১৬. ‘ত্বাই’ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ طيِّـئ):

এ দলের সঙ্গে আরবের প্রসিদ্ধ ঘোড়সওয়ার যায়দুল খাইলও ছিলেন। তাঁরা নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং তাঁদের সামনে ইসলাম উপস্থাপন করেন। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং অনেক ভাল মুসলিম হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ (রাঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন,

‏(‏مَا ذُكِرَ لِيْ رَجُلٌ مِّنْ الْعَرَبِ بِفَضْلٍ، ثُمَّ جَاءَنِيْ إِلَّا رَأَيْتُه دُوْنَ مَا يُقَالُ فِيْهِ ، إِلَّا زَيْدُ الْخَيْلِ، فَإِنَّهُ لَمْ يَبْلُغْ كُلَّ مَا فِيْهِ‏)

‘আমাকে আরবের যে কোন লোকের প্রশংসা শুনানো হয়েছে এবং সে আমার নিকট এসেছে তখন আমি তাকে তার প্রচারকৃত প্রশংসা থেকে কম পেয়েছি। কিন্তু তার বিপরীত হচ্ছে যায়েদুল খাইল। কারণ, তাঁর খ্যাতি তাঁর প্রকৃত গুণের নিকটেই পৌঁছে নি।’

অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর নাম রাখেন ‘যায়দুল খাইর’।

এমনি ভাবে ৯ম ও ১০ম হিজরীতে বিভিন্ন প্রতিনিধিদল মদীনায় আগমন করতে থাকেন। চরিতকারগণ ইয়ামান, আযদ, কুযা’আহর বনু সা‘দ, হুযাইম, বুন ‘আমির বিন ক্বায়স, বনু আসাদ, বাহরা, খাওলান, মুহারিব, বনু হারিস বিন কা‘ব, গামিদ, বনু মুনতাফিক্ব ও সালামান, বনু আবস, মুযাইনা, মুরাদ, যুবাইদ, কিন্দাহ, যূ মুররাহ, গাসসান, বুন ‘ঈশ এবং নাখ’ এর প্রতিনিধি দল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ‘নাখ’ এর দলই ছিল শেষ দল যা ১১শ হিজরী মুহাররম মাসের মধ্যে এসেছিল। ঐ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল দুই শত। অবিশষ্ট অন্যান্য দলগুলো আগমন করে ৯ম ও ১০ম হিজরীতে। অল্প কিছু সংখ্যক পরে একাদশ হিজরীতে আগমন করেছিল।

ওই সকল প্রতিনিধি দলের আগমন ধারা থেকেই বুঝা যায় যে, সে সময় ইমলামী দাওয়াত কতটা বিস্তার লাভ করেছিল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের কতটা স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল। অধিকন্তু, এটাও আঁচ অনুমান করা সম্ভব যে, আরববাসীগণ মদীনাকে কী পরিমাণ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিল। এমন কি মদীনার নিকট মাথা নত করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না। প্রকৃতই মদীনা সমগ্র আরব উপদ্বীপের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এবং মদীনাকে এড়িয়ে চলা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। অবশ্য সকল আরববাসীর অন্তর ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এমনটি বলা হয়ত সঙ্গত হবে না। কারণ, তাদের মধ্যে তখনো এমন কিছু সংখ্যক বেদুঈন ছিল যারা শুধুমাত্র তাদের নেতাদের অনুসরণে মুসলিম হয়েছিল। মুসলিম হিসেবে পরিচিতি প্রদান করলেও তাদের মধ্যে হত্যা এবং লুটতরাজের মনোভাব পূর্বের মতোই ছিল। ইসলামী আদর্শের প্রভাবে তারা ততটা প্রভাবিত হয় নি। এ প্রেক্ষিতে কুরআন কারীমের সূরাহ তাওবায় তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,

‏(‏الأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَنِفَاقًا وَأَجْدَرُ أَلاَّ يَعْلَمُوْا حُدُوْدَ مَا أَنزَلَ اللهُ عَلٰى رَسُوْلِهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ ‏وَمِنَ الأَعْرَابِ مَن يَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ مَغْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَآئِرَةُ السَّوْءِ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ‏)‏ ‏[‏التوبة‏:‏97، 98‏]‏

‘বেদুঈন আরবরা কুফুরী আর মুনাফিকীতে সবচেয়ে কঠোর, আর আল্লাহ তাঁর রসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন তার সীমারেখার ব্যাপারে অজ্ঞ থাকার তারা অধিক উপযুক্ত, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, মহা প্রজ্ঞাবান। কতক বেদুঈন যা তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাকে জরিমানা ব’লে গণ্য করে আর তোমাদের দুঃখ মুসিবতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, মন্দের চক্র তাদেরকেই ঘিরে ধরুক। আর আল্লাহ তো সব কিছুই শুনেন, সব কিছু জানেন।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯৭-৯৮]

আবার কিছু লোকের সুনামও করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,

‏(‏وَمِنَ الأَعْرَابِ مَن يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ قُرُبَاتٍ عِندَ اللهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُوْلِ أَلا إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَّهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللهُ فِيْ رَحْمَتِهِ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ‏)‏ ‏[‏ التوبة:99]‏‏.‏

‘কতক বেদুঈন আল্লাহতে ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে আর তারা যা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য ও রসূলের দু‘আ লাভের মাধ্যম মনে করে, সত্যিই তা তাদের (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের মাধ্যম, অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করবেন, অবশ্যই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯৯]

যতদূর পর্যন্ত মক্কা, মদীনা, সাকাফ, ইয়ামান ও বাহরায়েন অধিকাংশ শহরের অধিবাসীদের সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল তাঁদের মধ্যে ইসলাম পূর্ণরূপে পরিপক্কতা লাভ করেছিল এবং তাঁদের মধ্য হতেই প্রখ্যাত সাহাবীগণ (রাঃ) এবং নেতৃস্থানীয় মুসলিমগণের আবির্ভাব ঘটেছিল।[1]

[1] এ কথা বলেছেন খুযরী মোহাযারাতে, ১ম খন্ড ১৪৪ পৃঃ, এবং যে সকল প্রতিনিধি দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অথবা যার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য বুখারী ১ম খন্ড ১৩ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬২৬-৬৩০ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫০১-৫০৩ পৃঃ, ৫১০-৫১৪ পৃঃ, ৫৩৭-৫৪২ পৃ: ৫৬০-৬০১ পৃঃ, যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ২৬-৬০ পৃঃ, ফাতহুল বারী ৮ম হিজরী ৮৩-১০৩ পৃঃ, রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১৮৪-২১৭ পৃঃ।