হাদীসের নামে জালিয়াতি শুভাশুভ, সাজসজ্জা, পানাহার ও বিবিধ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনান গ্রনেহ বলেন: আমাদেরকে হান্নাদ বলেছেন, আমাদেরকে উমার ইবনু হারূন বলেছেন, তিনি উসামা ইবনু যাইদ থেকে, তিনি আমর ইবনু শু‘আইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তাঁর দাদা থেকে,

كَانَ يَأْخُذُ مِنْ لِحْيَتِهِ مِنْ عَرْضِهَا وَطُولِهَا

‘‘রাসূলুল্লাহ () নিজের দাঁড়ির দৈর্ঘ ও প্রস্থ থেকে কাটতেন।’’

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: ‘‘এ হাদীসটি গরীব (দুর্বল)। আমি মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (ইমাম বুখারী)-কে বলতে শুনেছি, উমার ইবনু হারূন কোনোরকম চলনসই রাবী (مقارب الحديث)। তার বর্ণিত যত হাদীস আমি জেনেছি, সবগুলোরই কোনো না কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়। কিন্তু এই হাদীসটির কোনোরূপ ভিত্তি পাওয়া যায় না। আর এই হাদীসটি উমার ইবনু হারূন ছাড়া আর কারো সূত্রে জানা যায় না।’’[1]

ইমাম তিরমিযীর আলোচনা থেকে আমরা তিনটি বিষয় জানতে পারি: (১) এ হাদীসটি একমাত্র উমার ইবনু হারূন ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে বর্ণিত হয় নি। একমাত্র তিনিই দাবি করেছেন যে, উসামা ইবনু যাইদ আল-লাইসী তাকে এ হাদীসটি বলেছেন। (২) ইমাম বুখারীর মতে উমার ইবনু হারূন একেবারে পরিত্যক্ত রাবী নন। (৩) উমার ইবনু হারূন বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ভিত্তি পাওয়া গেলেও এ হাদীসটি একেবারেই ভিত্তিহীন।

অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস দ্বিতীয় বিষয়ে ইমাম বুখারীর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বিষয়টির সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমাদেরকে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতি এবং এ বিষয়ক মতভেদ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করবে।

উমার ইবনু হারূন ইবনু ইয়াযিদ বালখী (১৯৪ হি) ২য় হিজরী শতকের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁর আরো একটি বিশেষ পরিচয় ছিল যে, তিনি মুহাদ্দিসগণের ও আহলূস সুন্নাতের আকীদার পক্ষে মুরজিয়াগণের বিপক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখতেন। ফলে অনেক মুহাদ্দিসই তাঁকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, তিনি তাঁর কোনো কোনো উস্তাদের নামে এমন অনেক হাদীস বলেন, যেগুলো সে সকল উস্তাদের অন্য কোনো ছাত্র বলেন না। মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষায় এগুলো ধরা পড়ে।

এর কারণ নির্ণয়ে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাঁর প্রসিদ্ধি ও বিদ‘আত বিরোধী ভূমিকার ফলে অনেক মুহাদ্দিস তাঁর বিষয়ে ভাল ধারণা রাখতেন। তাঁরা তাঁর এ একক বর্ণনাগুলোর ব্যাখ্যায় বলেন যে, সম্ভবত তিনি অনেক হাদীস মুখস্থ করার ফলে কিছু হাদীসে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করতেন। এদের মতে তিনি ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলতেন না। এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম বুখারী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস।

অপরদিকে অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের নিরীক্ষায় তাঁর মিথ্যা ধরা পড়েছে। এদের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১৮১ হি)। তিনি বলেন, আমি ইমাম জাফর সাদিকের (১৪৮ হি) কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করার জন্য মক্কায় গমন করি। কিন্তু আমার পৌঁছানোর আগেই তিনি ইন্তিকাল করেন। ফলে আমি তাঁর কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি নি। আর উমার ইবনু হারূন আমার পরে মক্কায় আগমন করে। এরপরও সে দাবি করে যে, সে ইমাম জাফর সাদিক থেকে অনেক হাদীস শুনেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সে মিথ্যাবাদী।

আব্দুর রাহমান ইবনু মাহদী (১৯৪হি) বলেন, উমার ইবনু হারূন আমাদের কাছে এসে জাফর ইবনু মুহাম্মদ (ইমাম জাফর সাদিক)-এর সূত্রে অনেক হাদীস বলেন। তখন আমরা উমার ইবনু হারূনের জন্ম এবং তার হাদীস শিক্ষার জন্য মক্কায় গমনের তারিখ হিসাব করলাম। এতে আমরা দেখলাম যে, উমারের মক্কায় গমনের আগেই জা’ফর ইন্তিকাল করেন। (উমার ১২৫/১৩০ হিজরীর দিকে জন্মগ্রহণ করেন। জাফর সাদিক ১৪৮ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। এ সময়ে উমার হাদীস শিক্ষার জন্য বের হন নি।)

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল বলেন, উমার ইবনু হারূন একবার কিছু হাদীস বলেন। পরবর্তী সময়ে সে হাদীসগুলোই তিনি অন্য উস্তাদের নামে এবং অন্য সনদে বলেন। ফলে আমরা তার হাদীস পরিত্যাগ করি।

এভাবে অনেক মুহাদ্দিস উমার ইবনু হারূনকে মিথ্যাবাদী বা পরিত্যক্ত বলেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইয়াহইয়া কাত্তান, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, নাসাঈ, সালিহ জাযরাহ, আবূ নু‘আইম, ইবনু হিববান ও ইবনু হাজার।[2] এ জন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[3]

এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা), আবূ হুরাইরা (রা) প্রমুখ সাহাবী থেকে গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা হজ্জ বা উমরার পরে যখন মাথা টাক করতেন, তখন দাড়িকে মুষ্টি করে ধরে মুষ্টির বাইরের দাড়ি কেটে ফেলতেন।[4] এজন্য কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন যে, এক মুষ্টি পরিমাণের বেশি দাড়ি কেটে ফেলা যাবে। অন্যান্য ফকীহ বলেছেন যে, দাড়ি যত বড়ই হোক ছাঁটা যাবে না, শুধুমাত্র অগোছালো দাড়িগুলো ছাঁটা যাবে।

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৯৪।

[2] ইবনু হাজার, তাহযীব ৭/৪৪১-৪৪৩; তাকরীব, পৃ. ৪১৭।

[3] আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৬৫৩; যায়ীফাহ ১/৪৫৬-৪৫৭।

[4] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২০৯; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ২/২৫৫, ৬/৮২; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১০৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১০/৩৫০।