হাদীসের নামে জালিয়াতি জাল হাদীস প্রমাণে জাল পুস্তক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
(খ) শাইখ কামাদানী ও ড. মাহমূদ সায়ীদ-এর বক্তব্য

আলোচ্য ‘হারানো’ পুস্তকটির ৩-৪ পৃষ্ঠায় মিসরের নাগরিক ও আরব আমিরাতে অবস্থানকারী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমূদ সায়ীদ মামদূহ-এর একটি প্রশংসাপত্র বিদ্যমান। বস্ত্তত পুস্তকটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারী তাঁর পান্ডুলিপি মাত্র দুজন আলিমকে দেখতে দেন: শাইখ আদীব কামাদানী ও ড. মাহমূদ সায়ীদ। শাইখ কামাদানী সিরিয়ার একজন মুহাদ্দিস ও পান্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই প্রদেশের ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ে গবেষক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। এ সময়ে শাইখ হিমইয়ারীও একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ও উভয়ে বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেন, শাইখ হিমইয়ারী মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের কোনো পান্ডুলিপি থেকে নূর মুহাম্মাদী বিষয়টি প্রমাণ করতে অত্যন্ত অস্থির ছিলেন এবং সবাইকে বিষয়টি বলতেন। তাঁর এ অস্থিরতা দেখে ভারতের একজন ব্রেলবী পীর এ পান্ডুলিপিটি তাকে এনে দেন। পান্ডুলিটি পেয়ে হিমইয়ারী আনন্দ প্রকাশ করতে বিশাল মেজবানির আয়োজন করেন।

হিমইয়ারী কামাদানী ও মাহমূদ সায়ীদকে পান্ডুলিপিটি দেখতে দেন। কামাদানী পান্ডুলিপির কাগজ, কালি ও লিখনপদ্ধতি দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই এটিকে জাল বলেন। তিনি বলেন: পান্ডলিপিটির বয়স দুবছরের বেশি কখনোই হতে পারে না। কিন্তু হিমইয়ারী এটিকে জাল বলে মানতে কিছুতেই রাজি হন না। কামাদানী তাকে বলেন: আপনি দুবাইয়ের পান্ডুলিপি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে প্রেরণ করে এর বয়স, কাগজ, কালি ও লিখনির বিষয় যাচাই করুন এবং পান্ডুলিপির সংগ্রাহক কোথা থেকে তা অনুলিপি করেছে তা জানুন। হিমইয়ারী বলেন: পান্ডুলিপিটির সংগ্রাহক বলেছেন সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি লাইব্রেরি থেকে তারা পান্ডুলিপিটির অনুলিপি করে এনেছেন, তবে মূল পান্ডুলিপিটি যুদ্ধে নষ্ট হয়ে গিয়েছে! মুসান্নাফ-এর অবশিষ্ট অংশের পান্ডুলিপি দেখাতে বললে তারা অপারগতা প্রকাশ করেন![1]

দ্বিতীয় ব্যক্তি ড. মাহমূদ সায়ীদ মুহাম্মাদ মামদূহ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদীস গবেষক। তিনি পান্ডুলিপিটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারীর মত সূফী আকীদার অনুসারী এবং সালাফীগণের বিরোধী। শাইখ আলবানী ও সালাফীগণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুপরিচিত। আমরা দেখেছি তিনি এ ‘হারানো’ পুস্তকের প্রশংসাপত্র লিখেন। কিন্তু দু বছর পরে ২০০৭ সালে তিনি তাঁর প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করে এবং বইটির অনির্ভরযোগ্যতা বর্ণনা করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির নাম (بيان من الشيخ محمود سعيد حول ما طبع باسم الجزء المفقود من مصنف عبد الرزاق) ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের হারানো অংশ নামে যা ছাপা হয়েছে তার বিষয়ে শাইখ মাহমূদ সায়ীদের বক্তব্য’।

এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আকীদা ও আমলে তিনি শাইখ হিমইয়ারীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন ও ভালবাসেন। হিমইয়ারী তাঁকে যখন এ পান্ডুলিপিটি দেখান তখন তিনি দুটি কারণে এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন: (১) পান্ডুলিপিটির কাগজ এবং কালি নতুন এবং (২) পান্ডুলিপির উপর এর সনদ, শ্রবণ, মালিকানা ইত্যাদির তথ্য লেখা নেই। দুবাইয়ের জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে পান্ডুলিপিটি পাঠালে তারা বলে যে, পান্ডুলিপিটির বয়স সর্বোচ্চ ৫০ বা ৬০ বৎসর। হিমইয়ারী এ পুস্তকটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁকে একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিতে অনুরোধ করেন। তিনি পান্ডুলিপিটি পুরো না পড়ে, শুধু তার ভূমিকার উপর নির্ভর করে একটি প্রশংসাপত্র লিখেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, পান্ডুলিপিটি অনির্ভরযোগ্য। মুমিনের জন্য ভুলের পক্ষে হুজ্জতি না করে ভুল স্বীকার করে সত্যগ্রহণ উত্তম। এজন্য তিনি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এর প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামের পুস্তকটিতে তাঁর লেখা প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করলেন। এর সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি আরো বলেন যে, আলোচিত পুস্তকের বাতিলকৃত প্রশংসাপত্রে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক হাদীসটির প্রসঙ্গ মোটেও উল্লেখ করেন নি। কারণ তাঁর উস্তাদ আহমাদ গুমারী, আব্দুল্লাহ গুমারী ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস এ হাদীসটি জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। একটি বইয়ের প্রশংসাপত্র লেখার জন্য বইটির মধ্যে বিদ্যমান সকল হাদীস বা জাল হাদীসের বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজনীয় বলে তিনি মনে করেন নি। এজন্যই তিনি উক্ত প্রশংসাপত্রে হাদীসটির জালিয়াতির প্রসঙ্গ আলোচনা করেন নি।

বিস্তারিত আলোচনার পর তিনি লিখেন: ‘‘মোট কথা ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামে প্রকাশিত বইটি একেবারেই অনির্ভরযোগ্য। এ বইটির রেফারেন্স দেওয়া বা অনুবাদ করা যাবে না।’’[2]

[1] মুহাম্মাদ যিয়াদ তুকলাহ মাউসূআতুর রাদ্দি আলস সুফিয়্যাহ (শামিলা ৩.৫) ১১০/৬-৭।

[2] ড. মাহমূদ সায়ীদ, আল-ইত্তিজাহাতল হাদীসিয়্যাহ ফিল কারনির রাবিয় আশারা (কাইরো, দারুল বাসায়ির, ১৪৩০/২০০৯), পৃষ্ঠা ৭২৭-১৩০।