আর-রাহীকুল মাখতূম শোকের বছর (عَــامُ الْحُـــزْنِ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি

প্রাণপ্রিয় চাচা আবূ ত্বালীবের মৃত্যু এবং প্রাণাধিকা প্রিয়া ও সহধর্মিনী উম্মুল মো’মিনীন খাদীজাহ (রাঃ)-এর মুত্যু এ দুটি মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেল অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে। এ দুটি মৃত্যুর সুদূর প্রসারী ফল প্রতিফলিত হতে থাকল নাবী (ﷺ)-এর জীবনে। একদিকে যেমন তাঁর জীবনে বিস্তার লাভ করল নিদারুণ শোকের ছায়া, অন্যদিকে তিনি বঞ্চিত হলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী অভিভাবকের অভিভাবকত্ব এবং সহধর্মিনীর অনাবিল প্রেম ভালবাসা ও সাহচর্য থেকে। পিতৃব্যের মৃত্যুর ফলে মুশরিকগণের সাহস বৃদ্ধি পেয়ে গেল বহুগুণে। নাবী (ﷺ) ও মুসলিমগণের উপর নতুন উদ্যমে তারা শুরু করল নানামুখী নির্যাতন। একেত প্রিয় পরিজনদের বিয়োগ ব্যথা, অন্যদিকে দুঃখ, যন্ত্রণা নির্যাতন পর্বতসম ধৈর্য্যের অধিকারী হয়েও নাবী (ﷺ)-এর জীবন হয়ে উঠে বিষাদময় ও বিপর্যস্ত, হয়ে উঠে নৈরাশ্যে ভরপুর। নৈরাশ্যের মাঝে কিছুটা আশায় বুক বেঁধে অগ্রসর হন তিনি ত্বায়িফের পথে যদি সেখানকার লোকজন দাওয়াত গ্রহণ করেন, কিংবা দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যাপারে তাঁকে কিছুটা সাহায্য করেন, কিংবা তাঁকে একটু আশ্রয় প্রদান করে তাঁর জাতির বিরুদ্ধে সাহায্য করেন। কিন্তু সেখানে দাওয়াত কবুল, আশ্রয় কিংবা, সাহায্য প্রদান কোন কিছু তো নয়ই, বরং তাঁর সঙ্গে এতই নির্মম আচরণ করা হল এবং এতই দৈহিক নির্যাতন চালানো হল যে, তা অতীত নির্যাতনের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে গেল (এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করা হবে আরও পরে)।

এ দিকে মক্কার মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তাঁর অনুগামী ও অনুসারীদের উপর ইতোপূর্বে যেভাবে জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়ে আসছিল এখনো অব্যাহতভাবে তা চালিয়ে যেতে থাকল। শুধু তাই নয়, বরং নির্যাতনের মাত্রা এত বেশী বৃদ্ধি পেতে থাকল যে, আবূ বাকর (রাঃ) -এর মতো অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং কষ্ট সহিষ্ণু ব্যক্তিও অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠলেন এবং উপায়ান্তর না দেখে মক্কা ছেড়ে হাবশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে ‘বারকে গিমাদ’ নামক স্থানে পৌঁছলে ইবনে দাগানার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। সে তাঁকে নিরাপত্তা বিধানের আশ্বাস দিয়ে নিজ আশ্রয়ে মক্কায় ফিরে নিয়ে আসে।[1]

ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, যখন আবূ ত্বালিব মৃত্যুমুখে পতিত হন তখন কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এত কষ্ট দেন যা আবূ ত্বালীবের জীবদ্দশায় কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। এখানে একটি ঘটনার উল্লে­খ করা হল। একদিন এক নির্বোধ ও গোঁয়ার প্রকৃতির কুরাইশ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে এগিয়ে এসে মাথার উপর মাটি নিক্ষেপ করে দেয়। সেই অবস্থাতেই তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর এক কন্যা সেই মাটি ধুইয়ে পরিস্কার করে দেন। ধোয়ানোর সময় তিনি ক্রন্দন করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে সান্ত্বনা দানের জন্য বললেন,

‏(‏لَا تَبْكِىْ يَابُنَيَّةُ، فَإِنَّ اللهَ مَانِعٌ أَبَاكَ‏)

‘‘পুত্রী ক্রন্দন কোরো না। আল্লাহই তোমার পিতার হিফাজতকারী।’’

ঐ সময় তিনি এ কথাও বলেন যে,

‏(‏مَا نَالَتْ مِنِّىْ قُرَيْشٌ شَيْئًا أَكْرَهُهُ حَتّٰى مَاتَ أَبُوْ طَالِبٍ‏)‏‏

‘‘যতদিন আমার চাচা আবূ ত্বালিব জীবিত ছিলেন কুরাইশগণ আমার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করে নি যা আমার সহ্যের বাহিরে ছিল।’’[2]

এমনিভাবে অবিরাম একের পর এক বিপদাপদের সম্মুখীন হওয়ার কারণে নাবী কারীম (ﷺ) সেই বছরটির নাম রাখেন ‘আমুল হুযন’ অর্থাৎ দুঃখ কষ্টের বছর। ইতিহাসে সে বছরটি এ নামেই প্রসিদ্ধ।

[1] আকবর শাহ নাজীরাবাদী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এ ঘটনা সেই বছরই ঘটেছিল। দ্রঃ তারীখে ইসলাম ১ম খন্ড ১২০ পৃঃ। মূল ঘটনাসহ বিস্তারিত আলোচনা ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃঃ ৩৭২ ও ৩৭৪ ও সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড পৃঃ ৫৫২ ও ৫৫৩ তে উলে­খ আছে।

[2] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪১৬ পৃঃ।