মদীনায় প্রবেশ (الدُّخُوْلُ فِي الْمَدِيْنَةِ):

জুমআর সালাত শেষে নাবী (ﷺ) মদীনায় প্রবেশ করলেন। ঐ দিন থেকেই এ শহরের নাম ইয়াসরিরের পরিবর্তে মদীনাতুররাসূল বা রাসূলের শহর হয়ে যায় সংক্ষেপে একে মদীনা বলা হয়ে থাকে। এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঐতিহাসিক দিবস। মদীনার অলিতে গলিতে সর্বত্র সেদিন তাকদীস ও তাহমীদের (পবিত্রতা ও প্রশংসার) গুঞ্জণ ধবনি শ্রুত হচ্ছিল। আনসারদের ছেলেমেয়েরা আনন্দ উদ্বেল কণ্ঠে নিন্মের কবিতার চরণগুলো সুর ও ঝংকার সহকারে গেয়ে বেড়াচ্ছিল।

طـلـع الـبــدر علـينا

**

مـن ثـنيــات الـوداع

وجـب الشـكـر علـين

**

مـــا دعــا لـلـه داع

أيـهـا المبـعـوث فـينا

**

جـئـت بـالأمـر المطاع

‘‘দক্ষিণ পাশের পাহাড় হতে পূর্ণিমার চন্দ্র আমাদের উপর উদিত হয়েছে।’

‘‘কি উত্তম ধর্ম ও শিক্ষা! আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রতি ওয়াজেব।’

তোমার নির্দেশ অনুসরণ করা ফরয। তোমার প্রেরণকারী হচ্ছেন কিবরিয়া (মহাপ্রভূ)[1]

আনসারগণ যদিও ধনী ছিলেন না, তবুও সকলের আশা ছিল যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তার বাসাতেই অবস্থান করুন। ফলে তার উটনী আনসারদের যে বাড়ি কিংবা মহল্লার পাশ দিয়ে অতিক্রম করত সেখানকার লোকজন উটনীর লাগাম ধরে নিতেন এবং অনুরোধ করতেন যে, আসবাবপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা প্রস্তুত রয়েছে, আগমন করুন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন ‘উটনীর পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদের্শিত রয়েছে। ফলে উটনী একটানা চলতে থাকল এবং ঐ স্থানে এসে বসে পড়ল যেখানে মসজিদে নাবাবী রয়েছে।

কিন্তু তিনি নীচে অবতরণ করলেন না। তারপর উটনী পুনরায় উঠে দাঁড়াল এবং কিছু দূরে গিয়ে ঘুরে ফিরে দেখার পর পূর্বের জাগাতেই এসে বসে পড়ল। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নীচে অবতরণ করলেন। এটা ছিল তাঁর নানীর, অর্থাৎ বনু নাজ্জার গোত্রের মহল্লা। আর উটনীর জন্য ছিল এটা আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেয়েছিলেন তাঁর নানার গোত্রে অবস্থান করে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে, সেই জন্যই এ ব্যবস্থা।

এখন বনু নাজ্জার গোত্রের লোকজনেরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নিজ নিজ গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর নিকট আবেদন নিবেদন শুরু করে দিলেন। কিন্তু আবূ আইউব আনসারী (রাঃ) উষ্ট্রের পালান উঠিয়ে নিলেন এবং বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতে লাগলেন মানুষ তার পালানের সাথে রয়েছে। এদিকে আস’আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) এসে উটনীর লাগাম ধরে নিলেন, ফলে উটনী তার নিকটেই রয়ে গেল।[2]

সহীহুল বুখারী শরীফে আদাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘কোন্ লোকের বাড়ি আমার থেকে নিকটে’’?

আইউব আনসারী (রাঃ) বলেন, ‘আমার বাড়ি, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এটা আমার বাড়ি আর এটা আমার দরজা।’

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বললেন, ‘যাও এবং আমার বিশ্রামের জায়গা ঠিক কর। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) দুজনকেই সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন।[3]

কিছুদিন পর নাবী পত্নী উম্মুল মু’মিনীন সওদা (রাঃ) এবং নাবী তনয়া ফাত্বিমাহ (রাঃ) ও উম্মুল কুলসুম (রাঃ) এবং উসামা বিন যায়দ (রাঃ) ও উম্মু আয়মান (রাঃ) মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন। এদের সকলকে আব্দুল্লাহ বিন আবূ বাকর (রাঃ)- আবূ বকরের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যাদের মধ্যে ‘আয়িশাহও ছিলেন- নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য নাবী তনয়া যায়নাব (রাঃ), আবুল আসের নিকট থেকে গিয়েছিলেন। তিনি তাকে আসতে দেননি। তিনি বদরের যুদ্ধের পরে এসেছিলেন।[4]

‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মদীনায় পৌঁছার পর আবূ বাকর (রাঃ) ও বিলাল (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। আমি তাদের খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আববাজান! আপনি কেমন আছেন? তারপরে বিলালকে লক্ষ্য করে বললাম আপনি কেমন আছেন? তিনি অর্থাৎ ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন যখন আবূ বাকর (রাঃ)-এর জ্বর আসত তখন তিনি এ কবিতা পাঠ করতেন,

كل امرئ مُصَبَّحٌ في أهله ** والموت أدنى من شِرَاك نَعْلِه

অর্থঃ প্রতিটি মানুষকে তার আত্মীয়ের মাঝে সুপ্রভাত বলা হয়ে থাকে অথচ মৃত্যু তার জুতার ফিতার চাইতেও নিকটবর্তী।

বিলালের অবস্থা যখন একটু সুস্থ থাকত তখন তিনি নিজের দুঃখপূর্ণ স্বর উঁচু করে বলতেনঃ

ألا ليت شِعْرِى هل أبيتَنَّ ليلة ** بوَادٍ وحولى إذْخِرٌ وجَلِيْـلُ
وهل أردْن يومـًا ميـاه مِجَنَّة ** وهل يَبْدُوَنْ لى شامة وطَفِيْلُ

‘হায় যদি আমি জানতাম যে, আমার কোন একরাত্রি যাপন হবে এক প্রান্তরে (মক্কায়) এবং আমার পাশে ইযখির ও জালীল (ঘাস) থাকবে এবং কোন দিন কি মাজিন্না ঝর্ণাতে অবতরণ করতে পারব এবং আমি সামা ও তুফাইল পাহাড় দেখতে পাব?’

‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন যে, আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের এ প্রলাপের সংবাদ দিলাম। তখন তিনি বললেন,

‏[اللهم حبب إلينا المدينة كحبنا مكة أو أشد، وصححها، وبارك في صاعها ومدها، وانقل حماها فاجعلها بالجُحْفَة‏]‏‏.‏

‘‘হে আল্লাহ, আমাদের নিকট মদীনাকে এমন প্রিয় করে দাও যেমন মক্কা প্রিয় ছিল বরং তার চেয়ে অনেক বেশী। মদীনার মাঠ, ঘাট ও আবহাওয়া স্বাস্থ্যের উপযোগী করে দাও এবং উহার ‘সা‘’ ও ‘মুদ্দে’ (শস্য মাপার পাত্র বিশেষ) বরকত দাও, তার অসুখ প্রত্যাবর্তন করে জুহফাহ’য় পৌঁছিয়ে দাও।[5] আল্লাহ তাঁর দু‘আ শুনলেন ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটল।

এখান পর্যন্ত পবিত্র জীবনের এক প্রকার ও ইসলামী দাওয়াতের এক যুগ অর্থাৎ মক্কী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। আমরা এখন তাঁর মাদানী জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো। আল্লাহ তা’আলা তাওফীক দাতা।

[1] কবিতার এ অনুবাদটি আল্লামা মানসুরপুরী করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন যে, এ কবিতাটি তাবুকের যুদ্ধ হতে নাবী (সাঃ)-এর ফেরত আসার সময় পাঠ করা হয়েছিল এবং যাঁরা বলেছেন এটা নাবী (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশের সময় পাঠ করা হয়েছিল তাঁদের ভুল হয়েছে। (যা’দুল মা’আদ ৩/১০২ পৃঃ।) কিন্তু আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম ভুল হওয়ার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেন নি। এর বিপরীতে আল্লামা মানসুরপুরী এ কবিতাটি নাবী (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশের সময় পাঠ করা হয়েছিল বলে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর নিকট দলীলও রয়েছে। রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১০৬ পৃঃ।

[2] যা’দুল মা’আদ ২য়/৫৫ পৃঃ। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০৬ পৃঃ।

[3] সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৬ পৃঃ।

[4] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৫ পৃঃ।

[5] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৮৮-৫৮৯ পৃঃ।