যারা যুদ্ধ হতে পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন (المُخَلَّفُوْنَ):

তাবুক যুদ্ধ ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এমন এক কঠিন পরীক্ষা যা দ্বারা ঈমানদার ও অন্যান্যদের মধ্যে প্রভেদের একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা তৈরি হয়েছিল। এ ধরণের অবসরে আল্লাহর বিধি-বিধানও এরূপ :

‏(‏مَّا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلٰى مَآ أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتّٰى يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ‏)‏‏[‏ آل عمران‏:‏179‏]‏‏.

‘আল্লাহ মু’মিনদেরকে সে অবস্থায় পরিত্যাগ করতে পারেন না। যার উপর তোমরা আছ, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না অপবিত্রকে পবিত্র থেকে পৃথক করে দেন।’ (আলু ‘ইমরান (৩): ১৭৯]

কাজেই, এ যুদ্ধে মু’মিন ও সত্যবাদিগণ শরীক হন। যুদ্ধ হতে অনুপস্থিতি কপটতার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সুতরাং তখন ঠিক এ রকম এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, যদি কেউ পিছনে পড়ে থাকত কিংবা পিছুটান হয়ে থাকত তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে আলোচনা করা হলে তিনি বলতেন,

(‏دَعَوْهُ، فَإِنْ يَكُنْ فِيْهِ خَيْرٌ فَسَيَلْحَقُهُ اللهُ بِكُمْ، وَإِنْ يَكُنْ غَيْرَ ذٰلِكَ فَقَدْ أَرَاحَكُمْ مِنْهُ‏)

‘তাকে ছেড়ে যাও। যদি তার মধ্যে মঙ্গল নিহিত থাকে তাহলে আল্লাহ শীঘ্রই তাকে তোমাদের নিকট পৌঁছে দিবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তার অনুপস্থিতির মাধ্যমে শান্তি প্রদান করবেন।’ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এ যুদ্ধ হতে সেই সকল লোক অনুপস্থিত ছিল, যারা ছিল অপারগ, অথবা ছিল মুনাফিক্ব। মুনাফিক্বগণ আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ঈমানের মিথ্যা দাবী করত এবং এ দাবীর ভিত্তিতেই তারা যুদ্ধে শরীক হয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে তারা ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। মিথ্যা অযুহাতে তারা যুদ্ধরত সৈন্যদের পিছনে বসে থাকত। হ্যাঁ, তিন ব্যক্তি এমন ছিল যারা প্রকৃতই মু’মিন ছিল এবং কোন কারণ ছাড়াই যুদ্ধে শরিক হওয়া থেকে বিরত ছিল। আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষার মধ্যে নিপতিত করেন এবং পুনরায় তাদের তওবা কবুল করেন।

এর বিবরণ হচ্ছে, তাবুক হতে প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় প্রবেশের পর সর্ব প্রথম মাসজিদে নাবাবীতে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সেখানে দু’ রাকাত সালাত আদায় করেন। অতঃপর লোকজনদের জন্য সেখানে বসে পড়েন। এ সময় আশি জনেরও অধিক মুনাফিক্বের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়ে নানা ওযর আপত্তি আরম্ভ করে দেয়[1] এবং শপথ করতে থাকে। নাবী (ﷺ) বাহ্যিকভাবে তাদের ওযর গ্রহণ করে আজ্ঞানুবর্তী হওয়ার শপথ গ্রহণ করেন এবং ক্ষমা প্রদান করেন। অতঃপর প্রশ্নটি আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করে দেন।

অবশিষ্ট তিন জন মু’মিন অর্থাৎ কা‘ব বিন মালিক, মুরারাহ বিন রাবী’ এবং হেলাল বিন উমাইয়া সত্যবাদিতা অবলম্বন ক’রে স্বীকার করে যে, কোন রকম অসুবিধা ছাড়াই তারা যুদ্ধে শরীক হওয়া থেকে বিরত ছিল। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলার জন্য সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করেন।

সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে কঠিন বয়কট বা বর্জন ব্যবস্থা কার্যকর হয়ে গেল। মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এসে গেল, পৃথিবী ভয়ানক আকার ধারণ করল এবং প্রশস্ততা থাকা সত্ত্বেও সংকীর্ণ হয়ে গেল। তাদের জীবনের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেল।

এমনি এক বিপদের সৃষ্টি হয়ে গেল যে, ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তাদেরকে আপন আপন স্ত্রী এবং পরিবার পরিজন থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দেয়া হল। যখন বয়কটের ৫০ দিন পূর্ণ হল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওবা কবুল করার সুসংবাদ প্রদান করে আয়াত নাযিল করলেন,

‏(‏وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِيْنَ خُلِّفُوْا حَتّٰى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّوْا أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوْبُوْا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ‏)‏ ‏[‏التوبة‏:‏118‏]‏‏.‏

‘আর (তিনি অনুগ্রহ করলেন) ঐ তিনজনের প্রতিও যারা পিছনে থেকে গিয়েছিল [কা‘ব ইবনে মালিক, মুরারা ইবনে রাবী‘আ ও হিলাল ইবনে উমায়্যা (রাযি।) তাঁরা অনুশোচনার আগুনে এমনি দগ্ধীভূত হয়েছিলেন যে] শেষ পর্যন্ত পৃথিবী তার পূর্ণ বিস্তৃতি নিয়েও তাদের প্রতি সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল আর তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল আর তারা বুঝতে পারল যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন আশ্রয়স্থল নেই তাঁর পথে ফিরে যাওয়া ব্যতীত। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করলেন যাতে তারা অনুশোচনায় তাঁর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ অতিশয় তাওবাহ কবূলকারী, বড়ই দয়ালু।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ১১৮]

মীমাংসা সম্পর্কিত এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ায় সাধারণ মুসলিমগণ এবং ঐ তিন জন সাহাবা অত্যন্ত আনন্দিত হন। লোকেরা দৌড় দিয়ে গিয়ে এ শুভ সংবাদ প্রচার করতে থাকে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সকলের মুখমণ্ডলে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পায় এবং সকলে দান খয়রাত করতে থাকে। প্রকৃতই এ দিনটি ছিল তাদের জন্য চরম ও পরম সৌভাগ্যের দিন।

যারা অপারগতার কারণে যুদ্ধে শরিক হতে পারেন নি অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্যও বলেন,

‏(‏لَّيْسَ عَلٰى الضُّعَفَاء وَلاَ عَلٰى الْمَرْضٰى وَلاَ عَلٰى الَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ مَا يُنفِقُوْنَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوْا لِلهِ وَرَسُوْلِهِ‏)‏ ‏[‏التوبة‏:‏ 91‏]‏‏

তাঁদের সম্পর্কে নাবী কারীমও (ﷺ) মদীনায় পৌঁছার পর বলেছেন, (‏إِنَّ بِالْمَدِيْنَةِ رِجَالاً مَا سِرْتُمْ مَسِيْراً، وَلَا قَطَعْتُمْ وَادِياً إِلَّا كَانُوْا مَعَكُمْ، حَبَسَهُمْ الْعُذْرُ‏) ‘মদীনায় এমন কতগুলো লোক আছে তা তোমরা যেখানেই সফর করেছ এবং যে উপত্যাকা অতিক্রম করেছ তারা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছে। তাদের অপারগতা তাদেরকে রেখেছিল।’

লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তারা মদীনায় অবস্থান করেও আমাদের সঙ্গে ছিল? নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (‏وَهُمْ بِالْمَدِيْنَةِ) ‘হ্যাঁ’ মদীনায় অবস্থান করেও তারা সঙ্গেই ছিল।’

[1] ইমাম ওয়াক্বিদী উল্লেখ করেছেন যে, এ সংখ্যা ছিল মুনাফিক্ব আনসারদের। এদের ছাড়া বনু গেফার এবং অন্যন্যদের মধ্যে বাহানাকারীদের সংখ্যাও ছিল। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার অনুসারীগণ ছিল ওই সংখ্যার বাইরে এবং এদের সংখ্যাও ছিল বেশ বড়। দ্র: ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ১১৯ পৃঃ।