আল-ফিকহুল আকবর আল-ফিকহুল আকবারের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
২. ৪. ৭. মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতে বিশ্বাস

রাসূলগণে বিশ্বাসের অন্যতম বিষয় মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত ও রিসালাতে বিশ্বাস করা। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, ‘‘ঈমান বিল্লাহ’’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। এখানে দুটি বিষয়ের বিশ্বাস ও সাক্ষ্য রয়েছে:

২. ৪. ৭. ১. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা

যুগে যুগে মানুষের শিরকে নিপতিত হওয়ার মূল কারণ ছিল ফিরিশতা, রাসূল বা নেককার মানুষদের বিষয়ে অতিভক্তি বশত তাঁদের মধ্যে ‘‘ঈশ্বরত্ব’’ বা ‘‘অলৌকিকত্ব’’ কল্পনা করে তাঁদের বা তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান বা বস্ত্তর ইবাদত করা।

সৃষ্টির মধ্যে ‘‘ইশ্বরত্ব’’ কল্পনার প্রধান দুটি দিক: প্রথমত, সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার বিশেষ সম্পর্ক দাবী করা। তাকে ইশ্বরের সন্তান বা বংশধর বলে দাবী করা। দ্বিতীয়ত, অবতারত্ব (Incarnation) দাবী, অর্থাৎ অমুকের মধ্যে স্র্ষ্টা বা তাঁর কোন শক্তি মিশে গিয়েছে বা স্রষ্টার সাথে তার ফানা বা মিলন হয়েছে। এ ধরনের শিরকের মূলোৎপাটন করতে ইসলামী ঈমানের মধ্যে ‘‘মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূুলূহু’’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘‘আব্দ’’ শব্দের ফার্সী অর্থ ‘‘বান্দা’’, যা বাংলায় বহুল প্রচলিত। এর বাংলা অর্থ: ‘‘দাস’’ বা ‘‘চাকর’’ (slave, bondsman, serf)। কুরআন ও হাদীসে ‘‘আল্লাহর বান্দা’’ বলতে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ (servant of God, man, human being) বুঝানো হয়।

মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর আবদ, বান্দা বা দাস হিসেবে বিশ্বাস করার অর্থ তিনি আল্লাহর মাখলূক, বান্দা ও মানুষ। তিনি তাঁর মহোত্তম ও তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টি। সর্বাবস্থায় তিনি তাঁর বান্দা, দাস ও মানুষ। তিনি স্রষ্টার অবতার নন, পুত্র নন, তাঁর যাত (সত্তা) বা সিফাত (বিশেষণ)-এর অংশ নন, আল্লাহর রুবুবিয়্যাত (প্রতিপালন) ও উলূহিয়্যাত (ইবাদত) এর কোনো ক্ষমতা, দায়িত্ব বা অধিকার-এর অংশীদার নন। তিনি আল্লাহর সৃষ্ট মাখলূক বান্দা। তাঁর মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব শ্রেষ্ঠতম ও প্রিয়তম বান্দা ও উপাসক হিসাবে, পুত্র, সন্তান বা অংশীদার হিসেবে নয়। তাঁকে পরিপূর্ণ ভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রদানের সাথে সাথে সকল প্রকার শিরক মূলক বাড়াবাড়ি ও অতিভক্তি থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করার জন্য এ বিশ্বাস রক্ষাকবজ।[1]

২. ৪. ৭. ২. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল

কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন নির্দেশনার আলোকে আমরা জানি যে, নিম্নের বিষয়গুলো এ সাক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত:

১. মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল।

২. তিনি আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর পরে আর কোনো ওহী নাযিল হবে না, কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না।

৩. তিনি বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত রাসূল। তাঁর আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়েছে। তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো মানুষই মুক্তি পাবে না।

৪. তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বজনীন নবী ও রাসূল হিসাবে তাঁর নবুয়তের ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর সকল বাণী, শিক্ষা ও নির্দেশ তিনি পরিপূর্ণভাবে তাঁর উম্মতকে শিখিয়ে গিয়েছেন, কোন কিছুই তিনি গোপন করেন নি।

৫. তাঁর সকল শিক্ষা ও সকল কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য।

৬. আল্লাহর ইবাদত করতে ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে অবশ্যই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর শিক্ষা ও রীতি অনুসরণ করতে হবে। তাঁর শিক্ষা বা সুন্নাতের বাইরে ইবাদত করলে তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

৭. জীবনের সকল ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষা, বিধান ও নির্দেশ সর্বান্তঃকরণে ও দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিতে হবে। নিজের ও সকল মানুষের মতের উর্দ্ধে তাঁর কথাকে স্থান দিতে হবে। আভ্যন্তরীণ সকল মতভেদ তাঁর নির্দেশ ও সুন্নাত অনুসারে নিষ্পত্তি করতে হবে।

৯. জীবনের সকল পর্যায়ে তাঁর অনুকরণ করতে হবে। তাঁর সুন্নাত বা রীতিই মুসলিমের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ বলে বিশ্বাস করতে হবে।

১০. তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করতে হবে। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, মানবজাতির নেতা, নবী-রাসূলদের প্রধান। তিনি আল্লাহর সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রিয়মত বান্দা। তিনি নিষ্পাপ। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে ও পরে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাঁকে সকল পাপ, অন্যায় ও অপরাধ থেকে রক্ষা করেছেন। প্রথম মানব আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির সময়েই আল্লাহ তাঁকে সর্বশেষ নবী হিসাবে মনোনীত করেছেন। তিনি আল্লাহর বান্দা, দাস ও মানুষ ছিলেন। তবে মহান আল্লাহ তাঁকে অগণিত অলৌকিক বৈশিষ্ট দান করেছেন, যা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

১১. তাঁর মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা। তাঁর ব্যাপারে কুরআন মাজীদ বা সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে তা সবকিছু পরিপূর্ণভাবে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করা। নিজের থেকে কোন কিছু বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা বা ব্যাখ্যা করে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন থেকে বিরত থাকা।

১২. মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে ভালবাসা। তাঁর সাহাবীগণ ও বংশধরকে ভালবাসা এবং তাঁর পরিপূর্ণ অনুসারী উম্মাতের নেককার মানুষদের ভালবাসাও তাঁর ভালবাসার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ভালবাসা মুখের দাবীর ব্যাপার নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাত অনুসরণ ও তাঁর আদেশ-নিষেধ হুবহু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করাই তাঁর মহববতের প্রকাশ ও মহববত অর্জন ও বৃদ্ধির একমাত্র পথ।[2]

এ বিষয়ক কিছু কথা ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, যা আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে দেখব, ইনশা আল্লাহ।

[1] দেখুন: সূরা (৩) আল-ইমরান: ১২৮ আয়াত; সূরা (৭) আ’রাফ: ১৮৮ আয়াত; সূরা (৯) তাওবা: ৮০ আয়াত; সূরা (১০) ইউনূস: ৪৯ আয়াত; সূরা (১৬) নাহাল: ৩৭ আয়াত; সূরা (১৭) বনী ইসরাঈল: ৯০-৯৫ আয়াত; সূরা (১৮) কাহাফ: ১১০ আয়াত; সূরা (২৮) কাসাস: ৫৬ আয়াত; সূরা (৪১) হা- মীম (ফুসসিলাত): ৬ আয়াত; সূরা (৪৬) আহকাফ: ৯ আয়াত; সূরা (৭২) জিন: ২১ আয়াত।

[2] বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ১৩৫-২৪০।