সন্ধিচুক্তি এবং চুক্তির দফাসমূহ (إِبْرَامُ الصُّلْحِ وَبُنُوْدُهُ):

যাহোক, কুরাইশগণ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করল এবং অনতিবিলম্বে সোহাইল বিন ‘আমরকে সন্ধিচুক্তির ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে প্রেরণ করল। তাকে প্রেরণের সময় এ পরামর্শ দিল যে, সন্ধিচুক্তিতে অবশ্যই এ চুক্তিটি উল্লেখিত হবে যে, এ বছর ওমরাহ্ পালন না করেই তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবেন যাতে মক্কার লোকেরা এমন চিন্তার অবকাশ না পায় যে, নাবী কারীম (ﷺ) জোর জবরদস্তি করে আমাদের শহরে প্রবেশ করেছেন। কুরাইশগণের নিকট হতে এ সকল নির্দেশ সহকারে সোহাইল বিন ‘আমর নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হল। তাকে আসতে দেখে নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে বললেন, ‏(‏قَدْ سَهَّلَ لَكُمْ أَمْرَكُمْ‏) ‘তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সহজ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যক্তিকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কুরাইশগণ সন্ধি চাচ্ছে।’ সোহাইল নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আগমনের পর বহুক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করল এবং অবশেষে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তির দফাসমূহ স্থিরীকৃত হল। চুক্তির দফাগুলো হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :

১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই সঙ্গী সাথীগণসহ মদীনায় ফিরে যাবেন। মুসলিমগণ আগামী বছর মক্কায় আগমন করবেন এবং সেখানে তিন দিন অবস্থান করবেন। তাঁদের সঙ্গে সফরের প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকবে এবং তরবারী কোষবদ্ধ থাকবে। তাঁদের আগমনে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে না।

২. দশ বছর পর্যন্ত দু’ পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এ সময় লোকজন নিরাপদ থাকবে, কেউ কারো উপর হাত উত্তোলন করবে না।

৩. যে সকল গোত্র কিংবা জনগোষ্ঠি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাঙ্গনে প্রবেশ লাভ করতে চাইবে, প্রবেশ লাভ করতে পারবে। যে গোত্র যে দলে অংশ গ্রহণ করবে তাকে এ দলের অংশ গণ্য করা হবে। এরূপ ক্ষেত্রে কোন গোত্রের উপর অন্যায় অত্যাচার করা হলে সংশ্লিষ্ট দলের উপর অন্যায় করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে।

৪. কুরাইশদের কোন লোক অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া অর্থাৎ পলায়ন করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দলে যোগদান করলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দলভুক্ত কোন লোক আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে পলায়ন করে কুরাইশদের নিকট গেলে কুরাইশগণ তাকে ফেরত দেবে না।

এরপর নাবী কারীম (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে সন্ধির দফাগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন লিখ, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম।

এর প্রেক্ষিতে সুহাইল বলল, ‘রহমান’ বলতে যে কী বুঝায় আমরা তা জানি না। আপনি এভাবে লিখুন, ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ (হে আল্লাহ তোমার নামে)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে সে ভাবেই লিখতে নির্দেশ দিলেন এবং তিনি সে ভাবেই তা লিখলেন।

অতঃপর নাবী কারীম (ﷺ)-এর নির্দেশে আলী (রাঃ) লিখলেন, ‏(‏هٰذَا مَا صَالَحَ عَلَيْهِ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ) ‘এগুলো হচ্ছে সে সব কথা যার উপর ভিত্তি করে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সন্ধি করলেন।’’

এ কথার প্রেক্ষিতে সুহাইল বলল, ‘আমরা যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল তাহলে আপনাকে আল্লাহর ঘর হতে বিরত রাখতাম না এবং আপনার সঙ্গে যুদ্ধও করতাম না। কাজেই, আপনি লিখুন, ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ।’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏إِنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ وَإِنْ كَذَبْتُمُوْنِيْ) ‘তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেও এটা এক মহা সত্য যে, আমি আল্লাহর রাসূল (ﷺ)।’

অতঃপর ‘রাসূলুল্লাহ’ কথাটি মুছে ফেলে তার পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লিখার জন্য তিনি আলী (রাঃ)-কে নির্দেশ দিলেন।

কিন্তু আলী (রাঃ) ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’ কথাটি মুছে ফেলার ব্যাপারটিকে কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না। আলী (রাঃ)’র মানসিক অবস্থা অনুধাবন করে নাবী কারীম (ﷺ) স্বীয় মুবারক হাত দ্বারাই কথাটি মুছে ফেললেন। তার পর পুরো চুক্তিটি লিপিবদ্ধ করা হয়ে গেল।

যখন সন্ধি চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেল তখন বনু খুযা’আহ গোত্র রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাঙ্গনে প্রবেশ করল। এরা প্রকৃতপক্ষে আব্দুল মুত্তালিবের সময় হতেই বনু হাশিমের হালীফ ছিল। যেমনটি পুস্তকের প্রারম্ভে উল্লেখিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অঙ্গীকারাঙ্গনে বনু খুযা’আহর প্রবেশের ব্যাপারটি ছিল পূর্বতন প্রতিজ্ঞারই ফলশ্রুতি বা পরিপক্ক অবস্থা। অন্যদিকে কুরাইশদের অঙ্গীকারাঙ্গনে প্রবেশ করল বনু বাকর গোত্র।