আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৬. তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশের সমালোচকদের মূল্যায়ন

এ ছিল হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ পর্যন্ত ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে আলিমগণের অভিমত ও তাঁর ফিকহী মতের প্রসারতা। কিন্তু হিজরী তৃতীয় শতক থেকে চিত্র পরিবর্তন হতে লাগল। এ সময় থেকে অনেক আলিম ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠিন অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগের ধারা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকে। বস্ত্তত মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ ইমামগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা যত আক্রমণ ও চরিত্র হননের শিকার হয়েছেন তেমন বোধ হয় অন্য কেউ হন নি। এ বিষয়ে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (২৩৩ হি) বলেন:

أصحابنا يفرطون في أبي حنيفة وأصحابه.

আমাদের সাথীরা, অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করেন।’’[1]

কেন এ সীমালঙ্ঘন তা পর্যালোচনার আগে ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে তৃতীয় শতকের প্রথমাংশের বা প্রথম দশকের কয়েকজন মুহাদ্দিস, ফকীহ ও সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন আলোচনা করব।
(১) ইমাম শাফিয়ী মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস (১৫০-২০৪ হি)


ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস শাফিয়ী ইমাম আবূ হানীফার পরের শ্রেষ্ঠতম ফকীহ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বিভিন্ন উসূলী ও ফিকহী বিষয়ে তিনি ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রদের মতামত প্রত্যাখ্যান করেন। ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফার শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব বিষয়ে তিনি বলেন:


الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.


‘‘ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষেরা আবূ হানীফার উপর নির্ভরশীল।’’[2]
(২) ইয়াযিদ ইবন হারূন (১১৭-২০৬ হি)


এ সময়ের প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও আবিদ ইয়াযিদ ইবন হারূন ওয়াসিতী। ইমাম আহমদ তাঁকে হাফিযুল হাদীস বলতেন। ইবনুল মাদীনী বলেন, তাঁর চেয়ে বড় হাফিযুল হাদীস আমি দেখি নি। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


كان أبو حنيفة تقيا نقيا زاهدا عالما صدوق اللسان أحفظ أهل زمانه سمعت كل من أدركته من أهل زمانه يقول إنه ما رأى أفقه منه


‘‘আবূ হানীফা আল্লাহ-ভীরু, পবিত্র ও সংসারবিরাগী আলিম ছিলেন। তিনি সত্যপরায়ণ এবং তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় হাফিযে হাদীস ছিলেন। তাঁর যুগের যত মানুষকে আমি পেয়েছি সকলকেই বলতে শুনেছি: তিনি ফিকহের বিষয়ে আবূ হানীফার চেয়ে অধিক পারদর্শী আর কাউকে দেখেন নি।’’[3]
(৩) আব্দুল্লাহ ইবন দাউদ আল-খুরাইবী (১২৬-২১৩ হি)


দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও আবিদ আবূ আব্দুর রাহমান আব্দুল্লাহ ইবন দাউদ ইবন আমির কূফী। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


من أراد ان يخرج من ذل العمى والجهل ويجد لذة الفقه فلينظر في كتب أبي حنيفة. ما يقع في أبي حنيفة إلا حاسد أو جاهل. ينبغي للناس أن يدعوا في صلاتهم لابي حنيفة، لحفظه الفقه والسنن عليهم.


‘‘যদি কেউ অন্ধত্ব ও মুর্খতার লাঞ্ছনা থেকে বের হতে চায় এবং ফিকহের স্বাদ লাভ করতে চায় তবে তাকে আবূ হানীফার বইগুলো পড়তে হবে। হিংসুক অথবা জাহিল এ দুয়ের একজন ছাড়া কেউ আবূ হানীফার বিষয়ে মন্দ বলে না। মানুষদের উচিত তাদের সালাতের মধ্যে আবূ হানীফার জন্য দুআ করা; কারণ তিনিই মানুষদের জন্য ফিকহ এবং সুন্নাহ (হাদীস) সংরক্ষণ করেছেন।’’[4]

[1] ইবন আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহী ২/২৯০।

[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩।

[3] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৪৮।

[4] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৮৫; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০২; ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১০/১১৪।