদীরের জ্ঞান তাঁর সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন এবং তাদেরকে এর তত্ত্ব উদঘাটনের প্রচেষ্টা চালানো থেকে বারণ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পবিত্র কিতাবে বলেন: ‘‘তিনি যা করেন সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না বরং তারাই আপন কৃতকর্মের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে।’’[1] সুতরাং যে ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ‘তিনি কেন এ কাজ করলেন?’ সে আসলে আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করলো। আর যে ব্যক্তি কিতাবের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে সে কাফিরদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যায়।’’[2]

ইমাম তাহাবী আরো বলেন;


فَوَيْلٌ لِمَنْ صَارَ لِلَّهِ تَعَالَى فِي الْقَدَرِ خَصِيمًا، وَأَحْضَرَ لِلنَّظَرِ فِيهِ قَلْبًا سَقِيمًا، لَقَدِ الْتَمَسَ بِوَهَمِهِ فِي فَحْصِ الْغَيْبِ سِرًّا كَتِيمًا، وَعَادَ بِمَا قَالَ فِيهِ أَفَّاكًا أَثِيمًا.


‘‘অতএব, এমন লোকের ধ্বংস অবধারিত যে তাকদীরের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে বিরোধে লিপ্ত হয় এবং বিকারগ্রস্ত হৃদয় নিয়ে এতে চিন্তা ভাবনায় প্রবৃত্ত হয়। নিশ্চয়ই সে নিজ ধারণার বশবর্তী হয়ে অদৃশ্য জগতের একটি গুপ্ত রহস্যের অনুসন্ধানে সচেষ্ট হলো এবং এ বিষয়ে অসঙ্গত অবাস্তব কথা বলে সে নিজেকে মিথ্যুক ও পাপিষ্ঠে পরিণত করলো।’’[3]

এ গ্রন্থের পরবর্তী কোনো কোনো অনুচ্ছেদে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাকদীর বিষয়ক আরো কিছু প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন।

[1] সূরা আম্বিয়া: ২৩ আয়াত।

[2] তাহাবী, আল-আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১১-১২।

[3] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।