আল-ফিকহুল আকবর মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেছেন: ‘‘তিনি অনাদি কাল থেকে অনন্ত কাল বিদ্যমান তাঁর নামসমূহ এবং তাঁর যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাতসমূহ (বিশেষণসমূহ)-সহ। তাঁর সত্তীয় বিশেষণসমূহ: হায়াত (জীবন), কুদরাত (ক্ষমতা), ইলম (জ্ঞান), কালাম (কথা), সাম’ (শ্রবণ), বাসার (দর্শন) ও ইরাদা (ইচ্ছা)। আর তাঁর ফি’লী সিফাতসমূহের মধ্যে রয়েছে: সৃষ্টি করা, রিয্ক প্রদান করা, নবসৃষ্টি করা, উদ্ভাবন করা, তৈরি করা এবং অন্যান্য কর্মমূলক সিফাত বা বিশেষণ।’’

কুরআন-হাদীসে বর্ণিত মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহ হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পরবর্তী আলিমগণ বিভিন্নভাবে এগুলোকে ভাগ করেছেন। আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ এগুলোকে দু ভাগে ভাগ করেছেন: ‘যাতী’ ও ‘ফি’লী’। আধুনিক গবেষকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফাই সর্বপ্রথম এ শ্রেণী বিন্যাস করেন।[1]

‘যাত’ (الذات) শব্দটির অর্থ self: সত্তা, স্বকীয় ব্যক্তিত্ব, অহং ইত্যাদি। ‘যাতী সিফাত’ অর্থ সত্তীয় বিশেষণ। মহান আল্লাহর যে সকল সিফাত বা বিশেষণ তাঁর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে ও চিরন্তনরূপে বিদ্যমান সেগুলিকে যাতী সিফাত বা সত্তাগত বিশেষণ (Attributes of essence) বলা হয়। ‘ফি’ল (الفعل) শব্দটির অর্থ ক্রিয়া বা কর্ম (action, work, performance, doing)। ফি’লী সিফাত অর্থ কর্মীয় বিশেষণ বা কর্মগত বিশেষণ। মহান আল্লাহর যে সকল সিফাত বা বিশেষণ তাঁর ইচ্ছায় কর্মে পরিণত হয় সেগুলি ফি’লী সিফাত বা কর্মগত বিশেষণ।[2]

ইমাম আযম এখানে ৭টি যাতী সিফাত উল্লেখ করেছেন: (১) হায়াত (জীবন), (২) কুদরাত (ক্ষমতা), (৩) ইলম (জ্ঞান), (৪) কালাম (কথা), (৫) সাম’ (শ্রবণ), (৬) বাসার (দর্শন) ও (৭) ইরাদা (ইচ্ছা)। আমরা দেখব যে, তিনি তাঁর ‘আল- ফিকহুল আকবার’ ও ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ গ্রন্থে অন্যান্য যে সকল যাতী সিফাত উল্লেখ করেছেন সেগুলির মধ্যে রয়েছে: (৮) উলুও (العلو) অর্থাৎ ঊর্ধ্বত্ব বা উর্দ্ধে অবস্থান, (৯) ইয়াদ (اليد): হস্ত, (১০) আল-ওয়াজহ (الوجه): মুখমণ্ডল ও (১১) নাফস (النفس): সত্তা।

ইমাম আযম এখানে ৫টি ফি’লী সিফাত উল্লেখ করেছেন: (১) সৃষ্টি করা, (২) রিয্ক প্রদান করা, (৩) নবসৃষ্টি করা, (৪) উদ্ভাবন করা ও (৫) তৈরি করা। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, তিনি তাঁর বিভিন্ন বইয়ে আরো যে সকল ফি’লী সিফাত উল্লেখ করেছেন সেগুলির মধ্যে রয়েছে: (৬) ইসতিওয়া (الاستواء) বা আরশের উপর অধিষ্ঠিত হওয়া, (৭) নুযূল (النزول) বা অবতরণ করা, (৮) গাদাব (الغضب) বা ক্রোধ, (৯) রিদা (الرضا) সন্তুষ্টি, (১০) মহববত (المحبة) ভালবাসা, ইত্যাদি। পরবর্তীতে আমরা এ সকল সিফাত বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

আমরা সহজেই যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) বিশেষণের পার্থক্য বুঝতে পারি। কর্মীয় বিশেষণগুলো মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যখন ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, রিযক দেন, আরশে অধিষ্ঠিত হন, অবতরণ করেন, ক্রোধান্বিত হন, সন্তুষ্ট হন বা ভালবাসেন। এগুলো বিশেষণ হিসেবে অনাদি ও চিরন্তন, কিন্তু তাঁর ইচ্ছায় কর্মে পরিণত হয় নতুনভাবে। এগুলো তাঁর পবিত্র সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তিনি কখনো ক্রোধান্বিত হতে পারেন এবং কখনো ক্রোধমুক্ত থাকতে পারেন।

পক্ষান্তরে যাতী বা সত্তীয় বিশেষণ তদ্রূপ নয়। এগুলি কখনোই তাঁর পবিত্র সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। আমরা বলতে পারি যে, মহান আল্লাহ যখন ইচ্ছা ক্রোধান্বিত হন এবং যখন ইচ্ছা ক্রোধ বিহীন থাকেন। কিন্তু আমরা বলতে পারি না যে, তিনি যখন ইচ্ছা ক্ষমতাবান হন এবং যখন ইচ্ছা ক্ষমতাহীন হন। সকল বিশেষণই এরূপ।

কিছু বিশেষণ ‘যাতী’’ (সত্তীয়) এবং ‘ফি’লী’ (কর্মীয়) হতে পারে, যেমন মহান আল্লাহর কালাম বা কথার বিশেষণ।

[1] ড. আলী সামী নাশ্শার, নাশআতুত তাফকীরিল ফালসাফী, ১/২৩২; আহমদ আতিয়্যাহ গামিদী, ইমাম বাইহাকী ওয়া মাওকিফুহূ মিনাল ইলাহিয়্যাত, পৃ. ১৮৪।

[2] বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত, খন্ড ১, পৃষ্টা ২৭৬-২৭৭; মুহাম্মাদ ইবনু খালীফা তামীমী, আস-সিফাতুল ইলাহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬।