আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৪. দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে আবূ হানীফা

হিজরী দ্বিতীয় শতকে মুসলিম বিশ্ব ছিল তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের বরকতময় যুগ। হাদীস, ফিকহ ও অন্যান্য সকল ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী ইমামগণের বিচরণে পরিপূর্ণ ছিল মক্কা, মদীনা, কুফা, বসরা, দামিশক, বাগদাদ ও সে যুগের অন্যান্য জনপদ। এ সকল প্রসিদ্ধ আলিমগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা ও প্রসিদ্ধি আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যখন আমরা দেখি যে, উমাইয়া ও আববাসীয় উভয় সরকার তাঁকে বিচারক পদে পেতে উদগ্রীব ছিল। উমাইয়া খিলাফতের শেষ দিকে, যখন ইমাম আবূ হানীফার বয়স ৫০-এর কোঠায় তখনই তাঁর প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে ইরাকের উমাইয়া গভর্নর ইবন হুবাইরা (১৩২ হি) তাঁকে বিচারক পদ গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। আববাসী খিলাফাত প্রতিষ্ঠার পর খলীফা মানসূর (রাজত্ব ১৩৬-১৫৮ হি) তাঁর খিলাফাতের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য ইমাম আবূ হানীফাকে বিচারপতির দায়িত্ব প্রদানের জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে বাধ্য করতে চেষ্টা করেন এবং কারারুদ্ধ করেন।

দ্বিতীয় একটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আবূ হানীফার পক্ষের ও বিপক্ষের সকল মতের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও গবেষক একমত যে, ইমাম আবূ ইউসূফ (১১৩-১৮২ হি) তৎকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ, নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলিম বিশ্বে ‘‘কাযিল কুযাত’’, অর্থাৎ ‘প্রধান বিচারপতি’ উপাধি লাভ করেন। তিনজন আববাসী খলীফা মাহদী, হাদী ও হারূন রশীদের শাসনামলে প্রায় ২৪ বৎসর তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এ যুগশ্রেষ্ঠ আলিম নিজেকে আবু হানীফার ছাত্র হিসেবে গৌরবান্বিত মনে করতেন এবং তাঁর মতের পক্ষে ফিকহী ও উসূলী অনেক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। এ থেকেও আমরা ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা খুব সহজেই অনুভব করতে পারি।

তৃতীয় আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আবূ হানীফা কূফার মানুষ ছিলেন। খলীফা মানসূরের ডাকে তিনি বাগদাদের গমন করেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনের বিষয়ে খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলে তাঁকে কারাগারে রাখা হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তৎকালীন পরিবেশে কুফা ও বাগদাদ সম্পূর্ণ পৃথক দুটি দেশের মত। এজন্য কুফায় তাঁর জনপ্রিয়তা থাকলেও বাগদাদে নবাগত ও খলীফা কর্তৃক কারারুদ্ধ এরূপ ব্যক্তির জনপ্রিয়তা থাকার কথা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর সালাতুল জানাযায় এত প্রচন্ড ভীড় হয় যে, ছয় বার তাঁর জানাযা পড়া হয়। দাফনের পর খলীফা মনসূর নিজে কবরের পাশে জানাযা পড়েন। এরপর প্রায় ২০ দিন মানুষেরা কবরের পাশে সালাতুল জানাযা আদায় করে।[1]

ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর নিজ দেশ ছাড়িয়ে কিভাবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তা আমরা এ ঘটনা থেকে অনুভব করতে পারছি। এরপরও আমরা তাঁর সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ কতিপয় আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।
(১) মুগীরাহ ইবন মিকসাম দাববী কূফী (১৩৬ হি)


ইমাম আবূ হানীফার শিক্ষক পর্যায়ের সুপ্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ মুগীরাহ ইবন মিকসাম। তিনি কুফার বাসিন্দা ছিলেন। বুখারী ও মুসলিমসহ সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বিচারপতি জারীর ইবন আব্দুল হামীদ দাববী (১৮৮ হি)। বুখারী, মুসলিম ও সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। সাইমারী, যাহাবী, ইবন হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁদের সনদে তাঁর থেকে উদ্ধৃত করেছেন:


قال لي مغيرة: جالس أبا حنيفة تفقه فإن إبراهيم النخعي لو كان حياً لجالسه. ... والله يحسن أن يتكلم في الحلال والحرام


‘‘আমাকে মুগীরাহ বলেন: তুমি আবূ হানীফার মাজলিসে বসবে, তাহলে ফিকহ শিখতে পারবে। কারণ (কুফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ, মুগীরার উস্তাদ) ইবরাহীম নাখয়ী (৯৫ হি) যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিও আবূ হানীফার মাজলিসে বসতেন। ... আল্লাহর কসম! হালাল ও হারামের বিষয়ে সে ভালভাবে কথা বলার যোগ্যতা রাখে।’’[2]
(২) সুলাইমান ইবন মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৮ হি)


কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাবিয়ী সুলাইমান ইবন মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৮ হি)। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা করেন। তিনি অনেক সময় ইমাম আবূ হানীফাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি এ মাসআলাটি কোন দলিলের ভিত্তিতে বলেছ? আবূ হানীফা উত্তর করতেন, আপনার বর্ণিত অমুক হাদীসটির ভিত্তিতে। তখন তিনি অবাক হয়ে বলতেন,


يا معشر الفقهاء أنتم الأطباء ونحن الصيادلة


‘‘হে ফকীহগণ! তোমরা ডাক্তার আর আমরা ফার্মাসিস্ট!’’[3]

আ’মাশ যখন হজ্জে যান তখন তিনি তাঁর ছাত্র আলী ইবন মুসহিরকে বলেন, আবূ হানীফার কাছ থেকে আমাদের জন্য হজ্জের নিয়মকানুন লিখে আন। তাঁকে ফিকহী মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন:


إنما يحسن الجواب فى هذا ومثله النعمان بن ثابت الخزاز وأراه بورك له فى علمه


‘‘এগুলোর উত্তর তো কেবল কাপড় ব্যবসায়ী নুমান ইবন সাবিতই বলতে পারে। আমার ধারণা তার ইলমে বরকত প্রদান করা হয়েছে।’’[4]
(৩) মিসআর ইবন কিদাম ইবন যাহীর কূফী (১৫৫ হি)


ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কুফার সুপ্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ইমাম মিসআর ইবন কিদাম। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল ইমাম তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে বলেন:


ما أحسد أحدا بالكوفة إلا رجلين أبو حنيفة في فقهه والحسن بن صالح في زهده ... من جعل أبا حنيفة بينه وبين الله رجوت أن لا يخاف ولا يكون فرط في الاحتياط لنفسه


‘‘কূফার দু ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আমি ঈর্ষার যোগ্য বলে মনে করি না: আবূ হানীফাকে তাঁর ফিকহের জন্য এবং হাসান ইবন সালিহকে তাঁর যুহদের জন্য। ... যদি কোনো ব্যক্তি তার ও আল্লাহর মাঝে আবূ হানীফাকে রাখে- অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতের জন্য আবূ হানীফার ফিকহী মতের উপর নির্ভর করে- তাহলে আমি আশা করি যে, তাকে ভয় পেতে হবে না এবং সে আত্মরক্ষার সাবধানতায় অবহেলাকারী বলে গণ্য হবে না।’’[5]
(৪) শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬০ হি)


আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস নামে প্রসিদ্ধ দ্বিতীয় হিজরী শতকের জারহ-তা’দীলের শ্রেষ্ঠতম ইমাম শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ। তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর প্রশংসায় তিনি কবিতা পাঠ করতেন:


إذا ما الناس يوما قايسونا بآبدة من الفتوى طريفـــة
اتيناهم بمقياس صلــيب مصيب من طراز أبى حنيفة


‘‘মানুষেরা যখন আমাদেরকে কোনো কঠিন কিয়াসের ফাতওয়া দিয়ে আটকায় আমরা তখন তাদেরকে আবূ হানীফার পদ্ধতির সুদৃঢ় বিশুদ্ধ কিয়াসের শর দিয়ে আঘাত করি।’’[6]

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে শুবা বলেন:


كان والله حسن الفهم جيد الحفظ


‘‘আল্লাহর কসম! তাঁর অনুধাবন সুন্দর এবং তাঁর মুখস্থ শক্তি ভাল ছিল।’’[7]

আবূ হানীফার নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে শুবা ইবনুল হাজ্জাজের মতামত ব্যাখ্যা করে ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (২৩৩ হি) বলেন:


هذا شعبة بن الحجاج يكتب إليه أن يحدث، وشعبة شعبة".


‘‘এই তো শুবা ইবনুল হাজ্জাজ তিনি হাদীস বর্ণনার অনুরোধ করে আবূ হানীফাকে পত্র লিখেছেন। আর শু’বা তো শু’বাই।’’[8]

ইমাম আবূ হানীফার ওফাতের খবর পেয়ে শুবা বলেন:


لقد ذهب معه فقه الكوفة تفضل الله علينا وعليه برحمته


‘‘তাঁর সাথে কূফার ফিকহও চলে গেল, আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে রহমত করুন।’’[9]


(৫) ইসরাঈল ইবন ইউনূস ইবন আবী ইসহাক সাবীয়ী (১৬০ হি)


ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও সমালোচক ইসরাঈল ইবন ইউনূস। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


كان نعم الرجل النعمان ما كان أحفظه لكل حديث فيه فقه وأشد فحصه عنه وأعلمه بما فيه من الفقه وكان قد ضبط عن حماد فأحسن الضبط عنه فأكرمه الخلفاء والأمراء والوزراء


‘‘নুমান খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। যে সকল হাদীসের মধ্যে ফিকহ রয়েছে সেগুলি তিনি খুব ভালভাবে ও পরিপূর্ণভাবে মুখস্থ রাখতেন, সেগুলির বিষয়ে সর্বোচ্চ অনুসন্ধান করতেন এবং সেগুলির মধ্যে বিদ্যমান ফিকহী নির্দেশনাও তিনি সবেচেয়ে ভাল জানতেন। এ বিষয়ে তাঁর স্মৃতি, অনুসন্ধান ও জ্ঞান ছিল অবাক করার মত। তিনি হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান থেকে ফিকহ সংরক্ষণ করেন এবং খুব ভালভাবেই সংরক্ষণ করেন। ফলে খলীফাগণ, আমীরগণ ও উযীরগণ তাঁকে সম্মান করেছেন।’’[10]
(৬) হাসান ইবন সালিহ (১০০-১৬৯ হি)


কূফার অন্য প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী হাসান ইবন সালিহ (১০০-১৬৯ হি)। বুখারী (আদাব গ্রন্থে), মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবন আদম (২০৩ হি) বলেন, হাসান ইবন সালিহ বলেন:


كان النعمان بن ثابت فهما عالما متثبتا فى علمه اذا صح عنده الخبر عن رسول الله ﷺ لم يعده إلى غيره


‘‘নুমান ইবন সাবিত বিজ্ঞ আলিম ছিলেন, ইলমের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে সচেতন ছিলেন। কোনো বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হলে তিনি তা পরিত্যাগ করে অন্য দিকে যেতেন না।’’[11]
(৭) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১১৮-১৮১ হি)


দ্বিতীয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, যাহিদ ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক খুরাসানী (১১৮- ১৮১ হি)। তিনি ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ছিলেন, তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ফিকহী বিষয়ে তাঁর মত অনুসরণ করতেন। ইসমাঈল ইবন দাউদ বলেন:


كان ابن المبارك يذكر عن أبى حنيفة كل خير ويزكيه... ويثنى عليه


ইবনুল মুবারাক আবূ হানীফা সম্পর্কে সবসময়ই ভাল বলতেন, তাঁর বিশ্বস্ততা ও বুজুর্গির কথা বলতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন।’’[12]

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলতেন:


لا نكذب الله في أنفسنا إمامنا في الفقه أبو حنيفة وفي الحديث سفيان فإذا اتفقا لا أبالي بمن خالفهما. ... لولا أن أغاثني الله بأبي حنيفة وسفيان كنت كسائر الناس. ... أبو حنيفة أفقه الناس.


‘‘আমাদের নিজেদের বিষয়ে আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! ফিকহের বিষয়ে আমাদের ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসের বিষয়ে আমাদের ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর যখন দুজন কোনো বিষয়ে একমত হন তখন আমরা তাঁদের বিপরীতে আর কাউকে পরোয়া করি না।’’... ‘‘আল্লাহ যদি আমাকে আবূ হানীফা এবং সুফইয়ান সাওরী দ্বারা উদ্ধার না করতেন তাহলে আমি সাধারণ মানুষই থাকতাম।’’ ‘‘আবূ হানীফা মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ।’’[13]

ইমাম সুফইয়ান (ইবন সাঈদ ইবন মাসরূক) সাওরী (৯৭-১৬১ হি) ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ। দুজনের মধ্যে আকীদা ও ফিকহী অনেক বিষয়ে মতভেদ ছিল এবং অনেক ভুল বুঝাবুঝিও ছিল। ইবনুল মুবারক দুজনেরই ছাত্র এবং দুজনের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন।
(৮) কাযী আবূ ইউসূফ ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম (১১৩-১৮২ হি)


আমরা বলেছি যে, আবূ ইউসূফ তাঁর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ও ফকীহ ছিলেন বলে সকলেই স্বীকার করেছেন। হাদীস বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা বর্ণনা করে তিনি বলেন:


ما رأيت أحدا أعلم بتفسير الحديث ومواضع النكت التي فيه من الفقه من أبي حنيفة ... ما خالفت أبا حنيفة في شيء قط فتدبرته إلا رأيت مذهبه الذي ذهب إليه أنجى في الآخرة وكنت ربما ملت إلى الحديث وكان هو أبصر بالحديث الصحيح مني ... إني لأدعو لأبي حنيفة قبل أبوي ولقد سمعت أبا حنيفة يقول إني لأدعو لحماد مع أبوي.


‘‘হাদীসের ব্যাখ্যায় এবং হাদীসের মধ্যে ফিকহের যে সকল নির্দেশনা রয়েছে তা অনুধাবন করায় আবূ হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও পারদর্শী আমি কাউকে দেখি নি। .... যে বিষয়েই আমি আবূ হানীফার সাথে বিরোধিতা করেছি সে বিষয়েই আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি যে, আবূ হানীফার মতই আখিরাতে নাজাতের অধিক উপযোগী। অনেক সময় আমি হাদীসের দিকে ঝুঁকে পড়েছি, কিন্তু তিনি সহীহ হাদীসের বিষয়ে আমার চেয়ে অধিক সমঝদার ছিলেন। .... আমি আমার পিতামাতার জন্য দুআ করার আগে আবূ হানীফার জন্য দুআ করি। আর আমি শুনেছি, আবূ হানীফা বলতেন, আমি আমার পিতামাতার সাথে হাম্মাদের জন্য দুআ করি।’’[14]
(৯) ফুদাইল ইবন ইয়াদ (১৮৭ হি)


তৎকালীন সময়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, সমালোচক ও বুজুর্গ ইমাম ফুদাইল ইবন ইয়াদ খুরাসানী মাক্কী (১৮৭হি)। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন:


كان أبو حنيفة رجلا فقيها معروفا بالفقه مشهورا بالورع واسع المال معروفا بالأفضال على كل من يطيف به صبورا على تعليم العلم بالليل والنهار حسن الليل كثير الصمت قليل الكلام حتى ترد مسألة في حلال أو حرام فكان يحسن ان يدل على الحق هاربا من مال السلطان ... وكان إذا وردت عليه مسألة فيها حديث صحيح أتبعه وإن كان عن الصحابة والتابعين وإلا قاس وأحسن القياس.


‘‘আবূ হানীফা সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ছিলেন। তাঁর তাকওয়া ছিল অতি প্রসিদ্ধ। তিনি সম্পদশালী ছিলেন এবং বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। রাতদিন সার্বক্ষণিক ইলম শিক্ষা দানে তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। রাতের ইবাদতে মাশগুল থাকতেন। অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং কম কথা বলতেন। তবে যখন হালাল-হারামের কোনো মাসআলা তাঁর কাছে আসত তখন তিনি কথা বলতেন এবং খুব ভালভাবেই হক্ক প্রমাণ করতে পারতেন। তিনি শাসকদের সম্পদ থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। ... যখন তাঁর কাছে কোনো মাসআলা আসত তখন তিনি সে বিষয়ে সহীহ হাদীস থাকলে তা অনুসরণ করতেন, অথবা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত। তা না হলে তিনি কিয়াস করতেন এবং তিনি সুন্দর কিয়াস করতেন।’’[15]
(১০) হাফস ইবন গিয়াস (১৯৫হি)


কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ হাফস ইবন গিয়াস নাখয়ী কূফী (১৯৫হি) তিনি প্রথমে কূফা ও পরে বাগদাদের কাযীর দায়িত্ব পালন করেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


كلام أبي حنيفة في الفقه أدق من الشعر لا يعيبه إلا جاهل.


‘‘ফিকহের বিষয়ে আবূ হানীফার বক্তব্য চুলের চেয়েও সুক্ষ্ম। জাহিল-মুর্খ ছাড়া কেউ তাঁকে খারাপ বলে না।’’[16]
(১১) আবূ মুআবিয়া দারীর মুহাম্মাদ ইবন খাযিম (১১৩-১৯৫ হি)


কূফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবন খাযিম আবূ মুআবিয়া দারীর। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


حب أبي حنيفة من السنة


‘‘সুন্নাতপন্থী হওয়ার একটি বিষয় আবূ হানীফাকে ভালবাসা।’’[17]
(১২) ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (১৯৭ হি)


শুবা ইবনুল হাজ্জাজের পরে দ্বিতীয় শতকের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্যতম দুই দিকপাল: ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান ও ইবন মাহদী। উভয়েই বসরার অধিবাসী ছিলেন। কাত্তান বলেন:


لا نكذب الله ما سمعنا أحسن من رأى أبى حنيفة، وقد أخذنا بأكثر أقواله. قال يحيى بن معين: وكان يحيى بن سعيد يذهب في الفتوى إلى مذهب (قول) الكوفيين ويختار قوله من أقوالهم ويتبع رأيه من بين أصحابه.


‘‘আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! আবূ হানীফার মতের চেয়ে উত্তম মত আমি শুনি নি। অধিকাংশ বিষয়ে আমরা তাঁর মত অনুসরণ করি। (তাঁর ছাত্র) ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন: ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ ফাতওয়ার বিষয়ে কূফীদের মাযহাব অনুসরণ করতেন, কূফীদের মধ্য থেকে আবূ হানীফার বক্তব্য পছন্দ করতেন এবং তাঁর মত অনুসরণ করতেন।’’[18]
(১৩) ওকী ইবনুল জার্রাহ ইবন মালীহ (১৯৭ হি)


কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ওকী ইবনুল জার্রাহ। ইমাম আহমদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস বলে গণ্য করেছেন। তাঁর ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন:


ما رأيت أحدا أقدمه على وكيع، وكان يفتي برأي أبي حنيفة، وكان يحفظ حديثه كله، وكان قد سمع من أبي حنيفة حديثا كثيرا.


আমি ওকী-এর উপরে স্থান দেওয়ার মত কোনো মুহাদ্দিস দেখি নি। তিনি আবূ হানীফার মত অনুসারে ফাতওয়া দিতেন। তিনি তাঁর সব হাদীস মুখস্থ রাখতেন। তিনি আবূ হানীফা থেকে অনেক হাদীস শুনেন।[19]

এ থেকে জানা যায় যে, ইমাম ওকী শুধু ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মতই অনুসরণ করতেন না, উপরন্তু তিনি তাঁকে হাদীসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করতেন এবং তাঁর সকল হাদীস মুখস্থ রাখতেন।
(১৪) আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী (১৩৫-১৯৮ হি)


এ সময়ের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্য দিকপাল ইবন মাহদী। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ লিখেছেন, আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি, তাঁর উস্তাদ ইবন মাহদী বলতেন:


من حسن علم الرجل أن ينظر في رأي أبي حنيفة


‘‘একজন মানুষের ইলমের সৌন্দর্য এই যে, সে আবূ হানীফার ‘রায়’ বা মাযহাব অধ্যয়ন করবে।’’[20]

[1] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪৪৪; আইনী, মাগানীল আখইয়ার ৫/১৬৫।

[2] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ৭৯; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৪০৩; তারীখুৃল ইসলাম ৯/৩১২।

[3] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ২৭; বাজী, সুলাইমান ইবন খালাফ, আত-তা’দীলু ওয়াত- তাজরীহ ১/২৮; ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৭।

[4] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১২৬; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩;

[5] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৯।

[6] ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৭-৯।

[7] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ২৩।

[8] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪১৭-৪৪৪; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯০-৪০৩; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪০১-৪০২।

[9] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা ১/১২৬-১২৭।

[10] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৯।

[11] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১২৮।

[12] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১৩৩।

[13] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ১৪০; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৭; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯৮।

[14] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৪০; সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ২৫।

[15] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৪০।

[16] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩।

[17] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৪০১; তারীখুল ইসলাম ৯/৩১০।

[18] দূরী, তারীখ ইবন মায়ীন ৩/৫১৭; ৪/২৮৩; মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪১৭-৪৪৪; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯০-৪০৩; ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৯; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪০১-৪০২।

[19] ইবন আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলম ২/২৯০-২৯১; আল-ইনতিকা, পৃ. ১৩৬।

[20] আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, আস-সুন্নাহ ১/১৮০।